চিকিৎসা সরঞ্জাম শিল্পে বিপর্যয়ের শঙ্কা দেশি উৎপাদকদের
স্বাস্থ্যসেবা সংস্কারে কমিশন গঠন করলেও চিকিৎসা সরঞ্জাম শিল্প নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নীরবতায় হতাশ দেশি উৎপাদকরা। সরকারি প্রণোদনা, কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কছাড়সহ নীতিগত সহায়তা না পেলে এ খাতে চরম বিপর্যয়ের শঙ্কা তাদের। দুই দশকের প্রচেষ্টার পর ২০২২ সালে দেশি উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে চিকিৎসা সরঞ্জাম খাতকে উদীয়মান শিল্পের স্বীকৃতি দেয় সরকার। এতে শিল্পবান্ধব সহায়ক কর কাঠামোসহ অন্য সুবিধা পেতে আশাবাদী হয়েছিলেন দেশি উৎপাদকরা। তবে চলতি অর্থবছরের বাজেটে প্রয়োজনীয় এইচএস কোডগুলো বাদ এবং উন্নয়ন প্রণোদনা আটকে দেয়ায় হতাশ হয়ে পড়েন তারা।
জুলাই-আগস্টের রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থা এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। তারপরও দেশি চিকিৎসা সরঞ্জাম খাতে ইতিবাচক অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে জানিয়ে আমদানিকৃত পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনে সামঞ্জস্যপূর্ণ সমর্থন এবং প্রতিরক্ষামূলক নীতির প্রয়োজন বলে মনে করছেন শিল্পটির উৎপাদক সমিতির নেতারা। তাদের যুক্তি, সরকারি প্রতিশ্রুতি ও সহায়তা পেলে নিজস্ব সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দেশের স্বাস্থ্যসেবার ভিত গড়তে সক্ষম হবে খাতটি।
প্রমিক্সকো হেলথ কেয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মৌসুমী ইসলাম উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, দেশের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন ঐতিহাসিকভাবে চিকিৎসা সরঞ্জামের বদলে পরিষেবাগুলোতে মনোনিবেশ করেছে, যেখানে স্থানীয় উৎপাদকদের জন্য সমন্বিত সমর্থনের অভাব রয়েছে। শিল্পটির স্বীকৃতিদানে অতীতের দীর্ঘমেয়াদি অবহেলার মতোই নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই নীরবতা স্বাস্থ্যসেবার বহুল প্রয়োজনীয় খাতটিকে বহুমাত্রিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে বলেও আশঙ্কা তার।
বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (বিআইডিএ) তথ্যমতে, স্থানীয় মেডিকেল ডিভাইসের বাজার সাড়ে তিনশ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি, যার বার্ষিক প্রবৃদ্ধি প্রায় দশ শতাংশ। চলতি বছরের শেষে এ বাজার ৩৮৭ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে, যা ২০২৯ সালের মধ্যে ৬৫০ দশমিক সাত মিলিয়ন ডলারে প্রসারিত হবে। তারপরও শিল্পটি অতি আমদানি নির্ভরই রয়ে গেছে। ৮৫ শতাংশেরও বেশি চিকিৎসা সরঞ্জাম আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং চীন থেকে। স্থানীয় চাহিদা বাড়লেও সহায়ক নীতির অভাবে টিকে থাকার লড়াই করছে দেশি উৎপাদন।
বাংলাদেশ মেডিকেল ইন্সট্রুমেন্ট অ্যান্ড হসপিটাল ইক্যুইপমেন্ট ডিলার অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. জসিম উদ্দিন ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রায় ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধিসহ এ খাতের বার্ষিক চাহিদা ১২ হাজার কোটি টাকা বা ১ দশমিক ২০৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। পরিসংখ্যান আরও বলছে, স্টেন্ট এবং পেসমেকারসহ কার্ডিওলজি ডিভাইসগুলোর বাজার চলতি বছরের ৪৬ দশমিক ৪১ মিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৯ সালের মধ্যে ৮০ দশমিক ৬৯ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে।
মৌসুমী ইসলাম বলেন, মাত্র ৩০ হাজার ধরনের চিকিৎসাযন্ত্র স্থানীয়ভাবে আমদানি বা উৎপাদিত হয়, যা বিশ্বজুড়ে উৎপাদিত দুই মিলিয়ন ধরনের সামান্য একটি অংশ। তিনি জোর দিয়ে বলেন, আরও উন্নত ডিভাইসগুলো অন্তর্ভুক্ত করতে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন সম্প্রসারণ স্বাস্থ্যসেবার সুফলকে শক্তিশালী করতে পারে। বিশেষত অসংক্রামক রোগ, খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তনে সৃষ্ট রোগ নিরাময়ে প্রয়োজনীয় কার্ডিওলজি, নিউরোলজি এবং ইউরোলজি সম্পর্কিত চিকিৎসা সরঞ্জামগুলোর প্রয়োজনীয়তা বাড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কিন্তু প্রয়োজনীয় কাঁচামালের উচ্চ আমদানি শুল্ককর আমদানিকৃত পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে দিচ্ছে না স্থানীয় উৎপাদকদের। উদাহরণ দিয়ে মৌসুমী বলেন, প্রতিরক্ষামূলক গ্লাভসের প্যাকেজিং উপকরণের ওপর উচ্চকর স্থানীয় পণ্য উৎপাদন আমদানির চেয়ে বেশি ব্যয়বহুল করে তুলেছে। এতসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও জেএমআই সিরিঞ্জ অ্যান্ড মেডিকেল লিমিটেড এবং জেএমআই হসপিটাল রিকিউসাইট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেডসহ স্থানীয় কোম্পানিগুলো দেশের সিরিঞ্জ এবং রক্তের ব্যাগের চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশই সরবরাহ করে। শয্যাসহ হাসপাতালে প্রয়োজনীয় নানা ধরনের সরঞ্জাম তৈরি করছে প্রমিক্সকো। তবে মূল্য প্রতিযোগিতা এক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মিথ্যা ঘোষণায় আমদানির মাধ্যমে অননুমোদিত সরবরাহের ফলে আমদানি করা সরঞ্জাম প্রায়ই দেশি পণ্যের চেয়ে সস্তা হয়। জেএমআই সিরিঞ্জের নির্বাহী পরিচালক অভিজিৎ পাল বলেন, এই সেক্টরে বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও উচ্চ বিনিয়োগ খরচ এবং বিলম্বিত রিটার্ন বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করছে। দেশে উৎপাদিত যন্ত্রপাতির জন্য কর ছাড় এবং শিল্পবান্ধব ক্রয়নীতির মাধ্যমে স্থানীয় উৎপাদকদের সমর্থনে সমন্বিত নীতিপদ্ধতি বাস্তবায়নের আহ্বান জানান মৌসুমি ইসলাম। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে, চিকিৎসা সরঞ্জাম শিল্প যদি গার্মেন্টস এবং ওষুধ খাতের মতো একই সহায়তা পায়, তবে এটি বৈদেশিক মুদ্রা আয় এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।
চিকিৎসা সরঞ্জাম শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং জেএমআই গ্রুপের ব্যবস্থাপনা (এমডি) মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, স্থানীয় উৎপাদন বাড়িয়ে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো গেলে চিকিৎসার খরচ কমানো এবং বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় সম্ভব। তবে সরকারকে সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে হবে। গত সেপ্টেম্বরে জাতীয় অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ খানের নেতৃত্বে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অক্টোবরে তাকেই প্রধান করে গঠিত হয় স্বাস্থ্যসেবা সংস্কার কমিশন। যদিও সুনির্দিষ্ট কমিশন সদস্যদের নাম এখনো ঘোষণা করা হয়নি। সংস্কার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে স্টেকহোল্ডারদের দাবি ও পরামর্শ জমা দিতে উৎসাহিত করেছেন কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. মো. সায়েদুর রহমান।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে