২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট
অগ্রাধিকারের শীর্ষে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ বিনির্মাণ
দেশে মেগা শিল্পের বিকাশ এবং আমদানি বিকল্প শিল্প উৎপাদন বিনির্মাণে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠায় সরকার বদ্ধপরিকর। আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে আমদানি করা বিলাসবহুল পণ্যের দাম আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তাই আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকর হতে যাওয়া নতুন বাজেটে মন খারাপ হতে পারে এসব পণ্যের ভোক্তাদের। তবে একই পণ্যের দেশীয় উদ্যোক্তারা স্বস্তির ঢেকুর গিলতে পারেন। দেশীয় শিল্পকে এগিয়ে নিতে ও সুরক্ষা দিতে নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
বর্তমানে পণ্য আমদানিতে শুল্ক, অগ্রিম আয়কর, মূল্য সংযোজন কর, সম্পূরক শুল্ক ও নিয়ন্ত্রক শুল্ক আরোপ করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, বাজেটে আমদানির ক্ষেত্রে এই হার বাড়ানোর কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে অবশ্যই আগামী অর্থবছরে বিলাসবহুল পণ্যের আমদানির ওপর আগের তুলনায় বেশি শুল্ক আরোপ করা হবে। এই নীতি নিয়ে এখন কাজ চলছে বলে জানান তারা।
সূত্র জানায়, ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ পরিকল্পনার ওপর জোর দিয়ে উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত থাকা তালিকাভুক্ত ও অ-তালিকাভুক্ত; উভয় ধরনের প্রতিষ্ঠানের জন্য করপোরেট করের হার ২ দশমিক ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে এই হার ১৭ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসার কথা রয়েছে। তালিকাভুক্ত নয়, এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য করপোরেট করের হার ২৫ শতাংশে নেমে আসবে। তবে ব্যাংক ও মোবাইল অপারেটরদের ক্ষেত্রে করপোরেট করের হার অপরিবর্তিত থাকবে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এই উদ্যোগের ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য উৎসাহিত হবে।
তবে সংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করেন, কেন তালিকাভুক্ত এবং অ-তালিকাভুক্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে পার্থক্য থাকা দরকার। যদি করপোরেট খাত বিকশিত হয়। তবে এটি অর্থনীতির জন্য ভালো, কারণ এটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। কিন্তু এই উদ্যোগকে সঠিক বলে মনে করেন তারা। কারণ বাংলাদেশে করপোরেট করের হার দক্ষিণ এশীয় গড়ের চেয়ে বেশি।
সরকার পোল্ট্রি ও মৎস্য শিল্পের কর ছাড় প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিয়েও কাজ করছে। কর ছাড়ের উদ্দেশ্য হলো দেশীয় শিল্পকে আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠতে সহায়তা করা। এনবিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, হাঁস-মুরগি ও মাছ আমদানি হয় না। তাই বিদেশি উৎপাদকদের সঙ্গে কোনো প্রতিযোগিতা নেই। এই দুটি খাতের জন্য কর ছাড়ের কোনো প্রয়োজন নেই বলে মত তার। বরং কর ছাড় প্রত্যাহার করা হলে স্থানীয় শিল্পগুলো নিজেদের মানের উন্নয়ন ঘটাতে বাধ্য হবে।
এই কর্মকর্তার মতে, পোল্ট্রি ও মৎস্য খাতে অসংখ্য সংখ্যক ছোট উৎপাদক রয়েছে, যারা করের আওতার বাইরে রয়েছে। বলতে পারেন এই খাতগুলোতে পারফেক্ট কম্পিটিশন রয়েছে, যেমনটি অর্থনীতিতে বলা হয়। কর কর্মকর্তারা এখনও তাদের কাছে পৌঁছাতে পারেননি। ফলে কর ছাড় সেবা বন্ধ করে দিলেও তাদের ওপর তেমন একটি প্রভাব পড়বে না। এর ভালো দিক হলো, কর ফাঁকি দেয়ার অসংখ্য উপায়ের মধ্যে একটি বন্ধ হলো।
অর্থনীতিতে পারফেক্ট কম্পিটিশন হলো-একটি নির্দিষ্ট মূল্যে সমজাতীয় পণ্য সরবরাহ করার ইচ্ছা ও ক্ষমতাসহ বিপুল সংখ্যক উৎপাদকের অস্তিত্ব থাকা। ফলে কেউ ব্যক্তিগত পর্যায়ে পণ্যের দামকে তেমন একটা প্রভাবিত করতে পারে না।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, বিলাসবহুল পণ্যের আলাদাভাবে কোন সংখ্যা নেই। আগে একটা সময়ে এসি, ফ্রিজ ও গাড়ি বিলাসবহুল পণ্যের কাতারে থাকলেও বর্তমানে এসব পণ্যকে মানুষজন নিত্যপ্রয়োজনীয় হিসেবেই দেখছে। তারপরও বিদেশি এসি আমদানিতে শুল্কহার আগের চেয়েও বাড়ানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তুলনামূলক একই দামে বিদেশি একটি কোম্পানির এসি পেলে কেউ দেশীয় প্রতিষ্ঠানের এসি কিনতে উৎসাহিত হবে না। এর মূল উদ্দেশ্য দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেয়া। তারপর যার যেটা ইচ্ছা সেটা কিনবে। যে পণ্যের শুল্কহার যত বেশি, সেটা তত বিলাসবহুল পণ্য।
তিনি আরও বলেন, কিছু পণ্যের অগ্রিম আয়কর (এআইটি) বাড়ানো হতে পারে। অথবা সব ধরনের সম্পূরক শুল্ক ও হার বাড়ানো হতে পারে। এনবিআরের হাতে এখনও সময় আছে। তবে গাড়ি, ফ্রিজ ও এসির মতো পণ্যের দামও নিঃসন্দেহে বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।
অন্যদিকে আমদানি কমলে দেশের রিজার্ভের পরিস্থিতি সন্তোষজনক অবস্থায় দাঁড়াবে বলে মনে করেন খাত সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪ সালের ২০ মার্চ দেশের রিজার্ভ ছিল ২৫ দশমিক ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর এক বছর আগে এই রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩১ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারীর পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে ডলারের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। তাই বেশ অনেকদিন ধরেই আমদানিতে লাগাম টানার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। এবারের বাজেটে এই কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে বলে জানা গেছে।
একইসঙ্গে এই উদ্যোগে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ এজেন্ডা আরও উৎসাহিত হবে। দেশীয় বিভিন্ন পণ্য উৎপাদকেরা তাদের পণ্যের গুণগত মান আরও উন্নত করতে উৎসাহিত হবেন। এর ফলে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে এবং কিছু কিছু পণ্য আমদানির প্রয়োজন হবে। এতে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত হবে দেশীয় শিল্প। সেই সঙ্গে ডলার সাশ্রয়ের ব্যাপার তো আছেই।
সম্প্রতি প্রাক-বাজেট আলোচনায় এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ডকে শক্তিশালী করার কথা জানিয়েছিলেন। এলডিসি থেকে বের হওয়ার পরের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমদানি কমিয়ে রপ্তানি বাড়ানোর পরামর্শ তার।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে