পাকিস্তানে বাল্যবিয়ে: বছরে শিকার ৬ লাখের বেশি নারী
পাকিস্তানে বছরে ছয় লাখেরও বেশি বাল্যবিবাহ হয়েছে, যা দেশটিতে বসবাসকারী নারীদের ওপর বেশ কয়েকটি বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।
এশিয়া নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাল্যবিবাহের এই উচ্চহার পাকিস্তানে মেয়েদের জীবনকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। যার ফলে তারা স্কুল ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে, অল্প বয়সে সন্তান জন্ম দিতে এবং পরিবার পরিচালনা করতে বাধ্য হচ্ছে। অথচ তাদের জন্য, খেলার পার্ক কিংবা নদীর তীরে বন্ধুদের সঙ্গে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ানোই খুব স্বাভাবিক ছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানে বছরে ৬ লাখের বেশি বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটে। দেশটিতে প্রায় ১ কোটি ৯০ লাখ বাল্যবধূ রয়েছে; প্রতি ৬ জন তরুণীর মধ্যে ১ জনের বিয়ে হয় অপরিণত বয়সে।
পাকিস্তান ডেমোগ্রাফিক হেলথ সার্ভে ২০১৭-১৮ অনুযায়ী, সেখানে ১৩.৫ শতাংশ মেয়ে এবং ২.৬ শতাংশ ছেলে বাল্যবিবাহের শিকার। জরিপে দেখা গেছে, দেশের ৩.৬ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৫ বছর বয়সের আগে; ১৮.৩ শতাংশ ১৮ বছর বয়সের আগেই বিয়ে হয়ে যায়। উল্লেখিত সময়ে বাল্যবিবাহের হার ছিল ২৩ শতাংশ, যার ফলে জাতীয় কোষাগারের ৮০০ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
ইউএন উইমেন ও ন্যাশনাল কমিশন অন দ্য স্ট্যাটাস অব উইমেনের একটি যৌথ গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, বাল্যবিবাহের ফলে মৃত্যুহার অস্বাভাবিকভাবে উচ্চহারে ঘটে। প্রতিবেদনে অনুমান করা হয়েছে যে, অল্প বয়সে সন্তানধারণ ও প্রজনন স্বাস্থ্য অনুশীলন সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে মৃত্যুহার অনেক বেড়ে যায়, যার ফলে এক বছরে দেশের ৬৩৬ বিলিয়ন রুপি ব্যয় হয়। বাল্যবিবাহের কারণে সন্তান জন্মহার বার্ষিক ২১ শতাংশ ও শিশু মৃত্যুহার ২২ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
জাতিসংঘের যৌথ প্রতিবেদনে আরও কিছু বিষয় স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাল্যবিবাহের কারণে বাল্যবিবাহের কারণে ৬ লাখ ৩১ হাজারের বেশি নারী শিক্ষার্থী হয় স্কুলে যেতে পারে না অথবা, ক্লাস ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। এই তালিকায়, পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে ৩ লাখ ৬০ হাজার, খাইবার পাখতুনখোয়া থেকে ১ লাখ ৩৬ হাজার, সিন্ধু থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার ও বেলুচিস্তান থেকে ২৮ হাজার ৮০০ জন রয়েছে।
বাল্যবিবাহকে পারিবারিক সহিংসতার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পাঞ্জাবে পারিবারিক সহিংসতার প্রায় ১৪ শতাংশ ঘটনাকে বাল্যবিবাহের জন্য দায়ী করা হয়। সিন্ধুতে এই হার ৪২ শতাংশ, খাইবার পাখতুনখোয়ায় ৫৩ শতাংশ ও বেলুচিস্তানে ৫০ শতাংশ।
বাল্যবিবাহও নারীদের হঠাৎ করে ঘরের বাইরে গিয়ে করা চাকরি ছাড়তে বাধ্য করে। একারণে প্রায় ২১ শতাংশ চাকরিজীবী নারী ঝরে যায়, অনুমান করা হয়, এরফলে মজুরিতে পরোক্ষ বার্ষিক ক্ষতি হয় প্রায় ২৬.৮ বিলিয়ন রুপি।
যদিও পাকিস্তান ১৯৯০ সালে শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষর করেছে, যার অধীনে ১৮ বছরের নিচে বিয়ের ঘটনাগুলো শিশুদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। কেননা, রাষ্ট্র এত বিপুলসংখ্যক বাল্যবিবাহ রোধে খুব কমই দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বাল্যবিবাহের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষতিকর ফলাফল হিসেবে দুর্বল স্বাস্থ্য ও যৌন নির্যাতনকে উল্লেখ করেছেন। পাকিস্তানের পরিবার পরিকল্পনা সমিতির সদস্য সংগঠন রাহনুমার অ্যাডভোকেসি ও কমিউনিকেশন ম্যানেজার আমজাদ লতিফ বলেন, তাদের চিকিৎসাকেন্দ্রে যাওয়া অনেক নারীই বাল্যবিয়ের কারণে স্বাস্থ্যগত সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন। তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন যে, অজ্ঞতা ও আর্থিক স্বাধীনতার অভাবের কারণে অল্প বয়সী মেয়েরাও যৌন নির্যাতনের মুখোমুখি হয়।
পাকিস্তানের বিপুলসংখ্যক নারী এইভাবে এমন একটি সংস্কৃতির সাথে আবদ্ধ থাকে, যা তাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদে গুরুতর স্বাস্থ্যগত ও মানসিক সমস্যা সৃষ্টি করে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে