স্বদেশ প্রত্যাবর্তন
সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষু শেখ হাসিনাকে দমাতে পারেনি
বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ড ও জেলে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর স্বাভাবিকভাবে আওয়ামী লীগে একটা চরম নেতৃত্বের শূন্যতা চলছিল। এমন কী সেই শূন্যতা ছিল জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে। মহিউদ্দিন আহমেদ, বেগম জোহরা তাজউদ্দীন, আবদুল মালেক উকিল, আবদুর রাজ্জাক, ড. কামাল হোসেন, আবদুল মান্নান, বেগম সাজেদা চৌধুরী, জিল্লুর রহমান, তোফায়েল আহমেদ প্রমুখ নেতৃবৃন্দের কেউ-ই ব্যক্তিগতভাবে অথবা সম্মিলিতভাবে নেতৃত্বের সেই শূন্যতা পূরণ করতে পারেননি, ফলে তারাই উদ্যোগ নিয়ে ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ কাউন্সিল শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি পদে নির্বাচিত করেন। হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত দলীয় কাউন্সিলে তার অনুপস্থিতিতে তিনি সর্বসম্মতিক্রমে দলের সভাপতি নির্বাচিত হন।
একটি রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নেয়া শেখ হাসিনার মূলধন ছিল ছাত্র আন্দোলনের সামান্য অভিজ্ঞতা। রাজনীতির কেন্দ্রে থাকলেও, ইতোপূর্বে তিনি কোনো রাজনৈতিক সংগঠন পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন না। কখনো কখনো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করলেও, রাজনৈতিক দল সামাল দেয়ার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাও তার ছিল না। কাজেই, দলের প্রবীণ নেতারা ভেবেছেন, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাহীন শেখ হাসিনাকে তারাই বুদ্ধিশুদ্ধি দিয়ে চালাবেন। এমন কী কেউ কেউ এটাও ভেবেছেন, শেখ হাসিনাকে সামনে রেখে তিনি বা তারা-ই দলটি পরিচালনা করবেন। শেখ হাসিনা হবেন তার বা তাদের আজ্ঞাবহ।
অনেকেই ভেবেছেন, সভাপতি হলেও শেখ হাসিনা হয়তো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাতৃভূমিতে ফিরে আসবেন না; কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা সব আশঙ্কা এবং অনিশ্চয়তার ঝুঁকি সত্ত্বেও ১৯৮১ সালের ১৭ মে এক বৃষ্টিমুখর দিনে ঢাকায় ফিরে আসেন। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান নানাভাবে চেয়েছেন, শেখ হাসিনা যেন মাতৃভূমিতে ফিরে না আসেন; কিন্তু জিয়া ও সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষু শেখ হাসিনাকে দমাতে পারেনি।
১৯৮১ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনটাই ছিল তার কাছে একটা চ্যালেঞ্জ। কতজন ‘মা’ পারেন, ১৫ আগস্টের মতো ট্র্যাজেডির পটভূমিতে একটা বৈরী পরিবেশে একা মাতৃভূমিতে ফিরে আসতে? একাধারে গভীর রাজনৈতিক সংকট এবং খোদ রাষ্ট্রযন্ত্রের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে তাকে ঢাকায় ফিরতে হয়েছে। বাবা, মা, ভাই, চাচা, ভ্রাতৃবধূসহ পরিবারের ২২ জন মানুষের রক্তে সিক্ত বাংলাদেশে শূন্য হাতে ফিরে আসা কী খুব সহজ ব্যাপার? বুক ভরা সাহস ও দেশপ্রেম ছাড়া আর কোনো সম্পদ ছিল না তার। বয়সই বা কত? মাত্র ৩৪ বছর। কোথায় থাকবেন, কীভাবে জীবন নির্বাহ করবেন, ছেলে-মেয়েদের কী হবে- কোনো চিন্তাই তাকে তার লক্ষ্যচ্যুত করতে পারেনি। আর কী কপাল দেখুন, তিনি স্বদেশে ফিরে আসার পর সামরিক শাসকদের অভ্যন্তরীণ কলহের কারণে স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে নিহত হলেন। শেখ হাসিনা তখন জেলা সফরে বেরিয়েছেন। কাকতালীয় হলেও শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং মাত্র ১৩ দিনের মাথায় জিয়ার হত্যাকাণ্ড সামগ্রিকভাবে দেশ ও আওয়ামী লীগের সামনে বিশাল সংকট বয়ে আনে। বলা যেতে পারে, সেসময় শেখ হাসিনাসহ দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন! জেলা সফরের কর্মসূচি সংক্ষিপ্ত করে শেখ হাসিনা ও তার সফর সঙ্গীরা ঢাকায় ফিরে আসেন।
এ সময় পর্দার আড়ালে প্রধান ‘নট’ হিসেবে আবির্ভূত হন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে সিএমএইচের রোগশয্যা থেকে উঠিয়ে এনে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেয়া হয়। সংবিধানমতে, কিছুদিনের মধ্যেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেরও ব্যবস্থা করা হয়। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফলাফল কী হতে পারে, শেখ হাসিনা তা আগেই অনুমান করেছিলেন। তবু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা ছিল সম্ভাব্য সামরিক শাসনের চেয়েও গণতন্ত্র চর্চায় সহায়ক। বিরোধী দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ প্রার্থী দেয়ার কৌশল ত্যাগ করে তিনি ড. কামাল হোসেনকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দান করেন। নির্বাচনে যথারীতি জেনারেল এরশাদের গোপন অভিলাষ অনুযায়ী বিচারপতি সাত্তারকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিএনপি জয়লাভ করলেও দেশের বৃহত্তম দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়। নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় তৃণমূল পর্যন্ত ড. কামাল হোসেনের একটা পরিচিতি দাঁড়িয়ে যায়।
ঐক্যের প্রতীক হিসেবে দলের সভাপতি নির্বাচিত হলেও, বাস্তবে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতাদের একটি অংশ শেখ হাসিনাকে ঠিক মানতে পারছিলেন না। বস্তুত শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আগে থেকেই আওয়ামী লীগে তীব্র দলীয় কোন্দল চলছিল। ফলে শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আগেই আওয়ামী লীগে ভাগ বিভক্তি দেখা দিয়েছিল। ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনের আওতায় রাজনীতি করার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। রাজনৈতিক দলবিধি নামে একটি অর্ডিন্যান্স জারি এবং ঘরোয়া রাজনীতির সুযোগ দেয়া হয়। সেই সুযোগে ১৯৭৭ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হয়। পুরোনো কমিটির সহ-সভাপতি মহিউদ্দিন আহমদকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং মহিলাবিষয়ক সম্পাদক সাজেদা চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করে আওয়ামী লীগের নবযাত্রা শুরু হয়।
স্বল্পকাল পরেই পুরোনো কমিটি বিলুপ্ত করে জোহরা তাজউদ্দীনকে আহ্বায়ক করে নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়। ইতোমধ্যে আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ জেল থেকে বেরিয়ে আসেন। ১৯৭৮ সালের ৩, ৪ ও ৫ মার্চ হোটেল ইডেনে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এই কাউন্সিলে দলে সুদৃঢ় ঐক্য প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা, নতুন করে ভাঙন সৃষ্টি হয়। কাউন্সিলে আবদুল মালেক উকিলকে সভাপতি ও আবদুর রাজ্জাককে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করা হয়; কিন্তু কাউন্সিল থেকে বেরিয়ে প্রবীণ নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী আওয়ামী লীগের নামে স্বতন্ত্র কমিটি গঠন করেন। সমসাময়িককালে সিলেটের দেওয়ান ফরিদ গাজী ও ঢাকা মহানগরীর মোজাফ্ফর হোসেন পল্টুও একটি আলাদা আওয়ামী লীগ গঠন করেছিলেন। মালেক উকিলের নেতৃত্বাধীন মূল আওয়ামী লীগেও প্রকাশ্যে দুটি উপদল দলের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলেছিল।
আর এ পটভূমিতে, বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি কাউন্সিলে দলের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে শেখ হাসিনাকে সভাপতি নির্বাচিত করে। শেখ হাসিনা দলের সম্মিলিত ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে, দেশের ডাকে মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন। সবার সহযোগিতায় দলকে পুনর্গঠনের জন্য বিপুল কর্মযজ্ঞ শুরু করেন; কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে সভাপতি করলেও দলের অভ্যন্তরে কোন্দল চলতেই থাকে। সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক চেয়েছিলেন শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ তার অঙ্গুলি হেলনে চলবে; কিন্তু শেখ হাসিনা নমনীয় নীতি এবং সবাইকে নিয়ে চলার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দলকে সুসংগঠিত করতে চাইলেও, কিছুসংখ্যক উচ্চাকাঙ্ক্ষী নেতার সংকীর্ণতার জন্য তা সে মুহূর্তে হয়ে ওঠেনি। ১৯৮৩ সালে আবদুর রাজ্জাক ও প্রবীণ নেতা মহিউদ্দিন আহমেদ দল থেকে বেরিয়ে যান। তারা ‘কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ অর্থাৎ ‘বাকশাল’ নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন।
দলের এই অনাকাঙ্ক্ষিত ভাঙন ছিল প্রচণ্ড আঘাতস্বরূপ। বাকশাল নিয়ে আওয়ামী লীগে এক ধরনের ভাবাবেগ ছিল। আবদুর রাজ্জাক এই ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে দলের প্রতিটি অঙ্গসহযোগী সংগঠনে ভাঙন সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ অনুসারী তরুণদের একটি বড় অংশ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। বলা যেতে পারে, একটা অগ্নিপরীক্ষায় পড়েন শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু-হত্যার ফলে সৃষ্ট জাতীয় সংকট ম্যানেজমেন্টের যে সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য থেকে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসেন, সে সংকট মোচনের জন্য দল ও দেশবাসীকে প্রস্তুত করার আগেই তাকে নতুন নতুন সংকট মোকাবিলা করতে হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ও গুরুতর সংকট ছিল ১৯৮৩ সালে দলে আনুষ্ঠানিক ভাঙন।
এসব সংকটমোচনে তার হাতে একটা ‘বই’ ছিল। সেটি হচ্ছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামমুখর জীবন। ১৯৫৭ সালে দলের সভাপতি মওলানা ভাসানী তখন বিপুলসংখ্যক কর্মী নিয়ে দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে ন্যাপ গঠন করেছিলেন। দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব দলের সেই সংকটকালে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে চারণের বেশে সমগ্র বাংলাদেশ ঘুরে বেড়ান। আওয়ামী লীগ আবার শক্ত ভিতের ওপর শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ১৯৬৬ সালেও প্রায় একই রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তি সনদ ৬ দফা উত্থাপনের পর দলের সভাপতি মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, প্রভাবশালী নেতা আবদুস সালাম খান প্রমুখ দল থেকে বেরিয়ে যান। শেখ মুজিবকে দলের সভাপতির দায়িত্ব নিতে হয়। তিনি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও মনসুর আলীর মতো তার প্রায় সমবয়সী সহকর্মীদের নিয়ে প্রচণ্ড বৈরী পরিবেশে আওয়ামী লীগে নতুন প্রাণ সঞ্চারিত করেন।
আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতির ঐক্যের প্রতীক হিসেবে সর্ববৃহৎ জাতীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। পিতার অভিজ্ঞতা ও চারিত্রিক দৃঢ়তাকে পুঁজি করে শেখ হাসিনা উল্কার বেগে বাংলাদেশ চষে বেড়ান। তৃণমূল পর্যায়ে তার সরাসরি যোগাযোগ, নেতাকর্মীদের প্রকৃত মনোভাব উপলব্ধি করার ঐকান্তিক প্রয়াস এবং সামরিক স্বৈরতন্ত্রের নাগপাশ থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে একই সঙ্গে তার জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার উদ্যোগ দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে দেয়। আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে তিনি ১৫ দলীয় জোট গঠন করেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে গিয়ে তিনি জেল-জুলুমের শিকার হন।
১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫ দলীয় জোটের (কার্যত ১০-দল) অনিবার্য জয়কে ছিনিয়ে নেয় জেনারেল এরশাদ। মিডিয়া ক্যুর মাধ্যমে নির্বাচনের ফলাফল এরশাদ পাল্টে দেয়। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সিপিবি ও ন্যাপ ছাড়া ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও বাসদ প্রভৃতি বামদলগুলো ১৫ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে যায়। নানা ষড়যন্ত্র ও টানাপোড়েন সত্ত্বেও ক্রমেই আওয়ামী লীগ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। গোটা প্রায় আশির দশক এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনে দেশ উন্মাতাল ছিল। ১৯৮৬-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। শেখ হাসিনাও এ সময়ে কর্মী-সংগঠকের ভূমিকা অতিক্রম করে নিজেকে ‘জাতীয় নেতা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। সংসদে তার ভূমিকা দেখে এরশাদ প্রমাদ গোনে।
১৯৮৭ সালেই এরশাদ সংসদ ভেঙে দেন এবং ১৯৮৮ সালে ভোটারবিহীন নির্বাচনে তার রাবার স্ট্যাম্প সংসদ গঠন করেন। জননেত্রী শেখ হাসিনার কুশলী ভূমিকা এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে এরশাদবিরোধী ‘তিন জোট’-এর যুগপৎ আন্দোলন গড়ে ওঠে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতন হয়। ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে বিএনপিকে জয়ী করা হয়। এটি ছিল সিভিল-মিলিটারি ব্যুরোক্রেসির কারসাজি। সংসদে শেখ হাসিনার পক্ষে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধনী প্রস্তাব আনা হয়। নির্বাচনের আগে ‘তিন জোটের’ অঙ্গীকার (তথা বিএনপিরও) সত্ত্বেও বিএনপি সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে বিল আনা নিয়ে গড়িমসি করছিল; কিন্তু শেখ হাসিনার অনমনীয় ভূমিকা এবং তীব্র জনমতের চাপের কাছে বিএনপিকে সরকারিভাবে বিল আনতে হয়। দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
আজ তার নেতৃত্বে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ, বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন, প্রাথমিক ও নারী শিক্ষায় এগিয়ে যাওয়া, মেট্রোরেল চালু, কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণ, মহাকাশে নিজস্ব যোগাযোগ স্যাটেলাইট প্রেরণ, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে অগ্রগতি, পটুয়াখালীতে পায়রা সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, নারীর ক্ষমতায়ন প্রভৃতি বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে উন্নয়নের অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত (রোল মডেল) হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় এর আগে সম্ভব না হলেও, ২০০৯-১০ সালে জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধনীর বিল উত্থাপিত হয়। সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ মূলত ১৯৭২-এর সংবিধানের ধারায় চলে আসে। অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক ধারা তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় বাংলাদেশ ফিরে আসে। মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বছর পর শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেন। এটা বিশেষ একটা বিরল দৃষ্টান্ত। জীবনের ঝুঁকি, পাকিস্তানসহ রক্ষণশীল কোনো কোনো দেশ (যেমন তুরস্ক) প্রভৃতির চাপ এবং জঙ্গিবাদীদের সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কা মোকাবিলা করেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হয়। এর আগে বিচার করা হয় বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ডের আসামিদের।
শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে দিনবদলের সনদে বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে গড়ে তোলার রূপরেখা দিয়েছিলেন। এখন সেই রূপরেখা বাস্তবায়নের পর ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। আমরা অত্যন্ত গৌরবের সঙ্গে বর্তমান সরকারের বিশেষত রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার এসব সাফল্যের বিবরণ ইতোপূর্বে তুলে ধরেছি।
নূহ-উল-আলম লেনিন: রাজনীতিবিদ, গবেষক ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মুখপত্র মাসিক ‘উত্তরণ’-এর সম্পাদক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে