বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিককরণ এবং বাস্তবতা
ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড (আইএমএফ) গত ৩০ এপ্রিল এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর অর্থনীতির আঞ্চলিক পূর্বাভাস বা রিজিওনাল ইকোনমিক আউটলুক প্রকাশ উপলক্ষে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের জন্য নমনীয় মুদ্রা বিনিময় হার চালুর পরামর্শ দিয়েছে। সংস্থাটি গত প্রায় দেড় বছর ধরে মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার জন্য পরামর্শ দিয়ে আসছে। তারা বলছে, বাংলাদেশ যদি বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার চালু করে, তাহলে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বৃদ্ধিসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি সাধিত হবে। আইএমএফের এশিয়া-প্যাসিফিক বিভাগের পরিচালক কৃষ্ণা শ্রীবাসন বলেন, চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ ৯ মাসে বাংলাদেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার। একই সময়ে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি ছিল ৮৩০ কোটি মার্কিন ডলার।
এ ঘাটতির পরিমাণ আগের বছরের তুল্য সময়ের চেয়ে প্রায় চারগুণ বেশি। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ যদি মুদ্রার বিনিময় হার নমনীয় বা বাজারভিত্তিক করে তাহলে আর্থিক হিসাব ভালো হবার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফল পেতে পারে। একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা অনেকটাই উত্তরণ ঘটানো সম্ভব হবে। আইএমএফের এশিয়া-প্যাসিফিক বিভাগের পরিচালক কৃষ্ণা শ্রীবাসনের এই সুস্পষ্ট বক্তব্যের বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। অনেক দিন ধরেই বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার জন্য দেশের কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। আইএমএফ এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের পরিচালকের বক্তব্যের পর তাদের সেই পরামর্শ আরও জোরালো হয়ে উঠেছে।
আইএমএফ বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নমনীয় বা বাজারভিত্তিক করার যে পরামর্শ দিয়েছে, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে। কেন তারা এ মুহূর্তে এমন একটি পরামর্শ দিল, তা খাতিয়ে দেখা প্রয়োজন। আইএমএফ বাংলাদেশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে। সেই ঋণের প্রথম এবং দ্বিতীয় কিস্তি ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের অনুকূলে ছাড়করণ করা হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই ঋণের তৃতীয় কিস্তি ছাড়করণ করা হবে। এমন সময় এ ধরনের পরামর্শ নানা কারণেই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশ যদি সংস্থাটির পরামর্শ উপেক্ষা করে, তাহলে ঋণের আগামী কিস্তি পেতে সমস্যা হতে পারে। বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে যে ঋণ গ্রহণ করেছে, তা বাজেট ঘাটতি মেটানোর পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের স্ফীতি বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে বলে আশা করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, আইএমএফের ঋণ সব সময়ই শর্তাধীনে দেয়া হয়।
হয়তো দেশ ভেদে এই শর্তের অধিকতর নমনীয় বা কঠোর হয়ে থাকে। তবে কোনো ঋণই তারা শর্তহীনভাবে প্রদান করে না। বাংলাদেশের অনুকূলে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ অনুমোদনের পর তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, বাংলাদেশ যেভাবে ঋণ চেয়েছে সংস্থাটি ঠিক সেভাবেই ঋণ অনুমোদন করেছে। সাবেক অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্য মোটেও সত্যি ছিল না। কারণ বাংলাদেশ নিশ্চয়ই শর্তযুক্ত ঋণ চায়নি। আইএমএফের দেয়া শর্ত মেনেই বাংলাদেশ ঋণ পেয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সংরক্ষণ পদ্ধতি নিট পদ্ধতিতে করা, ব্যাংকিং খাতে শুরু হওয়া সংস্কার এসবই আইএমএফের ঋণের শর্ত হিসেবেই করা হচ্ছে। কাজেই সাবেক অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই।
বাংলাদেশ যদি এ মুহূর্তে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নমনীয় বা বাজারভিত্তিক করে, তাহলে ভালো এবং মন্দ উভয় ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে মুদ্রা বিনিময় হার থেকে শুরু করে কোনো কিছুই সরকারি নিয়ন্ত্রণে নির্ধারিত হবার কথা নয়। সরকার শুধু সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে। কোনো কারণে যদি মুক্তবাজার অর্থনীতি সঠিকভাবে কাজ না করে অথবা কোনো জটিলতা সৃষ্টি হয় শুধু তখনই সরকার সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারবে। ১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশ মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুসরণ করে আসছে; কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাজারকে স্বাধীনভাবে চলতে দেয়া হয়নি। ফলে বাজার ব্যবস্থা কোনো কোনো ক্ষেত্রে উল্টো ফল দিয়েছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির সূত্র মোতাবেক, যে কোনো পণ্য বা সেবার বিনিময় হার বা মূল্য নির্ধারিত হবে বাজারে পণ্যটির উপস্থিতি বা জোগান এবং ভোক্তার চাহিদার ওপর ভিত্তি করে।
বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণের ক্ষেত্রেও বিষয়টি প্রযোজ্য; কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক কখনোই বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারকে মুক্তভাবে নির্ধারিত হবার সুযোগ দেয়নি। কোনো সময় বাজারে মার্কিন ডলারের উপস্থিতি বা জোগান কমে গিয়ে স্থানীয় মুদ্রা টাকার অবমূল্যায়নের আশঙ্কা সৃষ্টি হলে বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থেকে কিছু ডলার বাজারে ছেড়ে দিয়ে সংকট উত্তরণের চেষ্টা করেছে। আবার কখনো যদি মার্কিন ডলারের জোগান বৃদ্ধি পেতো তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে মার্কিন ডলার ক্রয় করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করত; কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের স্ফীতি দ্রুত কমে যাবার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন চাইলেও বাজার থেকে মার্কিন ডলার ক্রয়-বিক্রয় করে মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নমনীয় বা বাজারভিত্তিক করা হলে যেমন কিছু সুবিধা পাওয়া যাবে, তেমনি কিছু সমস্যা সৃষ্টিরও আশঙ্কা রয়েছে। তাই এ ব্যাপারে সুচিন্তিত পদক্ষেপ গ্রহণ করাই বাঞ্ছনীয়।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হলে সব সময়ই কিছু সুবিধা পাওয়া যায়। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হলে বাজারে মুদ্রার অতিরিক্ত চাহিদা এবং জোগানের বিষয়টি ঘটে না। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ করে রাখা হলে কোনো কোনো মহল এতে লাভবান হতে পারে। যেমন, যারা পণ্য আমদানি করে থাকেন, তারা লাভবান হবেন। কারণ বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ করে রাখা হলে তারা তুলনামূলক কম স্থানীয় মুদ্রা ব্যয়ে বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয় করে কাঙ্ক্ষিত পণ্য ও সেবা আমদানি করতে পারবেন। কম স্থানীয মুদ্রা ব্যবহার করে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করা গেলে ভোক্তারা তুলনামূলক কমমূল্যে পণ্য পেতে পারবেন। শিল্প এবং উৎপাদনশীল খাত তুলনামূলক কম মূল্যে কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি করতে পারবেন। এতে উৎপাদন ব্যয় তুলনামূলক কম হবে; কিন্তু বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই ঘটনা ঘটছে না। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারিত করে রাখার পরও আমদানিকৃত পণ্যেও মূল্য কমছে না। ভোক্তারা তুলনামূলক কম মূল্যে আমদানিকৃত পণ্য বেশি মূল্যে ক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছেন। এখানে আরও একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো, আর তাহলো বাংলাদেশ তার চাহিদাকৃত এবং ব্যবহারযোগ্য পণ্যের ২৫ শতাংশের মতো আমদানির মাধ্যমে মিটিয়ে থাকে।
অবশিষ্ট ৭৫ শতাংশ পণ্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করে থাকে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বৃদ্ধির কারণে ২৫ শতাংশ পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলেও তো অবশিষ্ট ৭৫ শতাংশ পণ্য সহনীয় মূল্যে পাবার কথা; কিন্তু বাস্তবে তা কি আমরা পাচ্ছি? বাংলাদেশ ব্যাংক মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করে রাখলেও আমদানিকারকদের চাহিদা মতো মার্কিন ডলার সরবরাহ করতে পারছে না। ফলে আমদানিকারকরা কার্ব মার্কেট থেকে মার্কিন ডলার উচ্চ বিনিময় হারে সংগ্রহ করে বিভিন্ন পণ্য আমদানি করছেন। ফলে তারা ইচ্ছা করলেও আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে পারছেন না। বাংলাদেশ ব্যাংক মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করে রাখবে অথচ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহারকারীদের চাহিদামতো মুদ্রা সরবরাহ বা জোগান দিতে পারবে না এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারিত করে রাখার বাংলাদেশ ব্যাংকের এই উদ্যোগ সফল হতো তখনই, যখন পর্যাপ্ত পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার জোগান নিশ্চিত করা যেত। ‘প্রয়োজন মানে না রীতি’ এই প্রবাদের মতোই আমদানিকারক বা বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহারকারীরা কার্ব মার্কেট বা অনানুষ্ঠানিক খাত থেকে উচ্চমূল্যে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে তাদের প্রয়োজন মেটাচ্ছে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্যমূল্য স্ফীতির ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের চেয়ে অন্য ফ্যাক্টর বেশি কাজ করে থাকে। বাজারে তৎপর রাজনৈতিক প্রভাবিত সিন্ডিকেট এবং সর্বস্তরে চাঁদাবাজ-দুর্নীতিবাজদের প্রতিকারহীন তৎপরতা পণ্যমূল্যকে যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। তৃণমূল পর্যায়ে যে কৃষক বা উৎপাদক পণ্য ও সেবা উৎপাদন করছেন, তারা কিন্তু ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। যে আলু কৃষক ১৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে বাধ্য হন রাজধানীতে বসে আমরা সেই আলু ৬০ টাকা বা ৭০ টাকা কেজি মূল্যে ক্রয় করতে বাধ্য হই। কৃষক সংগঠিত নন এবং সামর্থ্য এবং সুযোগের অভাবে তারা উৎপাদিত পচনশীল পণ্য দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করতে পারেন না। তারা অনেকটা বাধ্য হয়ে উৎপাদিত পণ্য তুলনামূলক কম মূল্যে তাৎক্ষণিকভাবে মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন।
মধ্যস্বত্বভোগী যখন সেই পণ্য শহরে নিয়ে আসেন তখন পথে পথে তাদের মাস্তানদের চাঁদা দিতে হয়। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে এসে পৌঁছুতে পণ্যের ব্যয় অনেকগুণ বৃদ্ধি পায়। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কৃষক বা তৃণমূল পর্যায়ের একজন উৎপাদক পণ্য উৎপাদন করেন; কিন্তু তার মুনাফা ভোগ করেন মধ্যস্বত্বভোগী ও চাঁদাবাজরা। স্থানীয় দুষ্কৃতকারী এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কিছু দুর্নীতিবাজ সদস্য মিলে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। তাদের চোখ এড়িয়ে কারও পক্ষে পণ্য ভোক্তা পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব হয় না। সরকার যদি স্থানীয় বা তৃণমূল পর্যায়ের উৎপাদকদের কাছ থেকে পণ্য সরাসরি ক্রয় করে শহরে এনে বিক্রির ব্যবস্থা করতে পারতেন, তাহলে মধ্যস্বত্বভোগী এবং চাঁদাবাজদের তৎপরতা অনেকটাই বন্ধ হয়ে যেত। উৎপাদন তার পণ্যের সঠিক মূল্য পেতেন। পাশাপাশি ভোক্তারাও তুলনামূলক কম মূল্যে পণ্য ক্রয় করতে পারতেন। যারা ঢালাওভাবে বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হলে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাবে এবং মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে তাদের সেই যুক্তি প্রশ্নাতীতভাবে মেনে নেয়া যায় না। বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণেই মূলত পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেখানে আমদানি পণ্যের ভূমিকা খুব একটা বেশি নয়।
বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার পরিবর্তে নির্ধারিত করে রাখায় অর্থনীতি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারিত থাকার কারণে পণ্য রপ্তানিকারকরা তাদের রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্য বাবদ যে বৈদেশিক মুদ্রা পাচ্ছেন, তা দেশে আনার ক্ষেত্রে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। অনেকেই তাদের উপার্জিত অর্থ বিদেশেই রেখে দিচ্ছেন। মনে করছেন, স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটলে তারা উপার্জিত অর্থ দেশে নিয়ে আসবেন। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে পণ্য ও সেবা রপ্তানি বৃদ্ধি পেলেও বিদেশ থেকে অর্থ আসা কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) পণ্য রপ্তানি বাবদ ৯৯০ কোটি মার্কিন ডলার দেশে এলেও দ্বিতীয় প্রান্তিক অর্থাৎ অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে ৯০৭ কোটি মার্কিন ডলার দেশে এসেছে। যদিও প্রথম প্রান্তিকের চেয়ে দ্বিতীয় প্রান্তিকে পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ১৮ কোটি মার্কিন ডলার।
চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ মাসে পণ্য রপ্তানি বাবদ আয় হয়েছে ২ হাজার ৭৫৪ কোটি মার্কিন ডলার; কিন্তু একই সময়ে রপ্তানি আয় দেশে এসেছে ১ হাজার ৮৯৭ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে মোট ৩ হাজার ৮৭৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করা হলেও রপ্তানি আয় দেশে এসেছে ৩ হাজার ৩৯৭ কোটি মার্কিন ডলার। পরবর্তী বছর রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পেয়ে ৫ হাজার ২০৮ কোটি মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়; কিন্তু দেশে এসেছে ৪ হাজার ৩৬০ কোটি মার্কিন ডলার। গত অর্থবছরে মোট ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করা হলেও দেশে এসেছে ৪ হাজার ৩৮৭ কোটি মার্কিন ডলার। রপ্তানিকারকরা নানা কারণেই তাদের উপার্জিত রপ্তানি আয়ের পুরোটা দেশে আনছেন না। যদি বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক হতো তাহলে তারা স্থানীয় মুদ্রায় বেশি অর্থ পাবার আশায় অর্জিত রপ্তানি আয় দেশে আনার ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ হতেন।
এই কথা প্রযোজ্য প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত রেমিট্যান্স অর্থ দেশে আসার ব্যাপারে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, গত বছর (২০২৩) প্রবাসী বাংলাদেশিরা মোট ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স দেশে প্রেরণ করেছে। রেমিট্যান্স প্রেরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সপ্তম অবস্থানে ছিল। এটা প্রেরিত রেমিট্যান্সের পুরোটা নয়। গত বছর বাংলাদেশ থেকে রেকর্ডসংখ্যক ১৩ লাখ নতুন শ্রমিক বিদেশে গিয়েছেন কর্মসংস্থান উপলক্ষে। মধ্যপ্রাচ্যে করোনা-উত্তর পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ফলে সেখানে প্রচুর শ্রমিকের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। আগে থেকে বিদেশে অবস্থানরত এবং নতুন করে বিদেশগামী কর্মীরা যে অর্থ দেশে প্রেরণ করেছে, তার পরিমাণ আরও অনেক বেশি হওয়াটাই যৌক্তিক। অনেকেই মনে করেন, বৈধপথে যে রেমিট্যান্স দেশে আসছে, তার সমপরিমাণ অথবা বেশি অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে দেশে আসছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রেরণের ক্ষেত্রে বেশ কিছু জটিলতা আছে। যে শ্রমিক কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, তার পক্ষে প্রতি মাসে একবার কাজ ফেলে ব্যাংকে গিয়ে রেমিট্যান্স দেশে প্রেরণ করা কঠিন। আবার স্থানীয় বেনিফিশিয়ারিদের পক্ষেও সব সময় ব্যাংকে গিয়ে রেমিট্যান্স উত্তোলন করা সম্ভব হয় না; কিন্তু হুন্ডি ক্ষেত্রে এসব ঝামেলা নেই। হুন্ডি ব্যবসায়ীরা প্রবাসী বাংলাদেশিদের আবাসন স্থলে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে নেন। বিনিময়ে দেশে এজেন্টদের মাধ্যমে প্রবাসীর পরিবারের কাছে অর্থ পৌঁছে দেন। বাংলাদেশ ব্যাংক বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রেরণে উৎসাহিত করার জন্য প্রেরিত অর্থের ওপর ৫ শতাংশ নগদ আর্থিক প্রণোদনা দিচ্ছে; কিন্তু কার্ব মার্কেটে প্রতি মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে অন্তত ১৫ টাকা বেশি। তাহলে প্রবাসীরা কেন বৈধ চ্যানেলে দেশে অর্থ প্রেরণ করবেন?
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান দুটি সূত্র হচ্ছে পণ্য রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্স। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ করে রাখা এবং কার্ব মার্কেটে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বেশি হবার কারণে তারা হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ দেশে প্রেরণের ক্ষেত্রে আগ্রহী হচ্ছেন। ব্যাংকিং চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ করে রাখার ফলে কীভাবে মুদ্রার বিনিময় হার প্রভাবিত হচ্ছে, তা একটি উদাহরণের মাধ্যমে বোঝানো যেতে পারে। মনে করি, একজন রপ্তানিকারক অথবা প্রবাসী বাংলাদেশি তার উপার্জিত অর্থ দেশে প্রেরণ করবেন। তিনি যদি এই অর্থ বৈধ চ্যানেলে অর্থাৎ ব্যাংকের মাধ্যমে প্রেরণ করেন তাহলে প্রতি মার্কিন ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি মুদ্রায় হয়তো ১১০ টাকা পাবেন; কিন্তু সেই একই মার্কিন ডলার যদি হুন্ডির মাধ্যমে দেশে প্রেরণ করেন তাহলে তাকে প্রতি মার্কিন ডলারের বিপরীতে ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা দেয়া হবে। কে আছেন এই লোভনীয় সুযোগ হারাবার? সরকার যদি হুন্ডি ব্যবসা বন্ধ করতে পারত, তাহলে প্রবাসী বাংলাদেশি এবং পণ্য রপ্তানিকারকরা তাদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে আনত; কিন্তু ‘বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছুটা অসুবিধা হলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা দেশের অর্থনীতির জন্য সুফল বয়ে আনবে। তাই কিছুটা ধীরে ধীরে হলেও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। এতে রিজার্ভের স্ফীতি বৃদ্ধিসহ অনেক ক্ষেত্রেই সুবিধা পাওয়া যাবে।
এম এ খালেক: অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে