জাবির লেকে পরিযায়ী পাখির কলতান : প্রকৃতির এক অপূর্ব দৃশ্য
পরিযায়ী পাখিরা যেন আকাশের এক প্রহেলিকার মতো, তাদের জীবন কেবল সময়ের এক বিন্দু। তারা আকাশে ভেসে চলে, এক অদৃশ্য গাথায় মিশে, যেন আকাশের অলিখিত গল্পের অংশ। দূর থেকে আসা, একত্রিত হয়ে এক বিন্দুতে মিলিত হয়ে, আবার হারিয়ে যায় চিরন্তন পথে। প্রতিটি পালকের সঙ্গে মিশে থাকে এক অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা, এক অজানা সঙ্গীতের সুর, যা কেবল তারা জানে। তাদের যাত্রা, পৃথিবীর এক কোণ থেকে অন্য কোণ, যেন এক দীর্ঘ স্বপ্নের অভ্যন্তরীণ যাত্রা - যেখানে নেই কোনো সীমা, নেই কোনো বাধা।
আবহাওয়ার পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিযায়ী পাখিরা তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে আসে। শীতল অঞ্চলের কনকনে ঠান্ডা থেকে মুক্তির জন্য, খাবার ও উষ্ণতার খোঁজে, বিভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি হাজারো মাইল পাড়ি দিয়ে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে চলে আসে। এই পাখিরা কখনো কখনো ১০ হাজার মাইলেরও বেশি পথ পাড়ি দিয়ে এখানে পৌঁছায়। সুদূর সাইবেরিয়া, চীন, নেপাল, জিনজিয়াং, মঙ্গোলিয়া অঞ্চল থেকে পরিযায়ী পাখিরা নাতিশীতোষ্ণ বাংলাদেশে আসে। এসব পাখির নিরাপদ ভূমির একটি হচ্ছে ঢাকার অদূরে সাভারে অবস্থিত ঢাকা শহরের তুলনায় তুলনামূলক কোলাহলমুক্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সব মিলিয়ে লেক বা জলাশয় আছে ২৬টি। এর মধ্যে চারটি লেকে আবাস গড়ে হাজারো পরিযায়ী পাখি। ক্যাম্পাসের পাখির ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টার, মনপুরা, বোটানিক্যাল গার্ডেনের ভেতরের লেকগুলোয় বেশি পাখির দেখা মেলে। এছাড়াও নতুন রেজিস্ট্রার ভবনের পেছনের লেক, পুরাতন রেজিস্ট্রার ভবনের পেছনের লেকেও পাখি দেখা যায়। এসব পাখির মধ্যে থাকে- সরালি, গার্গেনি, পিচার্ড, মানিকজোড়, মুরগ্যাধি, জলপিপি, নাকতা, কলাই, ফ্লাইপেচার, পাতারি, চিতা টুপি, ঘুঘু, চিল, নিশি বক, হরিয়াল, লাল গুরগুটি, খুনতে হাঁস, জিরিয়া হাঁস, ভুতি হাঁস, লেঞ্জা হাঁস, আফ্রিকান কম্ব ডাক, গ্রেটার স্টর্ক, ফুলুরি হাঁস এবং ইউরেশিয় সিঁথি হাঁসসহ নানা প্রজাতি।
প্রতি বছর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে জাবির লেকগুলোতে পরিযায়ী পাখির আগমন শুরু হয়। নভেম্বরের শেষের দিকে পাখির সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং ডিসেম্বরের শেষ ও জানুয়ারির শুরুতে সর্বাধিক পরিমাণ পাখির দেখা মেলে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের তথ্য মতে, ১৯৮৬ সালে সর্বপ্রথম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিযায়ী পাখি আসে। অধিকাংশ পাখিই হাঁসজাতীয়। এর মধ্যে অধিকাংশই ছোট বা বড় সরালি। তবে ২০০০ সালের আগে কিরকম পাখি আসতো তার সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। ২০০০ সালের পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পাখি শুমারি করা শুরু করে। সাধারণত প্রতি বছর ১৬-১৭ জানুয়ারি এই শুমারি করা হয়। এই শুমারির তথ্য মতে প্রতি বছর প্রায় পাঁচ হাজারের মতো পাখি আসে।
তবে ২০২১ সালে দুই দশকের মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক পাখি আসে জাবিতে। সেবার ১২ প্রজাতির প্রায় সাত হাজারের বেশি পরিযায়ী পাখি এসেছিল। করোনাভাইরাসের কারণে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। ফলে দর্শনার্থীদের উপদ্রব না থাকায় পাখির প্রজাতি ও সংখ্যা বেশি ছিল, এমন ধারণা প্রকাশ করেছেন পাখি বিশেষজ্ঞরা।
কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে ক্যাম্পাসের নীরবতা ভেঙে ওঠে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তাদের অবিরাম গতি ও দলবেঁধে ছুটে চলা চলে, যেন প্রকৃতির এক অমিত গতি। সন্ধ্যা হলে লেকগুলোর ওপর নেমে আসে এক অপূর্ব নীরবতা। রাতে, নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে, তারা গাছের ডালে ঘনীভূত হয় ক্ষণিকের জন্য। আর ভোরের আলোতে, তাদের ছুটে চলা আবার শুরু হয়, যেন এক নতুন অভিযানে।
ছুটির দিনগুলোতে ক্যাম্পাসের লেকের পাড়গুলোতে অনেক বেশি দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে। ফলে এই লেকগুলোতে যে পাখি বসে সেগুলো নিরাপদবোধ করে না। কারণ তারা শব্দে ভয় পায়। শব্দ শুনলে পালিয়ে যায়।
পাখিদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দিতে প্রতি বছর লেকের কচুরিপানা পরিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এছাড়াও লেকের পাড় ঘেঁষে বেড়া দেওয়া, সতর্কতামূলক বিলবোর্ড টাঙানো প্রভৃতি কাজ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এরপরও আসলে দরকার সামগ্রিক সচেতনতা। তা না হলে হয়তো আমাদের অতিথিরা খুঁজে নেবে অন্য কোনো নিরাপদ আশ্রয়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে