Views Bangladesh Logo

প্রকৃতিকথা

চৈত্রদিনে ঝরাপাতার গান

সন্ত-জমজ চৈত্র এলেই মনে পড়ে যুগপৎ মৃত্যু ও জন্মের কথা। এ সময় জীবনের এই দুই ধ্রুব সত্যের দেখা মেলে প্রকৃতিতে। প্রকৃতিতে একদিকে চলে ঝরাপাতার খেলা। ঝরাপাতা মানেই মৃত্যু, স্মৃতি আর চলে যাওয়া পায়ের শব্দ। পর্ণমোচী গাছেরা পাতা ঝরিয়ে রিক্ত হয়। গাছের তলায় জমে ওঠে শুকনো পাতার স্তূপ। দুধ-চায়ের মতো রং সেসব পাতার, আবার কখনো বা চিনেবাদামের খোসার মতো গাঢ় বাদামি সেসব পাতারা। ওপর দিয়ে হেঁটে গেলেই মচমচ করে বেজে ওঠে প্রকৃতির সারিন্দা। নিস্তব্দ নিঝুম চৈত্রের ঝিম দুপুরে চিরসবুজ গাছেরাও ঝরাতে থাকে পাখির পালকের মতো বুড়ো পাতাদের। হাওয়ায় দুলতে দুলে কেঁপে কেঁপে ওরাও এসে ভিড় করে গাছের তলায় জমে থাকা শুকনো পাতাদের সঙ্গে।


হয়তোবা কোনো ডালে বসে ডেকে ওঠে ঘুঘু পাখি বা বিষণ্ন কোকিল ডাক ছেড়ে খুঁজে ফেরে হারানো সাথীকে। কুহু ডাকের সঙ্গে বিবর্ণ শুকনো পাতার রং মনে করিয়ে দেয় জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা, হারানো প্রিয় মানুষদের কথা। প্রকৃতির এই অমোঘ নিয়মের কোনো ব্যত্যয় ঘটে না। চৈত্র এলে চোখ মেলে তাকালেই প্রকৃতির সে নীরব সঙ্গীত যেন শুনতে পাই। মাঝে মাঝে তেষট্টিতে পৌঁছে বলতে ইচ্ছে করে, ঝরাপাতা গো আমি তোমারই দলে। পরক্ষণেই সজীব প্রাণোচ্ছল তরুণদের দেখে উজ্জীবিত হই, তখন আবার বলতে ইচ্ছে করে, নব নবীনের গাহিয়া গান/ সজীব করিব মহাশ্মশান।

পাশাপাশি আনন্দ ও আশায় তাই শুনতে পাই জীবনের নতুন সঙ্গীত, নতুন পাতাদের উদ্বোধন। মনটা উন্মুখ হয়ে সেদিকে বিস্ময়ভরা চোখ নিয়ে চেয়ে থাকে কচি সবুজ বর্ণোজ্জল তীরের ফলার মতো পাতাগুলোর দিকে, ফুলের দিকে, ফলের দিকে। ভাবি, জীবন কত সুখের, কত আনন্দের। মৃত্যুকে পেছনে ফেলে অবিরাম ছুটে চলে জীবনের জয়রথ, তাকে থামাতে নেই, যতক্ষণ সে নিজে থেমে না যায়। প্রকৃতিতে চলে অপূর্ব পালাবদলের খেলা। চৈত্র এলেই মনে পড়ে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের একটি কবিতা। আনুমানিক ১৯৪০ সালে তিনি এ কবিতাটি লিখেছিলেন বিজনকুমার গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত ছোটদের পত্রিকা শিখার জন্য। কবিতাটির নাম ছিল চৈত্রদিনের গান। ছোটদের জন্য লেখা হলেও সে কবিতাটিতে পাই চৈত্রদিনে নতুন পত্রপল্লবের সঙ্গে জীবনের উন্মেষ, তীব্র আলোর উন্মাদনা।
চৈতীরাতের হঠাৎ হাওয়া
আমায় ডেকে বলে,
বনানী আজ সজীব হ’ল
নতুন ফুলে ফলে।
এখনও কি ঘুম-বিভোর?
পাতায় পাতায় জানায় দোল
বসন্তেরই হাওয়া।
তোমার নবীন প্রাণে প্রাণে,
কে সে আলোর জোয়ার আনে?

চৈতীরাত না হলেও চৈত্রের সকালে প্রকৃতির এই বোধটুকু বোঝার জন্য বেরিয়ে পড়লাম বাংলার এক গ্রাম দেখতে। যশোরের অভয়নগর উপজেলার বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ভৈরব নদ। শঙ্করপাশা খেয়াঘাট। খেয়াপারের জন্য আসা পথিকরা যাতে জিরাতে পারে সেজন্য বাংলার প্রায় প্রতিটি খেয়াঘাটেই বোধহয় অন্তত একটা করে বট বা অশ্বত্থ গাছ থাকে। শঙ্করপাশা খেয়াঘাটের ওপরে তিনটে বটগাছ, বয়সে কিছুটা নবীন হলেও ছাতার মতো ডালপালা আর পাতা ছড়িয়ে ছায়াময় করেছে তলাটা। নৌকায় সেই খেয়াঘাট পার হয়ে ভ্যানে সওয়ার হলাম। কোদলা রোড ধরে এগিয়ে চলল সে ভ্যানটা। পথের দুপাশে গাছগাছালির ছায়া, ডোবা, ঘরবাড়ি ও ফসলের ক্ষেত। কোনো কোনো ঝোপে লতায় লতায় ঝুলছে লাল টুকটুকে তেলাকুচার ফল, ডোবার মধ্যে বিষকাটালি আর ছিটকি গাছ। প্রায় সব গাছেরই পাতা ধূলায় ধূসর, পাতাগুলো অপেক্ষা করছে বৃষ্টিস্নানে শুচিশুদ্ধ হওয়ার। বোরো ধানের গাছগুলো এখন পূর্ণগর্ভবতী, কোনো কোনো গোছা থেকে উঁকি দিচ্ছে শীষ। গ্রামীণ সেসব মাঠের আইলে দেশি খেজুরের গাছ, ঝিরি ঝিরি পাতাগুলো কাঁপছে বসন্ত বাতাসে, কচি খেজুরের ফলগুলো পুষ্ট হচ্ছে কাঁদিতে কাঁদিতে।


কলাপাতাগুলো যেন চামর দুলিয়ে বাতাস করছে তার কোলে থাকা নানা পদের আগাছাগুলোকে। সেসব আগাছায় ফুল ফুটেছে। কাঁটাওয়ালা ঝোপের ভেতর দু-চারটা করে উজ্জ্বল হলুদ রঙের আহা কি চমৎকার ফুল ফুটেছে, শিয়ালকাঁটা ফুলগুলোকে বিদেশি পপি ফুলের মতো দেখাচ্ছে। তাদের সঙ্গ দিচ্ছে হাতির মতো বাঁকানো শুঁড়ের মতো পুষ্পমঞ্জরিতে ফোটা খুদে খুদে নাকফুলের মতো সাদা ফুলেরা, সে আগাছার নামটা হাতিশুঁড়। ফুল ফুটেছে শ্বেতদ্রোণ ও রক্তদ্রোণ আগাছায়, বনমরিচের ডালে ডালে ফুটেছে ফুল, ধরেছে ফল। ধানক্ষেতের মধ্যে বেয়াড়া ঢেঙ্গা স্বভাবের শ্যামাঘাসগুলো শিষ ছেড়ে ধানগাছের সঙ্গে যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে। রাস্তার কোলে ফুটেছে মুক্তোঝুরি, বনধনে, মিশ্রিদানা, দুধিয়া, নাকফুল, হলদে হুরহুরে, পার্থেনিয়াম, ফোস্কাবেগুন, বনবেগুন ও ধুতুরা গাছে। সাদা সাদা ভাঁটফুল ফুরিয়ে সেগুলো এখন লাল বৃতির ভেতরে সবুজ ফলের রূপ নিয়েছে। এসব আগাছাদের দেখতে দেখতে নেমে পড়লাম বুনোরামনগর গ্রামে।

বুনোরামনগর গ্রামে প্রায় শতবর্ষী একটা মন্দির আছে, বুনোশ্বরী দেবীর মন্দির, লোকেরা বলেন বুনো মায়ের থান। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা সে দেবীকে অনেক জাগ্রত মনে করে ভক্তিভরে পূজা করেন। প্রতি শনি ও মঙ্গলবারে সে দেবীর মন্দিরে পূজা হয়। দিনটা মঙ্গলবার হওয়ায় সেখানে ভক্তদের দেখলাম। বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে সেখানে প্রচুর লোক আসেন, মেলা হয় বটের ছায়ায়। একটা প্রাচীন বটগাছ পুরো মন্দিরটাকে ছেয়ে ফেলেছে। বটগাছটাকে পবিত্র বৃক্ষের মর্যাদা দিতে তার ধূসর-কালচে গুঁড়িতে লাল সিঁদুর ও তেল মেখে শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে। জটার মতো ঝুরি ও গুঁড়িতে ঝুলছে অসংখ্য ইটের টুকরো, ওগুলো নাকি মানতের। মানত পূরণ হলেই মানতকারী এসে ওগুলো খুলে দিয়ে যান। বটগাছের উপরে তাকিয়ে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলাম। বটের তলাটা শুকনো ঝরাপাতায় ভরা, যেন শুকনো খটখটে ধুলোওড়া উদোম মাটিকে মাদুরের মতো ছেয়ে ফেলেছে।


বেশ আরামেই লোকেরা তার ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে বিশাল সে গাছটাকে প্রদক্ষিণ করছেন, পাপড়, শরবত আর চানাচুরের দোকানও বসেছে। বিস্ময়ের আর একটা কারণ, একটা আলপিনের মাথার মতো ক্ষুদ্র বীজের মধ্যে এত বড় একটা গাছের জিনকোড কীভাবে লুকিয়ে থাকে, স্রষ্টার মহিমা আমাদের বোধের অতীত। প্রাচীন গাছটায় বেশ কিছু ফাঁক-ফোকড় তৈরি হয়েছে। হঠাৎ চোখ পড়ল, এরই একটা ফোকড় থেকে একটা সুতনলি সাপের মতো কিছু একটা গলা বাড়িয়ে মাথা দোলাচ্ছে। বটগাছটার তলায় থাকা চানাচুরওয়ালা হাসান আলী বললেন, গেল জ্যৈষ্ঠে একদিন হঠাৎ একটা সাপ আমার দোকানের সামনেই ঝপাৎ করে পড়ে ফণা তুলে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে সেখানে ছিল। দেবীর থান, তাই সাপ এমনকি ওই গাছে থাকা পাখি ও পোকামাকড়দের আমরা মারি না। সবাই ভয় পায়, এতে যদি কোন ক্ষতি হয়। বললেন, কিছুক্ষণ পর সাপটা সরে যায়। আমরাও ওদের ক্ষতি করি না, ওরাও কখনও কারো ক্ষতি করেছে বলে শুনিনি। ভাবলাম, সুন্দরবনে বাঘ আছে বলে এখনও বনটা টিকে আছে। তেমনি বৃক্ষে সাপ থাকা ভালো, এতে ভয়ে অন্তত কেউ সেসব গাছ কাটতে সাহস পাবে না। গাছটার উপরের ডালপালায় এসেছে নতুন পাতা। উজ্জ্বল সবুজ তকতকে পাতাগুলো যেন জীবনের বার্তা ঘোষণা করছে।

বটতলা ও মন্দির প্রাঙ্গণ ছেড়ে এবার গ্রামের মাটির পথ ধরলাম। প্রায় দুপুর বেলা, ঘোলাটে রোদ, আকাশটা আকাশি-সাদা, মাঝে মাঝে উড়ে যাচ্ছে জলধূসর মেঘ, জোর হাওয়া বইছে, ধূলো উড়ছে, কালবৈশাখীর পূর্বাভাস। বটের প্রশান্ত ছায়াকে আরও প্রশান্তিময় করে তুলেছে সে বটতলা ও মন্দির প্রাঙ্গণে থাকা থালার মতো একটা বিরাট দিঘী। দিঘীর এক পাড়ে ঘন গ্রামীণ বন, দুই পাড়ে রাস্তা, তিন পাড়েই ঘরবাড়ি। দিঘীতে চলছে একই সঙ্গে গরু ও মানুষের স্নান। রাস্তার কোলে অসংখ্য সোনার ঘণ্টার মতো ফুটে রয়েছে কলকে ফুল। এরই কাছে একটা করমচা গাছ। যেন সে ঝোপাল গাছটার ওপর কেউ সাদা খই ছিটিয়ে দিয়েছে। সুরভিত চার পাপড়ির সাদা রঙের ফুলগুলো ফুটে রয়েছে তারার মতো।


একটু দূরেই দিঘীর পাড়ে একটা বয়স্ক সফেদা গাছের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন একটা মায়াময় অনুভূতি আচ্ছন্ন করে ফেলল। জানি না কোন শিল্পী প্রকৃতির এরকম রঙের খেলাকে চিত্রকর্মে তুলে ধরতে পারবেন! কত রকমের সবুজ রঙ যে গাছটার মাথায় ডালে ডালে পাতায় পাতায় ছড়িয়ে পড়েছে! গাঢ় ও হালকা সবুজ রঙে বৃক্ষাচ্ছদনটা দেখাচ্ছে মোজাইকের মতো। ফাঁকে ফাঁকে ঝুলছে দু চারটা বাদামি সুগোল বলের মতো সফেদা ফল। কাছেই কয়েকটা আতাগাছ। সে গাছে ঝুলছে হৃৎপিণ্ডাকার অনেক ফল, সবে ম্লান সবুজ ফলগুলোতে লালের আভা ছড়ানো শুরু হয়েছে, মানে পাক ধরেছে। কয়েকটা পীতরাজ বা রয়না গাছ, দু-একটা গোলাকার ফল রয়েছে গাছের মগডালে। আসামী লতা জড়িয়ে পেচিয়ে উঠে গেছে ঝোপঝাড়ে, আছে চাইলতা, খোকশা ও কাকডুমুর গাছ। পাতাঝরা ডালপালা, ডালের গা থেকে থোকা ধরে বেরিয়েছে সবুজ কোমল গোল গোল পশমভরা ডুমুরের কচি ফল। ডালে ডালে নেচে বেড়াচ্ছে দোয়েল পাখিরা।

পাশে একটা বাঁশবন। বাঁশবনের তলাটা পুরু হয়ে ছেয়ে আছে শুকনো পাতায়। নানা রকমের বুনো গাছপালায় ঠাসা সে বাঁশবন। এর মধ্যে একটা ঝোপ পেলাম বিজুফুলের, অন্য নাম বনরঙ্গন। সাধারণত শালবনে ও পাহাড়ি জঙ্গলে এ ফুলের গাছ দেখা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরারা পহেলা বৈশাখে নববর্ষ বরণ করে বৈসাবি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। বৈসাবি বা বিজু উৎসবের প্রথম দিনে এই ফুল সংগ্রহ করে সে ফুল দিয়ে ঘরবাড়ি সাজানো হয়, মেয়েরা সাজে ও বৌদ্ধ মন্দিরে সে ফুল উৎসর্গ করে। সেই বিজু ফুলের দেখা মিলল বুনোরামপুরের গ্রামীণ জঙ্গলে! জনৈক গ্রামবাসী হাসিনা বেগম জানালেন, রাতের বেলা জঙ্গলে ফোটা সে ফুল থেকে চমৎকার ঘ্রাণ ভেসে আসে। এ গ্রামের জঙ্গলে এ গাছ আরও আছে। বাঁশঝাড়ের তলায় শুকনো বাদামি পাতা, গাছগাছালি সবুজ আর বিজু ফুলের সাদা রং এ যেন বাংলার চৈত্রদিনের এক চিরচেনা ছবি। সেসব ছবি তুলেই ফেরার পথ ধরলাম। দূর থেকে তখনও কানে বাজতে লাগলো মন্দিরের ঢাকের আওয়াজ আর কাঁসার ঘণ্টাধ্বনি, ঝরাপাতাদের নিঃশব্দ পতনের গান।

মৃত্যুঞ্জয় রায়: কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ