প্রতারিত হয়ে হারিয়েছে জমিজমা, অবহেলা-বঞ্চনায় মানবেতর জীবনযাপন মাহাতো-মুন্ডাদের
একসময় অনেক জমি-জমা ছিল তাদের। মহাজনের ঋণের ফাঁদে ফেলে এসব জমি হাতিয়ে নিয়েছেন সমাজের একশ্রেণির অর্থলোভীরা। নির্মম এই প্রতারণার শিকার হয়ে এখন ‘নিজভূমেই পরবাসী’ মুন্ডা ও মাহাতো সম্প্রদায়ের কয়েক হাজার মানুষ। যাদের বসবাস খুলনা জেলার কয়রা ও ডুমুরিয়া উপজেলা এবং সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর, মুন্সীগঞ্জ, দেবহাটা ও তালা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে।
সাড়ে পনেরো হাজার ভোটারসহ ৩৮ হাজার ২১২ জন মানুষকে নিয়ে প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি ‘মুন্ডা বসতি’ রয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে। এর মধ্যে কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী, উত্তর বেদকাশী ও কয়রা সদর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে ২ হাজার মানুষ দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করছে এই জনগোষ্ঠীর মানুষ। সুন্দরবনের কোলঘেঁষে অবস্থিত এই তিনটি ইউনিয়নে মাহাতো ও মুন্ডা জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব জীবনযাপনে অভ্যস্ত।
নীরব, সাদাসিধে আর সরল বিশ্বাসী হওয়ায় প্রতারকের খপ্পরে পড়ে এসব মুন্ডা পরিবারের সদস্যরা সবাই এখন গরিব ও নিস্ব। শত-সহস্র অবজ্ঞা-অবহেলায় পদে পদে প্রতিকূলতায় পদদলিত ‘নিম্নশ্রেণি’ হিসেবে পরিগণিত এসব মানুষ। অবশিষ্ট থাকা সামান্য ভিটে মাটি-জমিও বেচাকেনার ক্ষেত্রে পায় না ন্যায্য মূল্য। বাধ্য হয়ে তাই এখন পেটের দায়ে শ্রম বিক্রি করে সংসার চালান তারা। তবে সেখানেও উপযুক্ত পারিশ্রমিক পান না বলে অভাব তাদের নিত্যসঙ্গী। অক্ষর জ্ঞানহীন ও সহজ-সরল হওয়ায় পারিশ্রমিক নিয়ে প্রতিবাদ করতেও সাহস পান না। ফলে নিদারুণ মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
মুন্ডাদের নিজস্ব ভাষা অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত ‘মুন্ডারি’। কোনো লিখিত রূপ নেই এর, কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে বর্ণমালাও। বিলুপ্তির পথে মুখে মুখে প্রচলিত কথ্যভাষা। হারিয়ে যাচ্ছে তাদের নিজস্ব জীবনপ্রণালি এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যও।
মুন্ডা সম্প্রদায় দক্ষিণ এশিয়ার একটি বড় নৃ-গোষ্ঠী। মুন্ডা শব্দটি সংস্কৃত ভাষা থেকে উদ্ভূত, যার প্রকৃত অর্থ গ্রামপ্রধান। প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতের ঝাড়খণ্ড ও ছত্রিশগড় রাজ্যের ছোটনাগপুর, মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গে মূলত তাদের বসবাস। দুইশ বছর আগে মুন্ডারা এদেশে এসেছেন ভারতের উড়িষ্যা থেকে। বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন এলাকায় এদের আদিবসতির চিহ্ন মেলে।
জন্ম থেকে মুন্ডারা খুবই পরিশ্রমী, অলস জীবনযাপনে অভ্যস্ত নন। তারা মনে করেন, জন্ম হয়েছে খেটে খাওয়ার জন্য। মৃত্যু পর্যন্ত খেটে খেয়ে যেতে হবে। বেঁচে থাকার তাগিদে বেছে নিয়েছে নানা পেশা। মৌসুমে মহাজনের জমিতে দিনমজুর, বনে জঙ্গলে মাছধরা, গৃহস্থের বাড়িতে কামলা খাটার পাশাপাশি এলাকায় যখন কাজ থাকে না তখন ধান কাটতে ও ইটভাটায় কাজ করতে দেশের বিভিন্ন জেলায় চলে যান।
জীবিকার তাগিদে পরিবারের নারী-পুরুষ সবাই মিলে ঘরে-বাইরে কাজ করেন। তার পরেও দুঃখ-দৈন্য তাদের জীবনযুদ্ধের নিত্যসঙ্গী। আবার খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপন প্রণালী ও সাংস্কৃতিক চর্চ্চার ভিন্নতাও তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে মূলধারার সাথে।
মুন্ডা পরিবারে জন্ম নেয়া শিশুরাও যেন দারিদ্র্যের অভিশাপের চলমান চিত্র। অনাহারে-অর্ধাহারে, অপুষ্টিতে অশিক্ষায়, অনাদরে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিশাহীন প্রজন্ম তারাও। শতকরা ৫-১০ জন শিশু স্কুলে গেলেও ঝরেপড়াদের সংখ্যাই বেশি। অভাবের সংসারে আয়ের সহায়ক হিসেবে শিশুশ্রমে জড়িয়ে গেছে এই অধিকারবঞ্চিত শিশুরা।
সরেজমিনে কয়রা গ্রামে দেখা গেছে, ইট ভাঙছে কয়েকজন মুন্ডা শিশু। নাম ও কেন এ বয়সে কাজ করছে- জিজ্ঞাসা করতেই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব শিশু জানায়, কয়রা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে পড়লেও অভাব-অনটনের সংসারে বাবা-মাকে সাহায্য করতে এতো পরিশ্রমের কাজ করছে।
ইট ভাঙতে ভাঙতে হাতে ফোঁসকা উঠলেও এটিই তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন। রোদে পোড়া, বৃষ্টিতে ভেজা এসব শিশুর চোখে-মুখে পেটের ক্ষুধা আর কষ্টের রেখা স্পষ্ট। ভাঙা ভাঙা গলায় তারা বলেছে, রোজগার করেই দুমুঠো ভাত মুখে দিতে হয় তাদের।
এই এলাকায় এখনো প্রসূতি মা সন্তান জন্ম দেন প্রাচীন আমলের ধাত্রীর দেখভালে। তাদের জন্য নেই পর্যাপ্ত ক্লিনিক বা হাসপাতাল। ফলে মা ও শিশুমৃত্যুর হার বেড়েই চলেছে। মা ও শিশু জন্মের আগে ও পরে মারাত্মক পুষ্টিহীনতায়ও ভোগে। নিতান্তই যেন প্রকৃতির কোলে লালিত-পালিত হয় শিশুরা।
পরিসংখ্যানও বলছে, পর্যাপ্ত খাবার, পুষ্টির অভাব ও চিকিৎসা সংকটে তাদের মৃত্যুহার ঊর্ধ্বমুখী।
তবে এই অঞ্চলের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে মুন্ডা-মাহাতোদের কিছু সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে৷ সরকারি সহায়তায় গৃহনির্মাণ, আদিবাসী কোটায় চাকরির নিশ্চয়তাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। মা ও শিশুর মৃত্যুহার রোধে স্বাস্থ্য সেবার পাশাপাশি সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইনও চলমান। শিশু-কিশোরদের যুগোপযোগী শিক্ষায় শিক্ষিত করতে নেয়া হয়েছে নানামুখী পদক্ষেপ।
ফলে হাজার প্রতিকূলতা উতরে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারছে কিছু মুন্ডা তরুণ-তরুণী। উত্তর বেদকাশী বড়বাড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সুম্মীতার জানায়, সীমিত গণ্ডির মাঝেই ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে তারা। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার স্বপ্ন দেখে সে। সামাজিক বৈষম্য ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতা, উচু-নিচুর ভেদাভেদ এড়িয়ে এগিয়েও যেতে চায়।
কয়রা সদরের তরুণ মুন্ডা বলেন, ‘আমাদের সংস্কৃতি বিলুপ্তির পথে। শিশুদের জন্য নেই আলাদা স্কুল বা পাঠ্যবইয়ের ব্যবস্থা। স্কুলে অন্যরা আমাদের ছেলে-মেয়েদের ভালোভাবে নেয় না। সরকারি সুযোগ-সুবিধাও কম পাই। আমাদের অধিকাংশ পুরুষ ও নারীরা দিনমজুরিতে জীবিকা নির্বাহ করেন’।
কোনো ধরনের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় হারিয়ে যাচ্ছে তাদের মাতৃভাষা। ভাষারক্ষায় তাদের শিশুদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক পাঠদানসহ ভাষা সংরক্ষণ, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নেরও দাবি জানান তরুণ মুন্ডা।
ইনিশিয়েটিভ ফর কোস্টাল ডেভেলপমেন্টের (আইসিডি ) প্রতিষ্ঠাতা আশিকুজ্জামান বলেন, ‘মুন্ডা সম্প্রদায়ের অধিকাংশ বাবা-মা নিরক্ষর হওয়ায় শিশুদের পড়ালেখার গুরুত্ব বুঝতে পারেন না। সমাজে পিছিয়ে পড়া মুন্ডা শিশুদের শিক্ষা বিস্তারে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ নিতে হবে’।
‘দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের এসব প্রান্তিক ও বঞ্চিত মানুষকে ঝুঁকিমুক্ত করতে জলবায়ু সহনশীল নানা কর্মসূচি ও উদ্যোগ গ্রহণ এবং সেগুলোতে তাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের জন্য সরকারি প্রণোদনা তাদেরকে বরাদ্দ দিতে অন্তর্ভূক্তিমূলক ও সংবেদনশীল হতে হবে’।
কয়রা সদর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শাহাবুদ্দিন আহম্মেদের ভাষ্য, ‘মুন্ডা সম্প্রদায়ের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও বাস্তবায়নে সরকারের সাথে সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে। তাহলে তাদের জীবনমানসহ সার্বিক উন্নতি হবে’।
‘সমাজের শিক্ষিত মানুষেরও উচিত, তাদেরকে ভালোভাবে বুঝিয়ে সভ্য ও সুন্দর জীবনের পথে আনা। তাদের মাঝে শিক্ষা-দীক্ষা বিষয়ে সচেতনতা গড়তে হবে’- বলেন তিনি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুলী বিশ্বাস বলেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তাদের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা এবং ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।
কয়রার আদিবাসী মুন্ডা ও মাহাতো পরিবারের সদস্যদেরকে স্বাবলম্বী করতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে সহযোগিতা করা হচ্ছে। বিস্তারিত খোঁজ-খবর নিয়ে তিনি আরও উদ্যোগ নেবেন বলে বলেও জানান তিনি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে