অ্যাপের আর্থিক প্রতারণার মাধ্যম এমএফএস, ঠেকানোর দায়িত্ব কার?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের অপপ্রচার, গুজব, মিথ্যা তথ্য প্রকাশ নিয়ে শঙ্কিত এবং উদ্বিগ্ন বিশ্ববাসী। বিশেষ করে প্রধান দুটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক এবং ইউটিউবের তথাকথিত কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড যখন বিশ্বের অধিকাংশ দেশে সাইবার অপরাধীদের সমর্থন করছে, তখন সাধারণ মানুষের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে; কিন্তু তারপরও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটা কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড আছে, নীতিমালা আছে। আক্রান্ত হলে একটা রিপোর্ট করতে পারেন ব্যবহারকারীরা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের চেয়েও সাইবার দুনিয়ায় অপরাধের বড় ক্ষেত্র হয়ে উঠছে শত শত স্মার্টফোন অ্যাপ। এই অ্যাপ এখন সাইবার অপরাধীদের ভয়ংকর অস্ত্র। এসব অ্যাপ ব্যবহার করে প্রতারিত হয়ে বিভিন্ন দেশে ভুক্তভোগীর আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। কারণ এসব অ্যাপের মাধ্যমে মুহূর্তেই যে কারও অ্যানড্রয়েড স্মার্টফোন বহুদূরে থাকা হ্যাকারদের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে পারে। স্মার্টফোনে থাকা সব তথ্য হ্যাকার দখল করতে পারে। এমনকি এই স্মার্টফোনের সঙ্গে সংযুক্ত কোনো আর্থিক খাত, ব্যাংকিং বা অন্য কোনো সেবার সার্ভারও হ্যাকাররা দখল করে নিয়ে বড় বিপর্যয় ঘটাতে পারে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব প্রচারের বিরুদ্ধে আমাদের দেশের সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে যথেষ্ট তৎপর দেখা গেলেও এখনো অ্যাপ ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতারণার বিষয়ে অনেকটা উদাসীনই মনে হচ্ছে।
চলতি বছর (২০২৩) আগস্ট মাসে এমটিএফই নামে একটি অনলাইন প্ল্যাটফরম নিজস্ব অ্যাপ ব্যবহার করে সাধারণ ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে চলে গেছে। এ প্ল্যাটফরমের অ্যাপ ব্যবহার করে যত মানুষ প্রতারিত হয়েছেন, তার প্রায় ৯০ শতাংশ বাংলাদেশের নাগরিক বলেও সে সময়ে বিভিন্ন মাধ্যমে তথ্য প্রকাশিত হয়। মূলত ‘এমটিএফই’ নিজেদের অ্যাপের মাধ্যমে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লাভজনক বিনিয়োগের বিষয়ে উৎসাহিত করে মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলত।
বছর শেষ না হতেই চীনের আরও একটি প্রতারণামূলক অ্যাপের ফাঁদে পড়ে দেড় হাজার মানুষের প্রায় ২০০ কোটি টাকা চীনে পাচারের ঘটনা প্রকাশ হয়েছে। এই প্রতারক চক্রের ১৫ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তারও করেছে। পুলিশ তার দায়িত্ব পালন করেছে; কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের অ্যাপ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনুমোদন, আর্থিক লেনদেন এবং অনুমোদন-সংক্রান্ত বিষয়ে কয়েকটি কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতারণামূলক অ্যাপের অবাধ ব্যবহার এবং বার বার প্রতারণা ও বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনায় অবশ্যই প্রশ্ন ওঠে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো সত্যিই কি তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছে? যেসব বিপুল পরিমাণ টাকা এরই মধ্যে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে, সেগুলো কি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে?
বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে অ্যাপের ফাঁদে পড়ার ঘটনা সামনে এসেছে গত কয়েক বছরে। এ মুহূর্তেও এ ধরনের অ্যাপের ব্যাপক বাংলা বিজ্ঞাপন ইউটিউবে দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে কম সময়ে অবিশ্বাস্য পরিমাণ অর্থ উপার্জনের প্রলোভন দেখিয়ে অনেক অনলাইন জুয়ার অ্যাপের বাংলা বিজ্ঞাপনে ইউটিউব এখন সরগরম। ফেসবুক কিংবা টিকটকে এ ধরনের বিজ্ঞাপন দেখা যায়নি; কিন্তু ইউটিউবে জনপ্রিয় বাংলা গান, সিনেমা, খবরের ভিডিও দেখতে গেলেই এসব জুয়ার অ্যাপের বিজ্ঞাপন সামনে চলে আসছে। এখানে বলে রাখি, বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে ফেসবুক এবং টিকটক বেশ শক্ত নীতিমালা মেনে চললেও ইউটিউব পরিচালনা করা গুগল কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞাপন প্রচারে নীতিহীন অবস্থান কিংবা এক ধরনের দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে চলেছে, যে কারণেই ইউটিউবে প্রতারণার ফাঁদের বিজ্ঞাপন অবাধে প্রচার হচ্ছে।
আসলে বিশ্বে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা অ্যাপ হচ্ছে ইউটিউব। এবং ভার্চুয়াল প্ল্যাটফরমে বিপদের বড় ক্ষেত্র গুগল প্লে স্টোর। প্রতারণামূলক যেসব অ্যাপ ব্যবহারের কথা হচ্ছে, তার শতভাগই ডাউনলোড হয় গুগল প্লে স্টোর থেকে। আবার একটু চিন্তা করে দেখুন, বাংলাদেশে সরকাররের বিরুদ্ধে, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফেক নিউজ প্রচার, বিকৃত তথ্য প্রচার তার ৯০ শতাংশই হয়েছে এবং হচ্ছে ইউটিউবে। আপনি ফেসবুকে কোনো কনটেন্ট রিপোর্ট করলে হয়তো সাড়া পেতেও পারেন, আপত্তিকর কনটেন্ট সরিয়েও নেওয়া হবে; কিন্তু এটা নিশ্চিত যে, ইউটিউবে রিপোর্ট করলে ‘রিপোর্ট করার জন্য ধন্যবাদ’ দেওয়া ছাড়া ইউটিউব কর্তৃপক্ষ আর কিছুই করবে না। তাদের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড শুধু যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা কয়েকটি দেশের জন্য প্রযোজ্য, বাকি দেশগুলোর জন্য ভাঁওতাবাজি।
আবার যতই নিরাপদ অ্যাপ ব্যবহারের কথা বলুক, গুগল প্লে স্টোরে বার বারই অসংখ্য বিপজ্জনক অ্যাপ ‘নিরাপদ’ সার্টিফিকেট নিয়ে সংযুক্ত হয়েছে এবং বড় ধরনের কেলেঙ্কারির পর সেগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। গুগল প্লে স্টোরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যে যথেষ্ট দুর্বল সেটা বার বার প্রমাণিত হয়েছে। এ কারণেই বেশ কয়েকটি দেশে স্মার্টফোনের জন্য নিজস্ব ওএস তৈরির চেষ্টা শুরু হয়েছে। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র ভারতও ‘ইন্দ ওএস’ নামে নিজস্ব স্মার্টফোন অপারেটিং সিস্টেম নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে চলতি বছরের শুরুতেই।
অদ্ভুত ব্যবহার হচ্ছে, আমাদের দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ফেসবুক এবং টিকটক নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা প্রতিবেদন, সুপারিশ করলেও বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মাধ্যম ইউটিউব কিংবা গুগল প্লে স্টোরের বিপজ্জনক অ্যাপ নিয়ে তাদের কোনো উদ্বেগই লক্ষ্য করা যায় না। একইভাবে প্রতারণায় জড়িত অ্যাপগুলো দেশের এমএফএস (মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস) কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কীভাবে চুক্তিবদ্ধ ছিল এবং হচ্ছে, তা নিয়েও কোনো কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন তুলতে দেখা যায়নি।
খেয়াল করে দেখুন, প্রতিবারই প্রতারণার কাজে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ এবং পাচারে ব্যবহৃত হয়েছে কোনো না কোনো এমএফএস প্রতিষ্ঠান বা ডিজিটাল পেমেন্ট গেটওয়ে। সর্বশেষ চীনা যে প্রতারক অ্যাপের মাধ্যমে দেড় হাজার ব্যবহারকারীর প্রায় ২০০ কোটি টাকা পাচার হয়েছে, সেখানেও ‘এমএফএস’ প্ল্যাটফরম ব্যবহারের কথাই জানিয়েছে পুলিশ। পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে আমার নিজের একটি অনুসন্ধান এবং পর্যবেক্ষণও রয়েছে এ বিষয়টিতে।
প্রায় চার মাস আগে, আমাকে পরিচিত একজন জানালেন, কুইজ খেলার প্রলোভন দেখিয়ে কিছু অ্যাপ সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। আমি সাংবাদিকতার প্রক্রিয়ায় অনুসন্ধানে নেমে দেখলাম ‘জিতো’ ‘শেরা’ এ ধরনের নামে কয়েকটি অ্যাপে কুইজ খেলার লিংক আসছে গুগল নিউজ ফিডে।
অ্যানড্রয়েড স্মার্টফোনে গুগল নিউজ ফিডে বিভিন্ন নিউজের লিংক আসে। এই নিউজ ফিডও গুগলের বিজ্ঞাপন প্রচারের একটি মাধ্যম, যা হোক জিতো নামে একটি কুইজ প্রতিযোগিতার অ্যাপের গুগল নিউজ ফিডে আসা লিংকা ক্লিক করতেই প্রথমেই এমএফএস সার্ভিস ‘বিকাশে’র মাধ্যমে পেমেন্ট অপশন সামনে চলে এলো। অর্থাৎ, এই অ্যাপে ঢুকতে হলে আপনাকে শুরুতেই পেমেন্ট দিতে হবে! এটাই কিন্তু প্রতারণার প্রমাণ। কারণ কোনো সুস্থ অ্যাপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান কোনো অবস্থাতেই আপনাকে শুরুতেই পেমেন্ট অপশনে নিয়ে যাবে না। প্রথমে গুগল প্লে স্টোরে নিয়ে যাবে। আপনাকে নিরাপদ ডাউনলোডের অপশন দেখাবে এবং তারপর সাবস্ক্রাইব করতে বলবে; কিন্তু এখানে শুরুতেই পেমেন্ট অপশন!
আমি অনুসন্ধানের অংশ হিসেবেই তাদের সর্বনিম্ন মূল্যের প্যাকেজ দিয়ে লিংকের পেজে প্রবেশ করলাম; কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, টাকা দিয়ে প্রবেশের পরে এ পেজে খেলার কোনো অপশন নেই। দুটি অপশন–একটি হচ্ছে নতুন বন্ধুকে ইনভাইট করুন, আর একটি অপশন হচ্ছে খেলার জন্য নিজে সাবস্ক্রাইব করুন। একবার টাকা দিয়ে ঢুকে, আবারও সাবস্ক্রিপশন! খেলার কোনো অপশন না পেয়ে লিংকের পেজ থেকে বের হয়ে গেলাম। এরপর গুগল ফিডের লিংক থেকে যখন আবার প্রবেশের চেষ্টা করলাম, তখন আবারও সেই পেমেন্ট অপশন সামনে এলো।
অতএব, এবার গুগল প্লে স্টোরে অ্যাপের খোঁজ করলাম। খোঁজ করতে গিয়ে সেই ‘জিতো অ্যাপ’ পেলাম এবং ডাউনলোড করলাম। ডাউনলোডের পর লগ ইন করার পর দেখলাম অ্যাপের ভেতরেও সেই একই অবস্থা। শুধু বন্ধুকে ইনভাইট করার এবং নিজে সাবস্ক্রাইব করার অপশন। আর এর আগে কে কে খেলেছে তার একটা তালিকা; কিন্তু নিজে কীভাবে খেলব, তার কোনো অপশন নেই। এবার আরও একটি বিষয় নজরে এলো। আমার সাবস্ক্রিপশনে ‘অটো রিনিউ’ ফিচার রয়েছে এবং এটা হবে প্রতি সপ্তাহে। অতএব, দ্রুত আনসাবস্ক্রাইব করার জন্য অ্যাপে আনসাবস্ক্রাইব অপশন খুঁজতে গেলাম। কিন্তু পেলাম না। অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে ফেসবুকের একটি পেজে এই অ্যাপের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী অনেকের মন্তব্য এবং বক্তব্য পেলাম। সবারই অভিযোগ, তারা অ্যাপে আনসাবস্ক্রাইব করার অপশন খুঁজে পাচ্ছেন না এবং প্রতি সপ্তাহে তাদের বিকাশ এমএফএস অ্যাকাউন্ট থেকে নির্দিষ্ট হারে টাকা কেটে নেওয়া হচ্ছে।
এরপর অ্যাপ কর্তৃপক্ষকে খুঁজে পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়ল। তবে এই অ্যাপের এমএফএস পার্টনার বিকাশ কর্তৃপক্ষের জনসংযোগ শাখায় যোগাযোগ করা পেশাগত পরিচয়ের কারণে সহজ ছিল এবং সেটাই করলাম। জনসংযোগ শাখার প্রধান আমার কাছে লিখিত আকারে বিষয়টি জানতে চাইলেন এবং আমি লিখিতভাবে জানালাম। তাদের লিখিত বক্তব্যও পেলাম। সেই বক্তব্য পরে পুরোটাই তুলে ধরছি। তার আগে একটা মজার অভিজ্ঞতার কথা বলে নিই।
‘জিতো’ নামের অ্যাপটির কথা এর আগে বলেছি, যেখানে আনসাবস্ক্রাইব কোনো অপশন ছিল না। বিকাশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলার কয়েক ঘণ্টা পর কর্তৃপক্ষ আমাকে জিতো অ্যাপের একটা আনসাবস্ক্রিপশন লিংক পাঠিয়ে জানালেন, এই অ্যাপে আনসাবস্ক্রিপশন অপশন আছে, যেটা সম্ভবত আমার চোখে পড়েনি। আমি এবার অ্যাপে ঢুকতেই দেখলাম, অ্যাপের প্রথম পেজের নিচে বড় অক্ষরে আনসাবস্ক্রিপশন লিংক যুক্ত হয়েছে, যেটা আগে ছিল না। আমার কাছে আগের প্রথম পেজের স্ক্রিনশট ছিল। সেটা মিলিয়ে দেখলাম, এই লিংকটি নতুন যোগ করা হয়েছে; যা হোক, আমি এই লিংক ব্যবহার করে সহজেই আনসাবস্ক্রাইব করতে সমর্থ হলাম।
এরপর এক সপ্তাহ পর আবারও অ্যাপে ঢুকে দেখলাম, প্রথম পেজে সেই আনসাবস্ক্রিপশন লিংকটি উধাও। প্রোফাইলেও কোনো আনসাবস্ক্রিপশন অপশন নেই। পরে বিষয়টি আবারও জানালাম বিকাশের কর্মকর্তাকে। এর তিন দিন পর আবারও লক্ষ্য করলাম অ্যাপের কনট্যাক্ট অপশনের ভেতরে সেই আনসাবস্ক্রিপশন অপশনটি যোগ হয়েছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, ফেসবুকের যে পেজে এসব ‘কুইজ অ্যাপে’র প্রতারণা নিয়ে ভুক্তভোগীরা নিজেদের লিখছিলেন, ‘জিতো অ্যাপ’ নিয়ে অনুসন্ধান শুরুর পর সেই ফেসবুক পেজটিও উধাও হয়ে যায়! তবে পেজটির কিছু স্ক্রিনশট রেখে দিয়েছিলাম।
জিতো অ্যাপের ‘আনসাবস্ক্রিপশন’ অপশন নিয়ে লুকোচুরি খেলার ফাঁকে বিকাশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একই ধরনের ‘শেরা’ অ্যাপ নিয়েও কথা হলো। এই অ্যাপগুলোর অবস্থাও প্রায় একই। খোঁজ পেলাম ‘কুইজগিরি’ ও ‘কুইজমাইন্ড’ নামে একই ধরনের আরো দুটি অ্যাপ আছে। প্রথমেই বিকাশে পেমেন্ট অপশন। তবে এখানে কুইজ খেলার অপশন আছে এবং শুরু করা যায়। তবে তার শেষ নেই। মাঝপথে গিয়ে ‘টেকনিক্যাল এরর’ হয়ে খেলা বন্ধ হয়ে যায়। অতএব, আকর্ষণীয় পুরস্কার পাওয়ার প্রত্যাশা কুইজে অংশ নেওয়া কারই পূরণ হয় না। আমি দুটি অ্যাপেরই লিডার বোর্ডে পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকা এবং তাদের বিস্তারিত পরিচয় জানার চেষ্টা করেছি; কিন্তু পাইনি। বরং লিডার বার্ডের তালিকায় যে কোনো একটিতে ক্লিক করলেই ‘Dubai Verde/Arancio Gradient’ লেখা আসে। এই লেখাটা আসলে একটি ব্র্যান্ডের সানগ্লাসের বিজ্ঞাপনে লেখা থাকে; যার ইংরেজি অর্থ ‘কপি অব দুবাই ব্লু/পিংক গ্রাডিয়েন্ট’। এ লেখাটি কোনো লিডার বোর্ডের প্রত্যেকের নামের তালিকার বিপরীতে আসছে, সেটাও একটা রহস্য!
এখানে আমি বিকাশ কর্তৃপক্ষের পুরো বক্তব্য তুলে ধরছি। বিকাশের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশনস শামসুদ্দিন হায়দার ডালিমের পাঠানো বক্তব্যটি ছিল:
‘বিকাশ একটি পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুসরণ করে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে বিকাশের সব কার্যক্রম পরিচালতি হয়। বিভিন্ন পণ্য ও সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান তাদের সেবা বা পণ্য বিক্রির পেমেন্ট নিতে বিকাশের পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে থাকেন। যে কুইজ প্ল্যাটফর্ম এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, বিকাশ অ্যাপের স্ক্রিন থেকে সেগুলোতে ক্লিক করলে সরাসরি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের অ্যাপ বা মাইক্রোসাইটে পৌঁছে যান গ্রাহক। কোনো সেবা সাবস্ক্রাইব করতে চাইলে গ্রাহককেও সংশ্লিষ্ট সেবাদাতার সাইট বা অ্যাপ থেকেই সাবস্ক্রাইব করতে হয়। সাবস্ক্রাইব করার জন্য ওটিপি ও পিন দেয়া বাধ্যতামূলক। ফলে গ্রাহকের নিজের সম্মতি এবং উদ্যোগ ছাড়া কোনোভাবেই সাবস্ক্রিপশনের সুযোগ নেই। সাবস্ক্রিপশন অটো রিনুয়্যাল হলে তাও প্রথম স্ক্রিনেই স্পষ্ট করে বলে দেয়া থাকে। এরপরে কোনো গ্রাহক যদি সাবস্ক্রিপশন করেন এবং পরে আনসাবস্ক্রাইব করতে চান, সে অপশন সম্পর্কেও সংশ্লিষ্ট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের অ্যাপ বা ওয়েবে ও ফেসবুক পেইজে বিস্তারিত নির্দেশনা দেয়া থাকে। যা দেখে গ্রাহক নিজে আনসাবস্ক্রাইব করতে পারেন অথবা কাস্টমার সার্ভিসে যোগাযোগ করেও আনসাবস্ক্রাইব করার অনুরোধ রাখতে পারেন।’
বিকাশ কর্তৃপক্ষের বক্তব্যের সঙ্গে ‘শেরা’ অ্যাপ থেকে কীভাবে আনসাবস্ক্রাইব করতে হয় তার প্রক্রিয়াও উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া জিতো অ্যাপে ‘আনসাবস্ক্রিপশন’ অপশন যুক্ত হওয়ার বিষয়টিও বিকাশ কর্তৃপক্ষ জানায়, যে সম্পর্কে আগেই বিস্তারিত লিখেছি।
শেষ করতে চাই বিকাশ কর্তৃপক্ষের বক্তব্যের সূত্র ধরেই। এ বক্তব্যে যথার্থই বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুসরণ করেই বিকাশ এমএফএস সার্ভিস দিচ্ছে। আমি এটাই বলতে চাই, একটি এমএফএস প্রতিষ্ঠান কোনো ধরনের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন বিষয়ে কি ধরনের চুক্তি করবে, সে বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট এবং অবশ্য অনুসরণীয় বিধি-বিধান থাকা উচিত। বিশেষ করে কোনো অ্যাপের সঙ্গে এমএফএস প্রতিষ্ঠানের পেমেন্ট লিংক যুক্ত করতে হলে সেই অ্যাপ নির্মাতা কারা, তাদের ঠিকানা কোথায়, অ্যাপটি কতটা নিরাপদ এবং বাংলাদেশের কোনো ব্যাংকে তাদের অ্যাকাউন্ট আছে কি না, সে বিষয়টি প্রথমে নিশ্চিত হতে হবে এবং প্রতিদিনের লেনদেন সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবিড় পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। তাহলে সাধারণ ব্যবহারকারীর প্রতারণার শিকার হওয়ার ঝুঁকি কমবে, এমএফএস প্রতিষ্ঠানেরও বড় দায়বদ্ধতা নিশ্চিত হবে। কারণ ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের লাইসেন্স পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যক্রম শুরু করলে অ্যাপের মাধ্যমে এ ধরনের আর্থিক প্রতারণা আরও বাড়তে পারে। এ কারণে এ মুহূর্তেই বাংলাদেশ ব্যাংককে অ্যাপের মাধ্যমে লেনদেন বিষয়ে কঠোর নীতিমালা ও নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে।
‘জিতো’ ও ‘শেরা’ অ্যাপগুলো যদি ঘুরে দেখেন, তাহলে আপনিও নিশ্চিত হবেন, এ ধরনের অতি রুগণ চেহারার অ্যাপগুলোর প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে প্রথমবার সাবস্ক্রিপশন থেকে ব্যবহারকারীর টাকা হাতিয়ে নেওয়া। কারণ এটা নিশ্চিত, এই অ্যাপে কেউই দ্বিতীয়বার সাবস্ক্রিপশন করবে না। এ ধরনের অ্যাপের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যায় যদিও গুগল প্লে স্টোরে যথারীতি যুক্ত আছে এবং ডাউনলোড করা যাচ্ছে। এই অ্যাপগুলোর বিষয়ে একটা যথাযথ তদন্ত হোক। তদন্তের মাধ্যমে দুর্বলতা এবং প্রতারণার ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে যে কোনো অ্যাপের ক্ষেত্রে এমএফএস প্রতিষ্ঠানের যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে কঠিনতর শর্ত আরোপ করা হোক।
আমরা বলতেই পারি, ব্যবহারকারীদের সচেতন হতে হবে। সচেতনতা ছাড়া কীভাবে প্রতারণা ঠেকানো সম্ভব? ব্যবহারকারীর সচেতনতা জরুরি; কিন্তু মনে রাখতে হবে, অ্যাপ ব্যবহার করে যারা প্রতারণা করে তারা অনেক বেশি চতুর এবং প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন। এ কারণে শুধু সাধারণ গ্রাহকের ওপর সচেতনতার ওপর নির্ভর না করে সাধারণ ব্যবহারকারীদের প্রতারণার হাত থেকে রক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে যথেষ্ট সক্ষমতার সঙ্গে দায়িত্বপালন করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও তথ্যপ্রযুক্তি খাত বিশ্লেষক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে