ওমানের শ্রমবাজারে বড় ধাক্কা
উপসাগারগীয় দেশগুলোতে বাংলাদেশের শ্রম রপ্তানির সম্ভবনাময় এক বাজার ওমান। গত ৩১ অক্টোবর বাংলাদেশিদের জন্য সব ধরনের ভিসা প্রদান স্থগিত করেছে ওমান সালতানাত। এতে ভোগান্তিতে পড়বে বাংলাদেশের শ্রমবাজার। রয়্যাল ওমান পুলিশের (আরওপি) বরাত দিয়ে এ তথ্য জানায় ওমানের শীর্ষস্থানীয় ইংলিশ দৈনিক টাইমস অব ওমান।
ওমানে ট্যুরিস্ট এবং ভিজিট ভিসায় আসা প্রবাসীদের 'ভিসা পরিবর্তনের' সুযোগ বাতিলের এই খবরটি নিশ্চিত করেছে আরওপি। এর আগে দেশটিতে ভিজিট ভিসায় আসা প্রবাসীরা তাদের ভিসাকে এমপ্লয়মেন্ট ভিসায় পরিবর্তন করে নিতে পারতেন। এখন তাদের ওমান ত্যাগ করে ওয়ার্ক ভিসা নিয়ে পুনরায় দেশটিতে প্রবেশ করতে হবে।
আরওপি এক বিবৃতিতে জানায়, "কয়েক ধরনের ভিসা প্রাপ্তির নীতিমালা পর্যবেক্ষণ করে আরওপি ঘোষণা দেয় যে, ওমান সালতানাতে আসা সকল দেশের নাগরিকদের ভিজিট ভিসাকে ওয়ার্ক ভিসায় পরিবর্তনের সুযোগ স্থগিত ঘোষণা করা হলো। পাশাপাশি বাংলাদেশিদের জন্য সব ধরনের ভিসা ইস্যুও স্থগিত করা হলো। এ আদেশ ৩১ অক্টোবর থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।"
যদিও ওমানের শ্রমবাজারে শীর্ষ স্থানটি ধরে রেখেছে বাংলাদেশ, তবে উপসাগরীয় অঞ্চলে গত বছরের তুলনায় এ বছর শ্রম রপ্তানিতে পতন ঘটবে বলে জানায় সূত্র। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝে এক লাখ ছয় হাজার ৮৪৮ জন (মোট রপ্তানির ১০ দশমিক ৮০ শতাংশ) শ্রমিক পাঠিয়েছে বাংলাদেশ, যা গেলো বছরে ছিল এক লাখ ৭৯ হাজার ৬১২ (মোট রপ্তানির ১৫ দশমিক ৮১ শতাংশ)।
২০১৬ সালে ওমানে এক লাখ ৮৮ হাজার ২৪৭ জন শ্রমিক পাঠায় বাংলাদেশ, যা ছিল এক বছরের হিসেবে সর্বোচ্চ সংখ্যক। এই সংখ্যা ২০২২ সালে এক লাখ ৭৯ হাজার ৬১২ জন, ২০১২ সালে এক লাখ ৭০ হাজার ৩২২, ২০১১ সালে এক লাখ ৩৫ হাজার ২৬৫ এবং ২০১৫ সালে এক লাখ ২৯ হাজার ৮৫৯ জন ছিল।
আরব নিউজের বরাতে জানা যায়, ওমান সরকার তার 'এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড রিপ্লেসমেন্ট প্ল্যান'-এর অধীনে দেশটির নাগরিকদের জন্য চাকরির বাজার সৃষ্টি এবং বিদেশি কর্মীদের সরিয়ে স্থানীয়দের সুযোগ প্রদানের লক্ষ্যে এ উদ্যোগ নিয়েছে।
ওমানের জাতীয় পরিসংখ্যান ও তথ্য কেন্দ্রের (এনসিএসআই) প্রকাশিত তথ্য জানায়, ওমানে কর্মরত প্রবাসীদের তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে বাংলাদেশ, যার শ্রমিক সংখ্যা সাত লাখ তিন হাজার ৮৪০ জন। এর পরই পাঁচ লাখ ৩০ হাজার ২৪২ জন শ্রমিক নিয়ে ভারতের অবস্থান। ওমানের এক শীর্ষস্থানীয় ইংলিশ দৈনিক অ্যারাবিয়ান স্টোরিস এ তথ্য জানায়।
জাতীয়তার ভিত্তিতে করা এক তথ্য-বিশ্লেষণে দেখানো হয়েছে, ওমানে কর্মরত সর্ববৃহৎ প্রবাসী শ্রমিকগোষ্ঠী হিসেবে বাংলাদেশ ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে। গত বছরের মার্চে এনসিএসআই'য়ের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশটিতে পাঁচ লাখ ৪৬ হাজার ১৮২ জন বাংলাদেশি বসবাস করছেন। গত এক বছরে এ সংখ্যা দেড় লাখেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০২২ সালের মার্চে ভারতীয় প্রবাসীদের সংখ্যা ছিল চার লাখ ৯০ হাজার ১১৪, যেখানে পাকিস্তানীরা ছিলেন দুই লাখ ছয় হাজার ৮৩ জন। সেখানে প্রবাসী পাকিস্তানীদের বর্তমান সংখ্যা দুই লাখ ৭৫ হাজার ৭১৯।
দেশটিতে প্রবাসী শ্রমিকদের স্থিতিশীল বৃদ্ধি দেখানো হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। ২০২৩ সালের মে নাগাদ এ সংখ্যা ছিল ১৭ লাখ ৮৪ হাজার ৭৩৬ জনে, যা গত মাসের তুলনায় শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে।
প্রবাসী শ্রমিকদের সর্ববৃহৎ কর্মক্ষেত্র ওমানের বেসরকারি খাত। এখানে কাজ করছেন ১৪ লাখ ছয় হাজার ৯২৫ জন শ্রমিক, যেখানে দেশটির সরকারি খাতে নিয়োজিত রয়েছেন মোট ৪৪ হাজার ২৩৬ জন প্রবাসী।
দেশটির প্রশাসনিক অঞ্চল বিবেচনায় সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রবাসী শ্রমিক রয়েছেন মাস্কটে (ছয় লাখ ৬৯ হাজার ৫২৭)। সংখ্যার ভিত্তিতে এরপরই দোফার (দুই লাখ ২০ হাজার ৭০৫ জন) এবং মুসানদামের (১৪ হাজার ৭২৭ জন) অবস্থান।
আরব নিউজ জানায়, বছরের প্রথমার্ধের মাঝেই চাকরির বাজার সৃষ্টির যে লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছে দেশটি, তার ৫৩ শতাংশ পূরণ হয়ে গেছে। আর এর মাধ্যমে ২০২৩ সালের 'এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড রিপ্লেসমেন্ট প্ল্যান'কে ছাড়িয়ে যাওয়ার পথেই রয়েছে ওমান।
দেশটির শ্রম মন্ত্রণালয়ের অতিসাম্প্রতিক তথ্যে জানা যায়, জুনের শেষ নাগাদ সরকারি এবং বেসরকারি খাতে ১৮ হাজার ৭১৬টি চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।
এপ্রিলে ওমানের শ্রমবিষয়ক মন্ত্রী মাহাদ সাঈদ বা'ওয়াইন জানান, ২০২৩ সালে ৩৫ হাজার নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্য রয়েছে তার মন্ত্রণালয়ের। ওমানের নাগরিকদের জন্য সুযোগ বৃদ্ধি এবং প্রবাসীদের স্থলে স্থানীয়দের নিয়োগের লক্ষ্যে গৃহীত 'এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড রিপ্লেসমেন্ট প্ল্যান' ওমান সরকারের একটি উদ্যোগ। ওমানের এই মন্ত্রণালয় জানায়, প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের দায়িত্ব পরিবর্তনের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৪৮৬-তে। প্রথমবার নিয়োগ পেয়েছেন এবং আগে থেকেই চাকরি করছেন- এমন কর্মীর সংখ্যা ৩৫ হাজার ২০২ জন বলে জানানো হয়।
প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মীর চলে যাওয়া এবং নতুনদের যোগদানের সঙ্গে চাকরিরত অবস্থায় প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগের বিষয়টি যুক্ত। সরকারি খাতে এ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে ৬১১ জনের। যে সংখ্যা বেসরকারি খাতে এক হাজার ৫৩৭, বলা হয় প্রতিবেদনে।
জুলাইয়ে সুলতান হাইসাম বিন তারিক দেশটির শ্রম আইন সংশোধনে এক রয়্যাল ডিক্রি জারি করেন। এই নতুন বিধি ওমানের 'ভিশন ২০৪০'-এর লক্ষ্যমাত্র অর্জনে সমান্তরালে কাজ করবে, যা কিনা দেশটির শ্রমবাজারের দেখভাল করবে। এই আইন দেশটির জাতীয় সক্ষমতা অর্জন এবং তাদের অধিকার ও দায়িত্বশীলতাকে অগ্রাধিকার দেবে।
এই আদেশের বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বা'ওয়াইন জানান, শ্রম আইনটি বাজারে পরিবর্তন ও উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট। ওমানকে উচ্চস্তরে এগিয়ে নিতে এই আইন দেশের নেতৃত্বের প্রখরতাকেই তুলে ধরে, যোগ করেন তিনি। মন্ত্রী বলেন, "এই আইন কর্মী এবং নিয়োগদাতা উভয়ের সুযোগ-সুবিধাকে প্রাধান্য দেয়। এটা আইনসমূহের একীভূতকরণ, যাতে জনমতের প্রতিফলন রয়েছে। এর মাধ্যমে শ্রমবাজারে ভারসাম্য আনয়ন এবং নতুন এক ওমান গঠনে শক্ত ভিত্তি গড়ে তোলা হবে।"
ওমানের চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান ফায়সাল আল-রোয়াস একইসঙ্গে বলেন, এই আইন দেশে বিনিয়োগের পরিবেশের উন্নতি ঘটাবে এবং শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করবে, জানায় আরব নিউজ।
এদিকে, ওমান সালতানাতে প্রবাসী কর্মশক্তি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২৩-এর এপ্রিলের শেষ নাগাদ বিদেশি কর্মীদের মোট সংখ্যা এক দশমিক ৭৭৬ মিলিয়নে পৌঁছেছে। এনসিএসআই-এর সর্বসাম্প্রতিক প্রকাশিত তথ্য শ্রমবাজারে দেশটির জনসংখ্যার বণ্টনের ওপর আলোকপাত করেছে। সেইসঙ্গে এ বাজারে ভূমিকা রাখা শীর্ষস্থানীয় জাতিগোষ্ঠীদের তুলে ধরেছে।
এরই মাঝে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ (বায়রা) জানায়, আগত দিনগুলোতে ওমানসহ উপসাগরীয় অঞ্চলের শ্রমবাজার আর জমজমাট থাকবে না। এ কারণে বাংলাদেশের নয়া শ্রমবাজার খুঁজে নেওয়া উচিত। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, ১৯৭৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মোট এক দশমিক ছয় মিলিয়নের মতো শ্রমিক ওমানে পাঠিয়েছে। যা কিনা ওই সময়ের মধ্যে ওমানের বিদেশ থেকে নেওয়া মোট জনশক্তির ১১ দশমিক ৬ শতাংশ ছিল।
ওমানের বিষয়ে কাজ করেন বাংলাদেশে পেশাবিষয়ক কূটনীতিক মৌসুমি রহমান। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য সবচেয়ে বড় বাজার সৌদি আরব। ১৯৭৬-২০২১ সালের মধ্যে কিংডম অব সৌদি অ্যারাবিয়ায় ৪৬ লাখ ৬৮ হাজার ৫৪২ জন শ্রমিক পাঠিয়েছে বাংলাদেশ, যা ছিল সৌদির শ্রমবাজারের ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ। "বর্তমানে ওমানে সাত লাখের মতো প্রবাসী বসবাস করছেন এবং বিভিন্ন খাতে চাকরি করছেন", বলেন তিনি। ওমানের শ্রমবাজার বাংলাদেশিরা বেশ লাভজনক বলেই মনে করেন, যোগ করেন এই কূটনীতিক।
মৌসুমি রহমান বলেন, "প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য এই সালতানাত অন্যতম সেরা গন্তব্য হয়ে থাকবে বলেই বিশ্বাস করি। আমাদের প্রবাসী শ্রমিকরা তাদের আন্তরিকতা, শিষ্টাচার এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ওমানের চাকরিদাতাদের মাঝে নিজেদের ভালো ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন। চাকরিদাতা হিসেবে দ্রুততার সাথে আরবদের বেছে নেওয়ার প্রবণতা এবং যেকোনো কাজে নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধির সক্ষমতা তাদেরকে ওমানিদের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছে। দূতাবাসের নিয়মিত তৎপরতা সালতানাতের প্রত্যন্ত অঞ্চলের চাকরিদাতাদেরও বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়ার বিষয়ে উৎসাহিত করছে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে