রিজার্ভের স্ফীতি ধরে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সাম্প্রতিক সময়ে কমে যাচ্ছে। রিজার্ভ কমার নানা কারণ রয়েছে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য কয়েকটি উৎস আছে। এর মধ্যে পণ্য ও সেবা রপ্তানি, জনশক্তি রপ্তানি এবং বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য। এতদিন মূলত এই কয়েকটি উৎস থেকেই আমরা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছিলাম। রেমিট্যান্স থেকে যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয় তার প্রায় পুরোটাই জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করে। কারণ এ খাতে কোনো বিদেশি কাঁচামাল এবং ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি করতে হয় না। কিন্তু অনেক দিন ধরেই আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করছি বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি কর্মসংস্থান উপলক্ষে বিদেশে যাচ্ছেন কিন্তু রেমিটেন্স সেভাবে আসছে না। গত দুই বছরে প্রায় ২৩ লাখ বাংলাদেশি কর্মসংস্থান উপলক্ষে বিদেশে গমন করেছেন। এর বিপরীতে ১০ লাখ লোক যদি দেশে ফিরেও আসে, তাহলেও তো ১৩ লাখ লোক বিদেশে গিয়েছেন। এই যে এত বিপুল সংখ্যক মানুষ বিদেশে গেলো তারা কি পরিমাণ রেমিট্যান্স প্রেরণ করলেন তা আমরা জানতে পারছি না।
বর্ধিত সংখ্যায় জনশক্তি বিদেশে গেল, অথচ প্রেরিত রেমিট্যান্সের পরিমাণ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। যারা বিদেশে গেছেন এবং কাজ করছেন তারা তো নিশ্চয়ই উপার্জন করছেন। কিন্তু তাদরে উপার্জিত অর্থ ঠিক মতো দেশে আসছে না। এটা বিশ্বাস করার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই যে, প্রবাসী বাংলাদেশিদের আয় বা উপার্জন কমে গেছে। তারা উপার্জন করছেন কিন্তু সেই টাকা বৈধভাবে ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে আসছে না। প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশের সীমানা স্পর্শ করে না। হুন্ডি ব্যবসায়িরা প্রবাসী বাংলাদেশিদের উপার্জিত অর্থ নিয়ে নিচ্ছে। বিপরীতে প্রবাসী কর্মীদের পরিবারবর্গকে বাংলাদেশি মুদ্রায় অর্থ পরিশোধ করা হচ্ছে। ফলে প্রবাসী বাংলাদেশিদের উপার্জিত অর্থের একটি বড় অংশই বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে যুক্ত হচ্ছে না।
সাম্প্রতিক সময়ে হুন্ডির মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অর্জিত অর্থ দেশে প্রেরণের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং অস্থিরতা আগামী দিনগুলোতে আরো বৃদ্ধি পাবে বলেই মানুষের মধ্যে একটি সাধারণ ধারনা সৃষ্টি হয়েছে। আগামী মাসগুলোতে দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে এটা বিশ্বাস করার যৌক্তিক কারণ রয়েছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ জটিলতার দিকে যাচ্ছে। পণ্য রপ্তানিকারকদের মাঝেও সম্ভাব্য রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নিয়ে এক ধরনের শঙ্কা রয়েছে। তারা মনে করছেন, পণ্য রপ্তানিকৃত অর্থ এত দ্রুত দেশে আনার তাগিদ অনুভব করছেন না। তারা মনে করছেন, রপ্তানি আয় দেশের আনার ক্ষেত্রে কিছুটা বিলম্ব করি, দেখি পরিস্থিতি কোন্ দিকে যায়। তারা এটাও মনে করছেন, স্থানীয় বাজারে মার্কিন ডলারের মূল্য আগামীতে আরো বৃদ্ধি পাবে। তাই উপার্জিত রপ্তানি আয় কিছুদিন ধরে রাখা গেলে বিনিময় হার বেশি পাওয়া যেতে পারে।
এছাড়াও কিছু রপ্তানিকারক আছেন- যারা আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে রপ্তানি আয়ের একটি বড় অংশ বিদেশেই রেখে দেন। যখন কোনো অর্থনীতিতে অর্থ পাচারের প্রবণতা বৃদ্ধি পায় তখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উপরও তার প্রভাব পড়ে। এক শ্রেণির আমদানিকারকও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে আমদানি পণ্যের মূল্য বেশি দেখিয়ে বিদেশে অর্থ পাচার করে থাকেন। বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে বলে বিভিন্ন সংস্থা দাবি করছে। কয়েক বছর আগে ওয়াশিংটন ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফ্যিান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি (জিএফআই) তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে ৬৪ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়। এই পরিসংখ্যান নিয়ে কারো কারো দ্বিমত থাকতে পারে, তবে এ ব্যাপারে কোনো সংশয় নেই যে দেশ থেকে প্রতি বছরই বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সাম্প্রতিক সময়ে অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। কিন্তু সেই ব্যবস্থাগুলো কতটা সুফল দিচ্ছে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাসমূহ যেমন বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ বা এডিবি থেকে যে অর্থ আমরা পেয়ে থাকি তা যথারীতি আসতে থাকবে। কিন্তু সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ অনেকটাই কমে গেছে। কারণ কোনো দেশে রাজনৈতিক এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা না থাকলে সেই দেশে বিদেশি বিনিয়োগকারিরা বিনিয়োগে আগ্রহী হয় না।
শর্ট টার্ম ক্রেডিট, ট্রেড ফাইন্যান্সিংয়ের ক্ষেত্রেও সমস্যা হচ্ছে। বাংলাদেশি ব্যবসায়িগণ মার্কিন ডলার স্বল্পতার কারণে তাদের এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) নিষ্পত্তি করতে পারছে না। বিদেশি সাপ্লাইয়ারগণ তো পণ্য সরবরাহ করেছে। তারা যদি নির্ধারিত সময়ে তাদের পাওনা বুঝে না পান তাহলে সমস্যা দেখা দেবেই। এলসি নিষ্পত্তির হার কমে যাওয়ায় সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এলসি মার্জিন বেড়ে যাচ্ছে। গত দুই মাসে ট্রেড ফাইন্যান্সিংয়ে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নিগেটিভ হয়ে গেছে। জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং নির্বাচন পরবর্তী সরকার গঠন পর্যন্ত এই অবস্থা চলতে থাকবে বলেই মনে হচ্ছে। নির্বাচন পরবর্তী সরকার যদি অস্থিতিশীল হয় তাহলে রিজার্ভের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যেতে পারে। আগামীতে রেমিট্যান্সের উপর খুব একটা নির্ভরশীল হওয়া যাবে বলে মনে হয় না। এছাড়া ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার শর্ট টার্ম ক্রেডিট পরিশোধের জন্য চাপ আছে। এই অর্থ পরিশোধ করতে হবে। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি অনেকটাই কমে গেছে। এক সময় যেখানে প্রতি মাসে ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করা হতো সেখানে এখন আমদানি পরিমাণ সাড়ে ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে। আমদানি ব্যয় আর কমনো সম্ভব নয়। বরং বাড়াতে হবে। সামনে জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনের সামনে সাধারণ মানুষের জন্য নিত্য পণ্যের যোগান বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে আমদানি ব্যয় কমানোর নামে যাতে শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল ও ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি কমে না যায় তাও আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ শিল্পের কাঁচামাল এবং ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি কমে গেলে উৎপাদন কমে যাবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হবে। চূড়ান্ত পর্যায়ে সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম ব্যাহত হবে।
সব মিলিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের স্ফীতি ধরে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ব্যাংক ঋণের সুদ’ এর হার বাড়াতে পারে। একবারে সম্ভব না হলে ধাপে ধাপে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়াতে পারে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক পলিসি রেট ০ দশমিক ৭৫ শতাংশ বাড়িয়েছে। আর ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানো হয়েছে ০ দশমিক ৫০ শতাংশ। পলিসি রেট এবং ব্যাংক ঋণের সুদের হার সমান্তরালভাবে বাড়ানো উচিত ছিল। তবুও ব্যাংক ঋণের সুদের যেটুকু বাড়ানো হয়েছে তাকে আমরা ‘মন্দের ভালো’ বলতে পারি। তবে এখানেই থেমে থাকলে চলবে না। ব্যাংক ঋণের সুদের হার আরো বাড়াতে হবে। আমি মনে করি, ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাজার ভিত্তিক করা প্রয়োজন। যদি এই মুহূর্তে, বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে সেটা সম্ভব না হলেও ধাপে ধাপে ব্যাংক ঋণের সুদের হারকে বাজার ভিত্তিকের কাছাকাছি নিয়ে যেতে হবে।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে যারা দেশে আসে তারা যে বৈদেশিক মুদ্রা সাথে করে নিয়ে আসে তা বাজারে বিক্রি করে। কিন্তু এর পরিমাণ খুব একটা বেশি নয়। আসলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা তাদের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠাচ্ছেন না। তারা কর্মস্থল থেকেই হুন্ডি ব্যবসায়িদের নিকট বৈদেশিক মুদ্রা হস্তান্তর করেন। হুন্ডি ব্যবসায়িগণ তাদের স্থানীয় এজেন্টদের মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশিদের লোকাল বেনিফিশিয়ারিদের টাকা দিয়ে দেয়। অর্থাৎ উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসেই না। বিদেশ থেকেই তা লেনদেন হয়ে যায়। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যেহেতু আমাদের দেশে এক ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হচ্ছে, তাই আগামীতে দেশ থেকে অর্থ পাচার বেড়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে। প্রতিবারই জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। তবে এবারের অবস্থা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে জটিল। কাজেই যারা অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করেছেন তারা দুশ্চিন্তায় আছেন। বিগত বছরগুলোতে অনেকেই রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছেন। জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হলে তারা সমস্যায় পড়তে পারেন এই ভয়ে উপার্জিত অর্থ-সম্পদ যতটা সম্ভব বিদেশে পাচার করে দিতে চাইবেন এটাই স্বাভাবিক। তাদের এ ধরনের চাওয়ার সঙ্গত কারণ আছে। নতুন সরকার আসার পর তাদের সমস্যা হতে পারে। তাই তারা সেই ঝুঁকি নিতে চাইবেন না।
বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন উপায়ে অর্থ পাচার হয়ে থাকে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হচ্ছে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা তথ্য প্রকাশ করছে। একটি সূত্র মতে, অন্তত ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ রপ্তানি আয় বিদেশে রয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি সিডিউল ব্যাংকগুলোকে রপ্তানি আয় দ্রুত দেশে প্রত্যার্পনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছে। রপ্তানি আয়ের যে অংশ বিদেশে রয়ে গেছে তা দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশে আনা হলে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ বর্তমানে যে পর্যায়ে আছে তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। এটা আরো কমে গেলে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। তাই আমাদের এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত আয়ের উপর নগদ আর্থিক প্রণোদনার পরিমাণ বাড়িয়েছে। এটা প্রবাসী বাংলাদেশির বৈধ অর্থাৎ ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স দেশে প্রেরণের ক্ষেত্রে আগ্রহী করে তুলতে হবে। আমাদের এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রবাহ সচল এবং গতিশীল থাকে। একই সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় এবং বিলাসজাত পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তবে শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি যাতে হ্রাস না পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট (পিআরআই)
অনুলিখন: এম এ খালেক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে