টাকা তুলে নিচ্ছে কোটিপতি আমানতকারীরা
শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর ব্যাংক খাতে শুরু হওয়া অস্থিরতার মধ্যেই তুলে নেওয়া হয়েছে বিপুল অঙ্কের টাকা। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে শুধু কোটিপতি বিনিয়োগকারীরাই ব্যাংক থেকে তুলে নিয়েছেন ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই-সেপ্টেম্বরে জমা টাকা উত্তোলন করার কারণে দেড় হাজারেরও বেশি মানুষের ব্যাংক হিসাবের স্থিতি কোটি টাকার নিচে নেমে গেছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৫ আগস্টের পর থেকে যে অস্থিরতা চলছে তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যাংক খাত। ইতিমধ্যে এস আলমের নিয়ন্ত্রণাধীন ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর বেহাল দশা। বিভিন্নভাবে তারল্য সহায়তা দিয়ে ব্যাংকগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। এখন কোটিপতিরাও যদি আমানত তুলে নিতে শুরু করে, তাহলে আরও তারল্য সংকটের মুখে পড়তে হবে।
তবে ব্যাংক থেকে কেন টাকা তুলে নেয়া হচ্ছে, তা নিয়ে নানা মত রয়েছে। একটি পক্ষ বলছে, আস্থাহীন হয়ে আমানতকারীরা আমানত তুলে নিচ্ছে। অন্যপক্ষের বক্তব্য- অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিজের কাছে রাখার প্রবণতা বাড়ছে। এই দুই পক্ষের বাইরেও অন্যরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের দাবি, মূল্যস্ফীতির ঘোড়দৌড়ে টিকে থাকতে কোটিপতিদের বড় একটি অংশ আমানত তুলে নিচ্ছে।
ব্যাংক কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ তাদের ঘনিষ্ঠজনরা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিতে পারেন। তবে ব্যাংকের হিসাব খোলার নথিপত্রে গ্রাহকের রাজনৈতিক পরিচয় লিপিবদ্ধ থাকে না বলে দালিলিকভাবে এ তথ্যপ্রমাণ করা সম্ভব নয় বলেও জানান তারা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) কোটি টাকার ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা কমেছে ১ হাজার ৬৫৭টি। একই সময় কোটি টাকার ব্যাংক হিসাব থেকে ২৬ হাজার ১৮৭ কোটি টাকার আমানত তুলে নিয়েছেন গ্রাহকরা।
তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের সেপ্টম্বর পর্যন্ত এক কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে, এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ১ লাখ ১৭ হাজার ১২৭টি। কোটি টাকার ওপরে এসব ব্যাংক হিসাবে মোট জমা আছে ৭ লাখ ৪৬ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা। এ বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক অর্থাৎ এপ্রিল-জুন সময়ে এক কোটি টাকার বেশি আমানতের ব্যাংক হিসাব ছিল ১ লাখ ১৮ হাজার ৭৮৪টি। ওই প্রান্তিকে এসব ব্যাংক হিসাবে জমা ছিল ৭ লাখ ৭৩ হাজার ৫৪ কোটি টাকা।।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আতঙ্কের কারণে ক্ষুদ্র আমানতকারীরা টাকা তুলে নিচ্ছেন; কিন্তু কোটিপতিদের অর্থ দুর্বল ব্যাংকগুলো দিতে পারেনি। আবার অনেকেই দুর্বল ব্যাংক থেকে টাকা তুলে তাদের সবল ব্যাংকে থাকা হিসাবে জমা করেছেন। এতে অনেকের একাধিক ব্যাংকে থাকা টাকা এক ব্যাংকে জমা হওয়ায় তা কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই হিসাব অনুযায়ী কোটি টাকার হিসাব সংখ্যা বাড়ার কথা।
কোটি টাকার হিসাব মানেই কোটিপতি নাগরিকদের হিসাব নয়। কেননা, অনেক ব্যক্তিই যেমনি ব্যাংকে ১ কোটি টাকার বেশি অর্থ রাখেন, তেমনি অনেক প্রতিষ্ঠানও তা করে। অর্থাৎ কোটি টাকার ব্যাংক হিসাব বলতে যুগপৎ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান উভয়ের কথাই বলা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কতটি ব্যাংক হিসাব খুলতে পারবে, তারও কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই। ফলে এক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির একাধিক হিসাবও রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কোটি টাকার হিসাবও রয়েছে।
দেশে প্রকৃত কোটিপতির সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না। ফলে কত মানুষের কোটি টাকা রয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান মেলে না। তবে ব্যাংকে কোটি টাকার হিসাব সংখ্যা থেকে একটা ধারণা পাওয়া যায়। কোটি টাকার ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা করোনা মহামারির পর থেকে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৭৫ সালে কোটি টাকার ব্যাংক হিসাব ছিল মাত্র ৪৭টি, যা ২০১৫ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৫৭ হাজার ৫১৬টি। করোনা মহামারির শুরুতে- ২০২০ সালের মার্চে এই সংখ্যা ছিল ৮২ হাজার ৬২৫, যা বর্তমানে ১ লাখ ১৭ হাজারে উন্নীত হয়েছে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে