দীর্ঘমেয়াদি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাই গড়বে শক্তিশালী বাংলাদেশ
কয়েকদিন আগে জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনের এক অনুষ্ঠানে একজন বুদ্ধিজীবী বলেছিলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হলেই দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, তা নয়। এ জন্য দীর্ঘমেয়াদি চর্চা এবং অনুশীলন প্রয়োজন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নাগরিকদের মাঝেও বিভিন্ন ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি ও গণতান্ত্রিক চেতনা জাগাতে হবে।’
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক এটাই যে, দেশের রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতেই ঐকমত্য নেই। ফলে রাষ্ট্র হিসেবে শক্তিশালী হচ্ছে না বাংলাদেশ। জাতিরাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা নিয়েও বিশিষ্ট নাগরিকদের মাঝে রয়েছে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি উন্নত রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিয়েছেন রাষ্ট্র এবং সমাজের শীর্ষ পর্যায়ের অনেকেই। বিত্তবান এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারীদের অধিকাংশের সন্তানরাও বিদেশে পড়াশোনা করে। অর্থাৎ নিজ দেশের প্রতি এই শ্রেণির নাগরিকদের আনুগত্য এবং দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত নয়।
দেশজুড়ে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে হতাহতদের একজনও কোনো রাজনৈতিক শীর্ষনেতা বা নেত্রীর সন্তান নন। যে কোনো সংকটকালেই আমাদের নেতা-নেত্রীরা জনগণের কাছে না গিয়ে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর স্থানীয় দূতাবাসে ধরনা দেন। অনেকেই মনে করছেন, দেশে বসবাসের উপযোগী পরিবেশ নেই। তাই তারা বিদেশগামী হচ্ছেন। আবার অবৈধভাবে অর্থ-বিত্ত গড়ে তোলা দুর্নীতিবাজরাও বাংলাদেশকে নিরাপদ মনে করছেন না। তাই উপার্জিত অর্থ ও সম্পদ বিদেশে পাচার করছেন তারা। মূলত গণতন্ত্রহীনতার কারণেই এগুলো হচ্ছে।
জাতীয় নির্বাচনে সরকার গঠনে মতামত জানায় জনগণ; কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে দলীয় সরকারের অধীনে আয়োজিত আটটি জাতীয় নির্বাচনের কোনোটিই বিতর্কমুক্ত ছিল না। মাঝখানে তত্ত্বাবধায়ক ও অস্থায়ী সরকার পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত চারটি নির্বাচন ছিল মোটামুটি বিতর্কমুক্ত এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য। যদিও ২০০৬ সালে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে বিতর্কিত করে ফেলে। পরে ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সুফল ভোগ করলেও ক্ষমতায় গিয়ে এ পদ্ধতিই সংবিধান থেকে বাদ দেয়। ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের অদূরদর্শিতা এবং যেনতেনভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রবণতায় রাষ্ট্রের ওপর জনগণের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই শিথিল হয়ে গেছে। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ সব সময় পরস্পরবিরোধী অবস্থানে থাকলেও পুঁজিবাদি বিশ্বের চাপিয়ে দেয়া মুক্তবাজার অর্থনীতি ও অবাধ প্রতিযোগিতাবাদ গ্রহণে তারা একমত। পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিগুলোর বিরাজনীতিকরণ ও বিরাষ্ট্রীয়করণের অঘোষিত পরিকল্পনায়ই পরিচালিত হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা ও বিচার ব্যবস্থা। নিজ স্বার্থ উদ্ধারে এদেশের সব বিষয়ে অতি উৎসাহী ভারত, নিয়ন্ত্রিত সরকার চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। আমাদের দেশে যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হন, তারাই ক্ষমতায় টিকে থাকতে জাতীয় স্বার্থের বদলে বিদেশি রাষ্ট্রের স্বার্থ উদ্ধারে ব্যস্ত থাকেন। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ যেন বৃহৎ শক্তিগুলোর হাতের পুতুল।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোতে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রচর্চা নেই বললেই চলে। যে রাজনৈতিক দল নিজেদের মধ্যেই গণতন্ত্রচর্চা করে না, তাকে দিয়ে রাষ্ট্রীয় অঙ্গনে প্রত্যাশিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কীভাবে সম্ভব? স্বাধীনতার পর থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন সব দলের শীর্ষ নেতৃত্বই পারিবারিকীকরণে গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। এমনভাবে দলীয় গঠনতন্ত্র প্রণীত হয়, যেন দলের শীর্ষপদে একই পরিবারের সদস্যরা ঘুরে-ফিরে আসতে পারেন। ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব নির্বাচন করে দেন তারা। সেগুলোতে তাই প্রতিভাবান শিক্ষার্থীদের চেয়ে পেশিশক্তিধারীদের প্রাধান্য বেশি। গত সাড়ে ১৫ বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয়নি। ফলে ছাত্রদের রাজনীতিচর্চার সুযোগ পুরোপুরি বন্ধ। ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা নিজস্ব সমস্যা নিয়ে কোনো আন্দোলনে নামার বদলে দলীয় নির্দেশে রাজপথে বিরোধী দলের আন্দোলন দমাতেই ব্যস্ত। সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন দমাতে পুলিশের পাশাপাশি দেখা গেছে হেলমেট পরা সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠনের কর্মীদেরও। আজকে যারা ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, আগামীতে তারাই জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব দেবেন। কাজেই এখনই যদি তাদের মধ্যে গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি অঙ্গীকার গড়ে তোলা না যায়, তাহলে তাদের কাছ থেকে আগামীতে ভালো কিছু প্রত্যাশা করা যাবে না।
গণতন্ত্র না থাকায় ক্ষুণ্ন হচ্ছে জবাবদিহিও। দলীয়করণে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক কর্মপরিবেশ। সেগুলোতে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদেরই আধিপত্য। দুর্নীতি-অপকর্মের সুবিধার্থে বিভিন্ন ব্যানারে সরকারদলীয় রাজনীতি করছেন প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সরকার এসব মতলববাজদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে বরং উৎসাহিত করছে। প্রতিটি স্তরেই তাই দুর্নীতি-অনাচারও বাড়ছে। ব্যাংকঋণের লাখ লাখ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে আছে, যার বেশিরভাগই নানা প্রক্রিয়ায় বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। অবলোপনকৃত ঋণাঙ্ক, পুনঃতপশিলীকৃত ঋণ এবং মামলাধীন প্রকল্পের কাছে প্রাপ্ত ঋণ বাদ দিয়ে খেলাপিঋণের হিসাব প্রদর্শন করা হচ্ছে, যা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়।
দেশের ব্যাংকিং সেক্টর কয়েকটি পরিবারের কাছে জিম্মি। অনৈতিক সুবিধা নিয়ে এ সেক্টরকে বিপর্যয়ে ফেলেছেন তারাই। বিপর্যস্ত করে ফেলা হয়েছে শেয়ারবাজারকেও। এখন যারা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, তাদের বেশিরভাগই ব্যবসায়ী-শিল্পপতি। গত সংসদের ৬০ শতাংশেরও বেশি সদস্য ছিলেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা। সংসদে তাই যেসব আইন প্রণীত হয়, তার বেশিরভাগই ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তাদের স্বার্থসুরক্ষা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদেরই পক্ষে।
রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিচার বিভাগ হচ্ছে সাধারণ মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল; কিন্তু ব্যাপক দলীয়করণে বিচার বিভাগকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর প্রধান বিচারপতিসহ ছয়জন বিচারপতি একযোগে পদত্যাগ করেছেন, যা দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। বিচারপতিরা দায়িত্ব পালনকালে দলীয় আনুগত্য প্রদর্শন না করলে তাদের পদত্যাগের প্রশ্নই উঠতো না। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর নির্বিচারে পুলিশ হত্যায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ফলে থানাগুলো কয়েকদিন কার্যত পুলিশশূন্য ছিল। বিশ্বের কোনো দেশেই এর নজীর আর একটিও নেই। এগুলোও ব্যাপক মাত্রায় দলীয়করণের ফল।
ছাত্র আন্দোলনে রাষ্ট্র ক্ষমতার পরিবর্তন ব্যক্তি পর্যায়ে গণতন্ত্রচর্চা এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অপূর্ব সুযোগ তৈরি করেছে। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে কমিটি গঠন এবং তার সুপারিশের ভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। সংবিধান এমনভাবে সংস্কার করতে হবে যেন, রাজনেতিক দলগুলো অভ্যন্তরীণ সংস্কারে বাধ্য হয়। একই ব্যক্তি দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী অথবা মন্ত্রী হতে পারবেন না। আর সরকারপ্রধান এবং দলীয়প্রধান একজন থাকতে পারবেন না।
শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ নয়, বরং দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করতে হবে। ছাত্ররা যেনতেন ইস্যুতে রাজনৈতিক দল বা নেতাদের লেজুরবৃত্তি করতে পারবে না- এমন বিধান করা যেতে পারে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থেকেও দলীয় রাজনীতি চর্চাকারীদের বিরুদ্ধে কঠিন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। যে দলই সরকার গঠন করুন না কেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সততার সঙ্গে রাষ্ট্রের নীতি-আদর্শ ও উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নে কঠোর আইন করতে হবে।
লেখক: সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বাংলা ফাউন্ডেশন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে