ইন্টারনেটের দাম কমানোর উদ্যোগ বড় সম্ভাবনার সুযোগ সৃষ্টি করবে
একটি বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, আমাদের দেশে ফিক্সড ব্রডব্র্যান্ড কিংবা মোবাইল ইন্টারনেট উভয় ক্ষেত্রেই ইন্টারনেটের স্পিড এখন পর্যন্ত তুলনামূলকভাবে কম। আশার কথা হচ্ছে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যারা টেলিযোগাযোগ খাতের নেতৃত্বে আছেন, তাদের মধ্যে একটা সদিচ্ছা দেখা গেছে। তারা চান দেশের মানুষ সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্পন্ন ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে যাক। এ সদিচ্ছার সঙ্গে যারা ইন্টারনেট ভ্যালু চেনে বিভিন্ন পর্যায়ের অপারেটর আছেন, তাদের মধ্যে যদি আস্থা এবং সহযোগিতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে অপেক্ষাকৃত কমমূল্যে মানসম্পন্ন ইন্টারনেট সেবা দেওয়া কঠিন কিছু নয়।
আমি যদি অপারেটরদের কথা চিন্তা করি, তাদের বিনিয়োগ এবং পরিচালনা ব্যয়ের কথা চিন্তা করি, তাহলে এটা বলতেই হবে, গুণগত মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত করতে হলে দাম কম নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ভালো সেবার জন্য দামটাও সে অনুযায়ীই নির্ধারিত হবে। কারণ ব্যবসায়িকভাবে লাভবান না হলে সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষেও মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না; কিন্তু একই সঙ্গে আর একটি নিদারুণ বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দেশে সে ধরনের বাজার ব্যবস্থা নেই, যেখানে সেবার দাম বাড়িয়ে উচ্চমানের সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। কারণ বাংলাদেশে অধিকাংশ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কম। দাম বেশি হলে তারা হয় সেবা নেয় না, কিংবা ব্যবহার কমিয়ে দেয়।
সেক্ষেত্রে সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানেরই ব্যবসায়িক ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ে। যেমন বর্তমানে আমাদের দেশে এখন ইন্টারনেট সংযোগ সারা দেশেই আছে। ব্রডব্র্যান্ড সংযোগ গ্রাম পর্যন্ত আছে। মোবাইল নেটওয়ার্ক দেশের সব প্রান্তেই আছে। দুর্গম অঞ্চলেও আছে; কিন্তু তারপরও নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা কম। এত বড় সংখ্যার মানুষ ইন্টারনেট সংযোগ কিংবা নিয়মিত ব্যবহারের বাইরে থেকে যাচ্ছেন। দাম বাড়লে কিন্তু নিয়মিত ব্যবহারকারীর সংখ্যা আরও কমে যেতে পারে। ফলে দাম কমিয়েও যদি ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ানো যায়, তাহলে সেটা সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যও লাভজনক হতে পারে। কারণ ব্যবহাকারীর সংখ্যা বাড়ার অর্থ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা সম্প্রসারিত হওয়া।
সে দৃষ্টিকোণ থেকেই ইন্টারনেট সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কয়েকটি স্তরের পক্ষ থেকে দাম কমানোর যে ঘোষণা গত তিন দিনে এসেছে, তা ইতিবাচক বলেই মনে হয়। গত ১৯ এপ্রিল টিআরএনবির গোলটেবিলে টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব তার বক্তব্যে খুব স্পষ্ট করেই বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেবার বর্তমান চিত্র তুলে ধরেছেন এবং কম সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্পন্ন ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। ওই গোলটেবিল আলোচনাতেই ফিক্সড ব্রডব্র্যান্ড ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইএসপিএবির পক্ষ থেকে সাধারণ গ্রাহকদের জন্য ওই দিন থেকেই ৫০০ টাকায় ১০ এমবিপিএস গতির ব্যান্ডউইথ নিশ্চিত করার ঘোষণা দেওয়া হয়।
আগে গ্রাহকরা সমপরিমাণ টাকায় ৫ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেট পেতেন। টাকার অঙ্কে দাম না কমলেও একই দামে দ্বিগুণ গতিতে সেবা নিশ্চিত হওয়ার বিষয়টি অবশ্যই সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্পন্ন ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করার পথে খুবই ভালো একটি পদক্ষেপ। এরপরের দিন ট্রান্সমিশন সেবাদাতা এনটিটিএন প্রতিষ্ঠান, টেরিস্টেরিয়াল কেবলের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ব্যান্ডউইথ সরবরাহকারী আইটিসি এবং ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও এই তিনটি স্তরে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত দাম কমানোর সিদ্ধান্ত এসেছে। এটা আরও ইতিবাচক পদক্ষেপ। ফলে সার্বিকভাবে সাধারণ গ্রাহকের কাছে সেবা দেওয়া আইএসপি এবং মোবাইল অপারেটর উভয় ক্ষেত্রেই সেবা পরিচালনা ব্যয়ের একটা অংশ কমবে এবং গ্রাহক পর্যায়েও দাম কমানোর সুযোগ সৃষ্টি হবে।
এখানে বলে রাখি, আমাদের দেশে টেলিযোগাযোগ খাতের ভ্যালু চেনে থাকা বিভিন্নস্তরের অপারেটরদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই পারস্পরিক আস্থার সংকট আছে। যে কারণে তাদের মধ্যে সহযোগিতার একটি পরিবেশও হোঁচট খেয়েছে। এই অবস্থা কোনোস্তরের অপারেটরের জন্যই সুখকর হয়নি। বরং সর্বস্তরের অপারেটররাই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন যদি সেই আস্থা ও সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তাহলে সত্যিকার অর্থে আরও কম দামে গুণগত মানসম্পন্ন ইন্টারনেট সেবা দেওয়া সম্ভব হবে। সর্বস্তরের অপারেটরাও একটি ভালো সম্ভাবনার দিকে তাকিয়ে ব্যবসা এগিয়ে নিতে পারবে।
বর্তমানে কয়েকটি স্তরে দাম কমার কারণে প্রাথমিকভাবে সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো হয়তো কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে ব্যবসায়িক সুফল পাওয়ারও বড় সুযোগ তৈরি হবে। কারণ দাম কমার কারণে ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়বে। ডাটার ব্যবহারের ভলিউম বাড়বে। যেটা আগামীর তথ্য প্রযুক্তি দুনিয়ায় দ্রুত রূপান্তরের যে চ্যালেঞ্জ সেটা মোকাবিলা করার জন্যও জরুরি। সামগ্রিকভাবে দেশের ইন্টারনেটের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি সুফল বয়ে আনবে বলে আমরা মনে করি। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ হলো সার্ভিস কোয়ালিটি আরেকটু বাড়লে সেটা আরও বেশি সম্ভাবনার সৃষ্টি করবে। ফলে ভবিষ্যতে আমরা আরও বেটার ইন্টারনেট পাব এবং ইন্টারনেটভিত্তিক যে ইকোনমিক গ্রোথ, সেটা আরও বড় হবে।
সাধারণ গ্রাহকদের কথা বিবেচনা করে এখানে একটা কথা বলে রাখি। ফিক্সড ব্রডব্র্যান্ডের ক্ষেত্রে প্যাকেজ মূলত ব্যান্ডউইথের গতির ওপর নির্ভর করে হয় এবং এখানে প্যাকেজ নিয়ে কোনো জটিলতা নেই; কিন্তু মোবাইল অপারেটরদের প্যাকেজ নিয়ে রীতিমতো একটা গোলক ধাঁধায় পড়তে হচ্ছে। কোনোটা তিন দিন, কোনোটা সাত দিন, একেকটার ডাটা ভলিউম একেক রকম। কোন প্যাকেজ নিতে গিয়ে কোনটা নিয়ে ফেলি, সত্যি বলতে কি আমি নিজেও প্যাকেজ কিনতে গিয়ে কনফিউজড হয়ে যাই। এই যে অসংখ্য প্যাকেজের গোলক ধাঁধা, আমার মনে হয় এখান থেকে বের হয়ে আসাটা জরুরি। একটা সরল বা সিম্পলিফাইড প্যাকেজ নীতি অনুসরণ করে প্যাকেজ নির্ধারিত হওয়া উচিত। আমি মনে করি, মোবাইল ইন্টারনেটে প্যাকেজ খুব বেশি হলে দশটি নির্ধারিত হতে পারে, তার বেশি নয়।
সুমন আহমেদ সাবির: টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাত বিশেষজ্ঞ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে