Views Bangladesh Logo

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম

অপতথ্যের বেড়াজালে বাংলাদেশ

Kamrul  Hasan

কামরুল হাসান

  • বাংলাদেশ যখন ডিজিটাল সংযোগ ও আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তির সুবিধা পেতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে তখন দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা সাইবার প্রচারণা ও অপতথ্যের বেড়াজালে আটকে পড়ছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ ক্যাম্পেইন গত কয়েক বছর ধরে বুমেরাং হয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের ভাবমূর্তি বহুলাংশে ক্ষুণ্ন করেছে।

    ২০০০ সালের শুরু থেকে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি), কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও কনজেক্টিভ ডাটাবেসের ব্যবহারকে উৎসাহিত করছে, যা শুধু অটোমেশনকে সহজতর করতে স্মার্ট প্রযুক্তিকে সক্রিয়ই করে না, একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগও স্থাপন করে। বাংলাদেশ প্রথম দুটি শিল্প বিপ্লবে জায়গা করে নিতে পারেনি।  দুঃখজনক হলেও সত্য যে, শেষ দুটি প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকলেও তৎকালীন সরকারগুলো দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

    ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের ইশতেহার সামনে রেখে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার প্রথমবারের মতো দেশের মানুষকে ডিজিটাল বিপ্লবের প্রকৃত সুফল আস্বাদন করার সুযোগ করে দেয় ২০১০ সালের পর। তবে ডিজিটাল প্রযুক্তি ও সেবার সুবিধা গ্রহণের ফলে দেশকে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী হতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারকে অনেক অসুবিধারও সম্মুখীন হতে হয়েছে।

    ২০১২ সাল থেকে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে দ্রুত অ্যাক্সেসের ফলে সাইবার প্রচার, অপতথ্য ও গুজব ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে, যা পরবর্তীতে বেশ কয়েকটি সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক আগ্রাসনে বিশেষভাবে ভূমিকা রেখেছে। সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন এই দাবির পক্ষে সবচেয়ে খারাপ উদাহরণ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।

    সাইবার ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, কোটা সংস্কার নিয়ে চলা বিক্ষোভের সময় সংঘর্ষ, বিক্ষোভ ও সহিংসতার আগুনে ঘি ঢালতে অপতথ্য প্রধান ভূমিকা পালন করেছে।

    অপতথ্য কী ও কীভাবে কাজ করে?
    সাউথ ওয়েস্ট গ্রিড ফর লার্নিং ট্রাস্টের (এসডব্লিউজিএফএলটি) মতে, ‘অপতথ্য’ বলতে মূলত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়া অসত্য তথ্যকে বোঝানো হয়। তার পেছনে বিভ্রান্তি ছড়ানোর উদ্দেশ্য থাকুক বা না থাকুক, সেটিকে অপতথ্য হিসেবেই ধরা হয়। 'ভুয়া খবর' ও ভুয়া ডিজিটাল কনটেন্টের জন্য অপতথ্য আরও বেশি প্রচার পায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর মতো বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে এসব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

    সোশ্যাল মিডিয়া এখন হাতে হাতে। ফলে অপতথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সাধারণ মানুষের মনে ভয় ধরিয়ে দেয় এসব ভুলতথ্য। সাধারণ মানুষ সত্য-মিথ্যাও যাচাই করে না।

    যুক্তরাষ্ট্রের নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. জেমস অ্যালান ফক্স অপতথ্য ছড়ানোর বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি বেশ কিছু চিন্তা-উদ্দীপক বিষয় তুলে ধরেছেন, তার মতে, "ভুয়া খবর ছড়ানোর পেছনে প্রধান কারণটি দ্রুত জনপ্রিয় হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, মিডিয়ার অতিরঞ্জিত কাভারেজ। অনেক সময় ভুল বুঝলেও আমরা ভয়ের মুখে চুপ থাকি। এতে ফল আরা খারাপ হয়।”

  • পুলিশের অ্যান্টি-টেররিজম ইউনিটের (এটিইউ) কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, জঙ্গিবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে মোট ২৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যাদের মধ্যে ৮২ শতাংশই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত উগ্রবাদী চেতনাদ্বারা প্রভাবিত হয়েছে।

    অপতথ্য সংঘাতকে উসকে দেয়
    বড় বড় সহিংস ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, রাজনৈতিক আন্দোলন ছাড়াও অপতথ্য নানারকম উচ্ছৃঙ্খল কাজের পেছনে মূল ভূমিকা পালন করে। যা সহিংসতাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যায় যা সরকারের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে এর আগেও বেশ কয়েকটি সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও জঙ্গি হামলা হয়েছে, যেখানে অপতথ্য বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।

    ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে মাসে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায় জঙ্গি আক্রমণের শিকার হয়। উত্তম বড়ুয়া নামে এক বৌদ্ধ যুবক ফেসবুকে ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করেছে, এই অজুহাতে এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা চালানো হয়েছে। ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলায় হিন্দুদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা চালানোর পেছনেও একই কারণ খুঁজে পাওয়া গেছে। ২০১৭ সালে প্রায় একই রকম ঘটনা ঘটে রংপুর সদর ও গঙ্গাচর এলাকায়। উসকানিমূলক পোস্টের কারণে হিন্দু সম্প্রদায়ের অর্ধশতাধিক বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়। ব্যাপক লুটপাট করা হয়।

    সর্বশেষ ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে দুর্গাপূজা চলাকালে গোটা বাংলাদেশজুড়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর এমন তাণ্ডব চালানো হয়েছিল। ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর এসব ঘটনা ঘটে। যেখানে দেখা যায় মন্দিরের প্রতিমার পায়ে কোরআন শরিফ রাখা হয়েছিল। পরবর্তীতে সারা বাংলাদেশে ধর্মীয় সহিংসতার ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে কুমিল্লা ও চাঁদপুরের বেশ কয়েকটি মন্দির ভাঙ্চুর করা হয়। অস্থায়ী পূজা মণ্ডপেও ব্যাপক হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়।

    সাইবার গুজব ছড়িয়ে পড়ায় দেশের অনেক মুক্তমনা, ব্লগার ও লেখকদের ওপরেও একাধিক আক্রমণ চালানো হয়ে। অনেককে হত্যা করা হয়।

    কোটা সংস্কার আন্দোলনে অপতথ্যের ভূমিকা
    কোটা সংস্কারপন্থিদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে সব ধরনের কোটা বিলুপ্ত করে; কিন্তু চলতি বছরের ৫ জুন হাইকোর্ট সরকারের ২০১৮ সালের প্রজ্ঞাপন বাতিল করে দিলে আবারও সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি সচল হয়। রায় ঘোষণার পরপরই আদালতের আদেশের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা আবারও রাস্তায় নেমে আসেন।

    গত ১৪ জুলাই মাসে গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “কোটা ইস্যুতে আমার কিছু করার নেই। বিষয়টি বিচারাধীন এবং এটি আদালতে নিষ্পত্তি হবে।”

    এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে জানতে চান, “মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিরা যদি কোটা সুবিধা না পায়, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-নাতনিরা পাবে, জাতির কাছে জানতে চাই?”

    প্রধানমন্ত্রীর কথাকে নানাভঅবে বিকৃত করা হয়। ফেসবুকের মাধ্যমে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর আংশিক বক্তব্য দেখে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা 'তুমি কে? আমি কে? রাজাকার। রাজাকার। কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।” স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে।
    কিন্তু সেই রাতে (১৪ জুলাই) এই স্লোগান দ্রুত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যা জনগণের মধ্যে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয় এবং একটি উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।

    প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের নিন্দা জানিয়ে পরদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসেন। পরে ছাত্রলীগের সদস্যদের সঙ্গে সংঘর্ষে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বিক্ষোভ তীব্রতর হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে । এই ঘটনায় প্রায় ১৫০ জন নিহত ও অনেকে আহত হন।

    পরবর্তীতে গত ২৭ জুলাই প্রধানমন্ত্রী গণমাধ্যমে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, তিনি আন্দোলনকারীদের রাজাকার বলেননি।

    বাঁশের কেল্লা, নয়নের (সন্ত্রাস ছড়ানো ও উসকানি দেয়ার অন্যতম প্রধান পেজ) মতো বেশ কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পেজে সহিংস তাণ্ডবকে কেন্দ্র করে তাদের পেজের মাধ্যমে একাধিক মিথ্যা তথ্য, ভুয়া ভিডিও ও গুজব ছড়াতে দেখা গেছে। এই গুজবগুলো স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি করে। পরিস্থিতি চরম প্রতিকূল হয়ে ওঠে। যদিও ইন্টারনেট সেবা সম্পূর্ণ বন্ধ থাকায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।

    ফ্যাক্ট চেকিং বিশেষজ্ঞ কাদের উদ্দিন শিশির বলেন, “একটি সুনির্দিষ্ট দাবিতে যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, তা নানা দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। নিশ্চিতভাবেই অনেক অসত্য তথ্য ছড়িয়ে পড়া সহিংসতাকে আরও তীব্রতর করেছে।”

    তিনি দাবি করেন, উভয়পক্ষই সহিংসতাকে কেন্দ্র করে তাদের নিজ নিজ ফেসবুক পেজে মিথ্যা তথ্য প্রচার করেছে।

    সাইবার নিরাপত্তা পদ্ধতিতে অনলাইন প্রচারণা মোকাবিলাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে
    ২০২৩ সালের ১৭ নভেম্বর মাসে সরকার নতুন 'ন্যাশনাল সাইবার সিকিউরিটি এজেন্সি' গঠন করে একটি সরকারি গেজেট প্রকাশ করেছে, যা আগের 'ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সি'র স্থলাভিষিক্ত হবে। সরকারি সূত্রের খবর, অনলাইন যোগাযোগের উপর নজরদারি ও সাইবার অপরাধ মোকাবিলার দায়িত্বে থাকবে সাইবার সিকিউরিটি এজেন্সি। তবে সংস্থাটির পক্ষ থেকে এখনো কোনো উল্লেখযোগ্য তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি।

    দেশের সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা প্রধান ইউনিট হচ্ছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের আওতাধীন কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের অধীনে সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন।

    যোগাযোগ করা হলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স ডিসি মো. ফারুক হোসেন বলেন, প্রয়োজন উপলব্ধি করে ডিএমপি গত এক দশকে সাইবার সিকিউরিটি ইউনিটকে শক্তিশালী করছে। আরও কর্মকর্তা মোতায়েন করা হয়েছে, তদন্ত দল মোতায়েন করা হয়েছে এবং ইউনিটটি মিথ্যা তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াইসহ সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তাদের সর্বোচ্চ শ্রম দিয়ে যাচ্ছে।

    তবে জেলা বা মহানগর পর্যায়ে স্থাপিত সকল ইউনিটকে সমন্বয় করার জন্য বাংলাদেশ পুলিশ হেডকোয়ার্টারে কোনো সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সি নেই।

    কাদেরউদ্দিন শিশির বলেন, সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দারুণ কিছু কাজ করছে। তবে তাদের ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

    কোটা সংস্কার আন্দোলনের পর সরকারের উচিত বিষয়টি আরও গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেয়া। কেননা, ভবিষ্যতে অসত্য বা ভুয়া তথ্যের ক্ষতি ঠেকাতে সরকারের সামনে বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ