মতিয়া চৌধুরী জনসেবাকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন
অগ্নিকন্যা খ্যাত মতিয়া চৌধুরীর মহাপ্রয়াণ মানেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন। দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে মতিয়া চৌধুরী দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রেখে গেছেন। অর্থ-বিত্তের প্রতি একান্তই নির্মোহ মতিয়া চৌধুরী ব্যক্তিজীবনে ছিলেন অত্যন্ত সৎ ও আদর্শের প্রতীক। তিনি তিনবার কৃষিমন্ত্রীসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন; কিন্তু তার বিরুদ্ধে কখনোই দুর্নীতি বা স্বজনপ্রীতির কোনো অভিযোগ ওঠেনি। মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বেগম মতিয়া চৌধুরী অত্যন্ত সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন। কোনো বিলাসিতা তার মাঝে প্রত্যক্ষ করা যায়নি।
মহীয়সী রাজনীতিবিদ মতিয়া চৌধুরীর জীবন ও আদর্শ আগামীতে দেশের রাজনীতিবিদদের অনুপ্রাণিত করবে বলে আমার বিশ্বাস। আমার রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে আমি তার সাহচর্যে আসার সুযোগ পেয়েছিলাম।
মতিয়া চৌধুরী ছিলেন আত্মত্যাগী এক রাজনীতিবিদ। তিনি গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকেই আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় মতিয়া চৌধুরীর বলিষ্ঠ অবদানের কারণেই তাকে ‘অগ্নিকন্যা’ উপাধি দেয়া হয়েছিল। তিনি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে কারও রক্তচক্ষুকে ভয় পেতেন না। ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলন চলাকলে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তার মাঝে কখনোই অর্থবিত্ত গড়ে তোলার প্রবণতা প্রত্যক্ষ করিনি। তিনি সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। আমি একাধিক বার তার বাড়িতে গিয়েছি। তার বাড়িতে আসবাবপত্রের কোনো বাহুল্য ছিল না। একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের যে ধরনের আসবাবপত্র থাকে, তার বাড়িতেও তাই ছিল।
ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়। ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে যখন পিকিংপন্থি এবং মস্কোপন্থি দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়, তখন মতিয়া চৌধুরী মস্কোপন্থি ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্ব দিতে থাকেন। এ সময় ছাত্র ইউনিয়নের এক অংশকে মতিয়া গ্রুপ এবং অন্য অংশকে মেনন গ্রুপ হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো; কিন্তু পরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে চীনের নেতিবাচক ভূমিকার কারণে ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে মতান্তর দেখা দেয়। চীনাপন্থি ছাত্র ইউনিয়নের কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধকে ‘দুই কুকুরের লড়াই’ বলে আখ্যায়িত করে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেন। জনগণ কখনোই তাদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থানকে সুনজরে দেখেনি। তবে চীনাপন্থি ছাত্র ইউনিয়নের একটি অংশ আব্দুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে নরসিংদীর শিবপুরে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। তাদের বক্তব্য ছিল, তারা ভারতে যাবেন না। দেশের অভ্যন্তরে থেকেই মুক্তিযুদ্ধ করবেন। এরা সাধারণভাবে পিকিংপন্থি হলেও মুক্তিযুদ্ধকালীন তাদের পিকিংপন্থি বলা যাবে না। কারণ তারা চীনের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অবস্থানকে তখন সমর্থন করেননি।
আবার তারা যে ভারতে গিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধা দলে যোগ দেবেন তাও করেননি। তারা শিবপুরকে মুক্তিযুদ্ধের ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। তাদের মূল নেতা মান্নান ভূঁইয়া পরে বিএনপিতে যোগ দেন। অন্যদিকে রাশেদ খান মেনন ও রনো মওলানা ভাসানীকে নিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভিন্নভাবে কিছু একটা করার চেষ্টা করেছিলেন বলে শোনা যায়। তবে তাদের সেই প্রচেষ্টা সফল হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের মূলধারা হিসেবে প্রবাসী সরকারের মুক্তিযুদ্ধটাই টিকে থাকে। সেখানে মতিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বে ছাত্র ইউনিয়ন মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ এবং গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। পরে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের একটি পৃথক গেরিলা বাহিনী তৈরি করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন সেখানে সহায়তা করে। ভারত সরকারও এই বামপন্থি গেরিলাদের মেনে নেয়। যদিও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছিল তার সঙ্গে বামপন্থি মুক্তিযোদ্ধাদের টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। এই দ্বন্দ্ব কোনো কোনো সময় সংঘাতে পরিণত হতো।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মতিয়া চৌধুরী আগরতলার ক্র্যাফট হোস্টেলে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। আমি নিজেও সেখানে উপস্থিত ছিলাম। কাজেই মুক্তিযুদ্ধে বেগম মতিয়া চৌধুরীর অবদান নিজচক্ষে দেখার সুযোগ হয়েছিল। জ্ঞান চক্রবর্তীর নেতৃত্বে সেই ক্যাম্প পরিচালিত হতো। মতিয়া চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রুটি বানানো থেকে শুরু করে ক্যাম্পের সব কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতেন। মতিয়া চৌধুরীর স্বামী বজলুর রহমানও মুক্তিযুদ্ধের আগরতলায় ছিলেন। তারা যুক্তভাবেই কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পের মধ্যেই মতিয়া চৌধুরী-বজলুর রহমান দম্পতির বিবাহবার্ষিকী পালন করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা বাংলাদেশে ফিরে আসি। স্বাধীন বাংলাদেশে ন্যাপ আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা পালন করতে থাকে। এ সময় অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ ও মতিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বে ন্যাপ কার্যক্রম চলতে থাকে। সেই সময় সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ন্যাপের মনোনীত সংসদ সদস্য ছিলেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত অত্যন্ত অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান ছিলেন। তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী এনেছিলেন। সেই সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লার্মাকে বঙ্গবন্ধু যখন বাঙালি হয়ে যাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে তার তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। সেই সময় ন্যাপ মানবেন্দ্র নারায়ণ লার্মাকে সাপোর্ট দিয়েছিল।
যখন বাকশাল গঠিত হয়, তখন বেশ কিছু প্রগতিশীল কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। বিশেষ করে বাধ্যতামূলক সমবায় কার্যক্রম প্রতিষ্ঠা করা, বিকেন্দ্রীয়করণ এবং দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে জেহাদি অবস্থান গ্রহণের কথা বলা হয়েছিল। এসব কর্মসূচির ভিত্তিতে একটি জাতীয় দল গঠন করা হয়। যেখানে কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ এরা অন্তর্ভুক্ত হয়। মতিয়া চৌধুরীও তখন বাকশালের সদস্য পদ গ্রহণ করেন; কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হলে এ দলগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে বেড়িয়ে আসে। যেহেতু এই সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে মতিয়া চৌধুরীর সুসম্পর্ক তৈরি হয়, তাই তিনি পরে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। যদিও কিছুসময় আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে বাকশাল কার্যক্রম চলতে থাকে; কিন্তু সেটা খুব একটা ভালো করতে পারছিল না। জেলখানায় চার নেতা নিহত হলে আব্দুল মালেক উকিল, জোহরা তাজউদ্দীন প্রমুখ আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। সে সময় পর্যন্ত মতিয়া চৌধুরী সম্ভবত ন্যাপেই ছিলেন। পরে শেখ হাসিনা এসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করলে কোনো এক পর্যায়ে মতিয়া চৌধুরী আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। সেই সময় উদ্দেশ্য ছিল সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে কার্যকর ও শক্তিশালী গণআন্দোলন গড়ে তোলা।
প্রশ্ন হলো, ব্যক্তি হিসেবে মতিয়া চৌধুরী কেমন ছিলেন? তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগদান করলেও অর্থবিত্তের প্রতি তার কোনো মোহ ছিল না। কোনো ধরনের বিলাসিতা তার মধ্যে ছিল না। বিত্তবান রাজনৈতিক নেতাদের বাড়িতে যে ধরনের আসবাবপত্র থাকে তার কিছুই মতিয়া চৌধুরীর বাসায় ছিল না। আমি তার বাসায় গেলে মোড়াতেই বসতে হতো। মতিয়া চৌধুরীর কোনো সন্তান ছিল না। স্বামী বজলুর রহমানের মৃত্যুর পর তিনি অনেকটাই নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি খুব সাধারণ মানের খাবার খেতেন। তার একটি বিড়াল ছিল। বিড়ালকে নিয়েই তিনি থাকতেন এবং বিড়ালটিকে খুব আদর করতেন। মতিয়া চৌধুরীর মতো সৎ এবং দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদ আমাদের দেশে খুব একটা লক্ষ্য করা যায় না। তিনি চেষ্টা করলে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করতে পারতেন; কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি সব সময় দরিদ্র মানুষের কল্যাণ কামনা করেছেন। দরিদ্র মানুষের জন্য কাজ করেছেন।
মতিয়া চৌধুরী জনসেবাকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এবং তিনি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। মতিয়া চৌধুরী কৃষিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর কৃষি ও কৃষকের সমস্যা সমাধানে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছেন। তিনি যেহেতু গ্রাম এলাকার মানুষ ছিলেন। তাই গ্রামীণ কৃষকের সমস্যা সম্পর্কে ভালোভাবেই অবহিত ছিলেন। সেসব সমস্যা সমাধানে তিনি চেষ্টা করেছেন।
মতিয়া চৌধুরী কৃষিমন্ত্রী থাকাকালে কৃষি সংস্কার কমিশন গঠন করেছিলেন। কৃষি সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট আমি বাংলায় অনুবাদ করেছিলাম। সেই সময় আমি প্রত্যক্ষ করি, তিনি কতটা গভীরভাবে কৃষকের সমস্যা উপলব্ধি এবং সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন। বাংলাদেশ বর্তমানে খাদ্য উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। এই সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রে মতিয়া চৌধুরী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। তখন বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফের মতো উন্নয়ন সহযোগিরা কৃষি খাতে ভর্তুকি বন্ধ করার জন্য চাপ দিলেও তিনি সেই চাপের কাছে নতি স্বীকার করেননি। বাংলাদেশ সেদিনের সেই সিদ্ধান্তের সুফল এখন ভোগ করছে।
ড. এম এম আকাশ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অনুলিখন: এম এ খালেক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে