Views Bangladesh Logo

মালয়েশিয়া শ্রমবাজার: আবার সক্রিয় দাতো আমিন

Kamrul  Hasan

কামরুল হাসান

মালয়েশিয়া শ্রমবাজারে সিন্ডিকেট করে হাজার কোটি টাকা লোপাটকারী চক্রের মূল হোতা দাতো শ্রী আমিন নামে পরিচিত বাংলাদেশি আমিনুল ইসলাম বিন আব্দুল নূর নতুন করে সিন্ডিকেট গড়তে আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আর তাকে সহযোগিতা করতে আওয়ামী লীগ শাসন আমলে সিন্ডিকেটে থাকা রিক্রুটিং এজেন্সি এবং নেতারা দেশের বাইরে থেকেই সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন বলেও দাবি করছেন এদেশের বেশ কিছু রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক।

এই সিন্ডিকেট যেন আর গড়ে উঠতে না পারে এবং ন্যায্য মূল্যে শ্রমিকরা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে পারে সেই লক্ষ্যে সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেছেন বায়রার প্রায় ৫০০ সদস্য এবং সাবেক নেতৃস্থানীয় রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরা। তারা বলছেন এ নিয়ে আসন্ন JWG (Join Working Group) - মিটিংয়ে দুই দেশের মধ্যে সম্পন্ন হওয়া পূর্বের সমঝোতা স্মারকের সংশোধন এবং পরিবর্তন সাধনের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি পর্যায়ে কী কী পরিবর্তন এনে মালয়েশিয়া শ্রমবাজারে অন্তর্ভুক্তিতে শ্রমিকের ব্যয় কমানো যায় তার প্রস্তাবনাও দেয়া হয়েছে।

যোগাযোগ করা হলে, বায়রার সদ্য সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট রিয়াজ উল ইসলাম ভিউজ বাংলাদেশকে জানান, ‘আমরা যে প্রস্তাবনা দিয়েছি তা মানলে এবং সে মোতাবেক কাজ করলে সর্বমোট ১,৫০,০০০ টাকার মধ্যে মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণ করা সম্ভব এবং সব এজেন্সি তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী কর্মী পাঠাতে পারবে। এতে কেউ বৈষম্যেরও শিকার হবে না।’

তিনি অভিযোগ করেন, ‘বাংলাদেশিদের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার মাত্র দুইজন ব্যক্তির হাতে জিম্মি ছিল। একজন দাতো শ্রী আমিন এবং রুহুল আমিন স্বপন। আমিন মালয়েশিয়ায় আর রুহুল এদেশে সিন্ডিকেট চালাতো। আর রুহুলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন আওয়ামী সরকারের উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান।’

বায়রার সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট রিয়াজের অভিযোগ, আওয়ামী সরকারের অর্থমন্ত্রী লোটাস কামাল, সাবেক এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারী, লে. জেনারেল মাসুদ, বেনজীর আহমেদ, ঢাকা জেলা যুবলীগ (উত্তর) সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাশার, আওয়ামী লীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি মহিউদ্দিন মহি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা আলাউদ্দিন চৌধুরী নাসিম, বায়রার সাবেক ইসি সদস্য কাজী মফিজুর রহমান, আওয়ামী লীগ শ্রম ও কর্মসংস্থান বিষয়ক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সচিব আলী হায়দার চৌধুরীসহ অনেকেই এসবের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

বায়রা সদস্য খন্দকার আবু আশফাক বলেন, ‘এই সিন্ডিকেটের ফলে প্রত্যেক কর্মীকে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা দিয়ে মালয়েশিয়া যেতে হয়েছিল। দুই দফায় মালয়েশিয়া প্রেরিত প্রায় ৮ লাখ কর্মী থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা চাঁদা আদায় করেছিল এই সিন্ডিকেট। এছাড়া দুই দফায় প্রায় ২৫ লাখ যাত্রীর মেডিকেল স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছিল যা থেকে তারা প্রতি কর্মী বাবদ ৩,০০০ টাকা করে মোট ৭৫০ কোটি টাকা আদায় করেছিল।’

তারা অভিযোগ করেন, কর্মী প্রতি ৫ হাজার রিঙ্গিত সমপরিমাণ টাকা পেতেন দাতো আমিন এবং মালয়েশিয়া সরকারকে দেয়ার পর বাকি টাকা আওয়ামী লীগ সরকারের এই মন্ত্রী, এমপি ও নেতারা ভাগ করে নিতেন।

বায়রার সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে জনশক্তি রপ্তানির প্রত্যেকটি লাইসেন্স পেতে কমপক্ষে পাঁচ কোটি টাকা দিতে হতো। নানা প্রক্রিয়া শেষে এখন আবার মালয়েশিয়া বাজার খুলতে যাচ্ছে। এই সময়ে দাতো আমিন আবার সক্রিয় হয়েছেন। বিভিন্ন সদস্যের কাছ থেকে আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে এবার দাতো আমিন ১৪ কোটি টাকা নিচ্ছেন সিন্ডিকেট সদস্য হবার জন্য। পথ তৈরি করা হচ্ছে রিক্রুটিং এজেন্সিদের মধ্যে বৈষম্যেরও।’

শেখ হাসিনার আমলে গঠিত সিন্ডিকেট কোনোভাবেই বর্তমান সরকারের আমলে পুনঃগঠিত হতে পারে না- বলে জানান তিনি।

সিন্ডিকেট গঠনের ইতিহাস

বায়রার বিভিন্ন সূত্র বলছে দাতো আমিনের মালয়েশিয়ান আইটি ফার্ম বেস্টিনেট (BESTINET), এর FWCMS (Foreign Worker Central Management System) মাধ্যমেই মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে শুধুমাত্র বিদেশ থেকে কর্মী আনার অনলাইন সাপোর্টের জন্য চুক্তি হয়।
কিন্তু আমিন দুই দেশের সরকারের অসাধু কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ীদের এবং বায়রার সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন স্বপনকে অংশীদার হিসেবে নিয়ে এই ব্যবস্থাপনার অপব্যবহার করে কর্মী পাঠানোর সব প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেন এবং জনশক্তি রপ্তানির সিন্ডিকেট পরিচালনা করেন।

বায়রার শীর্ষ নেতারা বলছেন এই অনলাইন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই মালয়েশিয়া আরও ১৪টি দেশ থেকে কর্মী নিলেও বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনো দেশে কোনো প্রকার লাইসেন্সের লিমিটেশন ও অতিরিক্ত কোনো খরচ নেই এবং কোনো প্রকার সিন্ডিকেটও করতে পারেনি।

দুই দেশের সরকারের উদাসীনতার সুযোগ নিয়ে সরকারের কাছে রিক্রুটিং এজেন্সির ভুল তথ্য দিয়ে তারা বারবার এই সিন্ডিকেট তৈরি করছে বলেও অভিযোগ করছেন তারা।

এরই ধারাবাহিকতায় তারা বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও সুপরিকল্পিতভাবে দুদেশের মধ্যে স্বাক্ষর হওয়া সমঝোতা স্মারকের ২৮নং পৃষ্ঠায় বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সি মালয়েশিয়া সরকারকে সিলেকশন করার দায়িত্ব প্রদানের মধ্য দিয়ে অতিরিক্ত ১,৫২,০০০ টাকা খরচ এবং সিন্ডিকেটের বীজ বপন করে যা ১৪টি কর্মী প্রেরণকারী দেশের সমঝোতায় নেই।

আর এই সমঝোতাকে ব্যবহার করেই দেশীয় রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সঙ্গে বারবার বৈষম্য করা হচ্ছে এবং মালয়েশিয়া যাওয়া শ্রমিকদের খরচও বেড়ে যাচ্ছে অস্বাভাবিক হারে।

বিকল্প প্রস্তাব

বায়রার সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘এই সিন্ডিকেটের হোতাদের নাম জমা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিকল্প প্রস্তাবও জমা দিয়েছি আমরা। এই স্মারকলিপিতে ৪৫৩ রিক্রুটিং এজেন্সি স্বাক্ষর করেছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা চাই মধ্যস্বত্বভোগীদের বাদ দিয়ে সরকারিভাবে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিমেট) এর তত্ত্বাবধানে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু কর্মীদের ডাটা ব্যাংক তৈরি করবে। এই ডাটা ব্যাংক থেকেই রিক্রুটিং এজেন্সি কর্মী সংগ্রহ করে সরকার নির্ধারিত খরচ ব্যাংকের মাধ্যমে বিমেট এর তত্ত্বাবধানে সরাসরি প্রেরণ করবে। সুতরাং রিক্রুটিং এজেন্সি ইচ্ছে করলেও কর্মী থেকে বেশি টাকা নিতে পারবে না। ফলে সর্বমোট ১,৫০,০০০ টাকার মধ্যে কর্মী প্রেরণ করা সম্ভব হবে এবং সব এজেন্সি তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী কর্মী পাঠাতে পারবে।

এদিকে মালয়েশিয়া সরকার যদি একান্তই লাইসেন্স লিমিটেশন করতে চায় তাহলে শুধুমাত্র একটি সরকারি এজেন্সি যেমন বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লি. (বোয়েসেল) কে প্রধান এজেন্ট বিবেচনা করে ইচ্ছুক সব বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি সরকার নির্ধারিত খরচে মালয়েশিয়া কর্মী প্রেরণ করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এখানে উল্লেখ্য যে, এই ব্যবস্থা আগেও চালু ছিল।

এছাড়া জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের পরবর্তী মিটিং এ মাসে মালয়েশিয়ার পুত্রজায়াতে হতে যাচ্ছে। যেখানে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১২ লাখ কর্মী নেয়ার পথ খুলবে বলে আশা করছে উভয়পক্ষ। এ অবস্থায় পূর্বের পরিস্থিতি যেন না উদ্রেক হয় তাই বায়রা চায় এই মিটিংয়ে পূর্বের সমঝোতা স্মারকের পৃষ্ঠা নং-২৮ এর (C)-এর (v) এবং (vi) ধারা বাদ দিয়ে বা পরিবর্তন করে সিন্ডিকেট বন্ধে এই সরকার পদক্ষেপ নিবে। যাতে অন্যান্য ১৪টি সোর্সিং দেশের ন্যায় মালয়েশিয়ান সরকারের পরিবর্তে, মালয়েশিয়ান নিয়োগকর্তা বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী নিতে পারে।

এসব ব্যবস্থা নিতে পারলেই শুধু স্বল্প ব্যয়ে অথবা RBA (Responsible Business Allience)-এর সদস্য কোম্পানিগুলোতে বিনা খরচে কর্মী প্রেরণ করা যাবে মতামত দেন বায়রার সাবেক এই যুগ্ম মহাসচিব।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ