Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

মব জাস্টিস সীমাহীন উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে

Chiroranjan  Sarker

চিররঞ্জন সরকার

বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

'মব জাস্টিস' কথাটা ইদানীং বেশ চলছে। ‘জাস্টিস’ কোনো কারণে ফেইল করলে আমজনতা জাস্টিসের ভারটা হাতে তুলে নেয়। কেউ একে বলে গণপিটুনি। কেউ বলে উন্মত্ত জনবিচার। গত ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে বিরামহীনভাবে মব জাস্টিস চলছে। বর্তমানে তা সীমাহীন উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই মব জাস্টিস এখনই থামাতে না পারলে দেশের বিচারব্যবস্থা, আইশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, বৈদেশিক বিনিয়োগ, সর্বোপরি দেশের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়বে।

এই মব জাস্টিস যখন শুরু হয়, তখন এটাকে অনেকেই বিগত সরকারের প্রতি মানুষের সীমাহীন ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন; কিন্তু এটা থেমে গিয়েও থামেনি। কিছু মানুষের উসকানিতে এটি আবার নতুন করে শুরু হয়। শিক্ষার্থীদের সামনে রেখে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী মব জাস্টিসকে জিইয়ে রাখে। প্রথমেই বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, উপাসনালয়ে হামলা করা হয়। গুঁড়িয়ে দেয়া হয় বিভিন্ন ভাস্কর্য। এরপর শুরু হয় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর নির্যাতন। অনেক শিক্ষককে অবরুদ্ধ করে কিংবা শক্তি প্রয়োগ করে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। যাদের মধ্যে অনেক নিরীহ ও যোগ্য লোকও ছিলেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে মোরাল পুলিশিংয়ের বিষবাষ্প ঢুকিয়ে দেয়া হয়। তারা নানা জায়গায় খবরদারি শুরু করে। অকারণে অনেককে হয়রানি এবং অপমানও করে। এরপর শুরু হয় মাজার-দরগাঁ গুঁড়িয়ে দেয়ার অভিযান।

এসবের বাইরে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দলবদ্ধভাবে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনাও ঘটতে থাকে। এসব ঘটনা সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। এখনো পারছে না। সরকারি উদ্যোগহীনতা ও ব্যর্থতার সুযোগে মব জাস্টিস অপ্রতিহত গতিতে চলছে। অনেক জায়গাতেই ছাত্রদের মব জাস্টিসের বিষয়টিকে স্বার্থান্বেষীরা লুটপাট ও প্রতিহিংসার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করেছে। গাজী টায়ার্সের কারখানায় একাধিকবার অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এর ফলে বেকার হয়ে গেছে এই কারখানায় কাজ করা ৪-৫ হাজার শ্রমিক। এখন এদের চাকরি কে দেবে? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই!

মব জাস্টিস বা মব লিঞ্চিং একটা মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি। এটা একটা ঘৃণ্য অপরাধ। এর ইতিহাস অনেক বহু পুরোনো। সম্ভবত যিশুই সব থেকে বিখ্যাত ব্যক্তি, যিনি ‘লিঞ্চিং’-এর শিকার। অবশ্য ওইভাবে শাস্তি দেয়াটা সে কালের নিয়ম ছিল। উন্মত্ত জনতার হাতে ‘ঈশ্বর’-এরও ছাড় নেই! ‘লিঞ্চিং’ বরাবরই শাসক ও প্রতিষ্ঠানের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতে পুষ্ট নিয়ন্ত্রণের একটি বড় হাতিয়ার। প্রাচীন ইতিহাসে যার সফল প্রয়োগ দেখা গেছে পারস্য, গ্রিস, রোমে। বিদ্রোহ আর বিরুদ্ধ-মতকে ঠান্ডা করতে প্রথমে লিঞ্চিং, তার পরে ক্রুশে চড়ানো, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেহগুলো ক্রুশবিদ্ধ অবস্থাতেই রাখা হতো। জন্তু-জানোয়াররা যাতে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলে। গোটা প্রক্রিয়াটিই করা হতো জনবহুল এলাকায়, সকলের সামনে। বিরুদ্ধাচরণের ভয়াবহ ফল বুঝিয়ে দেয়াটা সে দিনের শাসকের পক্ষে খুবই জরুরি ছিল যে!

মব জাস্টিসের কারণ অনেক গভীর। বলে রাখা ভালো, এই মব জাস্টিস একটি জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত ও সামাজিক সমস্যা। যখন গুটিকয়েক লোক বা বিশাল জনতা উন্মত্তভাবে নিজেদের হাতে বিচার তুলে নেয় এবং এক বা একাধিক মানুষকে অপরাধী সাব্যস্ত করে তাদের গণধোলাই দেয়, সে ক্ষেত্রে উন্মত্ত জনতা নিজেরাই অভিযোগকারী, নিজেরাই বিচারক, নিজেরাই আইনজীবী এবং নিজেরাই হাতেনাতে দণ্ডদাতা। আর এই পুরো প্রক্রিয়াটাই খুব অল্প সময়ে ঘটে যেখানে সেই দুর্ভাগা অভিযুক্তের কিছু বলার বা করার কোনও সুযোগই থাকে না। এদের নিয়তি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয় চরম শারীরিক বা মানসিক আঘাত, নয় মৃত্যু। এই উন্মত্ত জনবিচারের পরিসরটি এক মুহূর্তের জন-মানসিকতা তৈরি করে যেখানে ব্যক্তিগত চরিত্র, জীবন, পেশা, বুদ্ধি ও বিচারের মন কাজ করে না। এই জনমন ব্যক্তিকে তার মতামত, ধারণা এবং কাজ থেকে পৃথক করে এক ধরনের যৌথমন তৈরি করে যেখানে ব্যক্তি তার অনুভব, তার চিন্তা এবং তার কাজ করার ক্ষমতা থেকে বিরত থেকে এক বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বিরাজ করে।

গুটিকয়েক মানুষ এই অত্যাচার শুরু করে, পরে সংক্রমিত হয়ে উন্মত্ত জনতাই সেই বিচার মেনে নিয়ে আরও বেশি করে অত্যাচার করে। যে সমাজে অজ্ঞানতা, অরাজকতা সর্বব্যাপী, ন্যায়বিচার বিলম্বিত, আইনব্যবস্থায় অনাস্থা প্রবল, সেখানে উন্মত্ত জনবিচার এক বড় সমস্যা। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তাই উন্মত্ত জনবিচার প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দেখা দিচ্ছে। আফ্রিকার দেশগুলোতে এটা দৈনন্দিন ঘটনা। এশিয়ায় এবং ভারতে, এই ব্যাধি ভয়ংকরভাবে বাড়ছে। যে কোনো সমাজেই মানুষ সুস্থভাবে শান্তিতে জীবনযাপন করতে চায়। তার জন্য তারা কিছু সামাজিক রীতিনীতি ও আচরণবিধি পালন করে। যদিও প্রশ্নের অবকাশ থেকে যায়, তবুও বলা যায় যে বেশির ভাগ লোকই এই বিধি ও নীতিমালা মেনে চলে; কিন্তু কিছু লোক এগুলো থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। তারা শুধু বর্তমানটাই দেখে, ভবিষ্যৎ তাদের কাছে মূল্যহীন। উন্মত্ত জনবিচারকরা এই দ্বিতীয় দলের। যে বা যারা গণপিটুনিতে চিহ্নিত হয়েছে তারা এখন কীভাবে তাদের পরিবার, প্রতিবেশী ও সমাজে মুখ দেখাচ্ছে সেটা ভাবার, সেটা দেখার। সমাজ বা পরিবার তাদের প্রতি কী আচরণ করে সেটাও দেখার। এটা দেখার যে, পিটুনিবাজরা মুখ লুকিয়ে আছে না সমাজের কাছে কৃতিত্ব দাবি করছে।

বেশির ভাগ হিংসাত্মক ঘটনার মতো, উন্মত্ত জনবিচারেরও তিনটি প্রধান স্তম্ভ: হিংসাকারী, হিংসার শিকার আর মজা লোটা দর্শক। এই দর্শকরা প্রায়শই দ্রুত হিংসাকারীতে পরিবর্তিত হয়, তাদের সংখ্যা খুব দ্রুত বাড়তে থাকে। ফলে হিংসাভোগীর মানসিক ও শারীরিক আঘাতের মাত্রাও বাড়তে থাকে, যা অনেক সময় মৃত্যুর কারণ হয়। কয়েক বছর আগেও আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক রীতিনীতি ও শৃঙ্খলার সংহতি বেশি ছিল, তাই এ ধরনের যুথবদ্ধ অন্যায়ের প্রতিবাদ তুলনায় কার্যকর হতো। দর্শকদের থেকেই প্রতিবাদ আসত, ফলে হিংসাকারীর সংখ্যা বাড়ত না। এখন অনেক সময়েই ঘটে ঠিক উল্টো। প্রতিবাদ এখনও হয়। হচ্ছেও। কিন্তু সেটা দূরের, পরের, আবেগের বা ক্ষোভের প্রকাশ। সেটা ভালো; কিন্তু তার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ থেকেই যায়। প্রতিবাদ আসা উচিত ওই সামাজিক অপরাধীদের পরিবার থেকে, তাদের প্রতিবেশীদের থেকেও। মনে রাখা উচিত, ব্যক্তি থেকে পরিবার থেকে প্রতিবেশী থেকে সমাজ। তাই যে সমাজ আমরা দেখতে চাই, পরিবার ও প্রতিবেশীকে সেই রকম ব্যক্তির দল তৈরি করতে হবে। দোষ দেয়া সহজ। কারণ খোঁজা কঠিন। অন্যকে দোষ না দিয়ে কারণ খুঁজতে হবে।

অন্তর্বর্তী সরকারকে দ্রুত গা-ঝাড়া দিয়ে দাঁড়াতে হবে। এক মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরও পুলিশ ও প্রশাসনকে সক্রিয় করতে না পারা ভালো কথা নয়। ৫ আগস্টের পর দেশের বেশিরভাগ থানা জ্বালিয়ে দেয়া, আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানোর জন্য ‘খুনি’ হিসেবে চিহ্নিত করে পুলিশকে পুরোপুরি শত্রুপক্ষে ঠেলে দেয়া হয়েছে। অনেককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মারের ভয়, চাকরির ভয়, আসামি হওয়ার ভয়সহ নানা কারণে পুলিশ প্রায় অকার্যকর হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে চরম ভীতি কাজ করছে। প্রায় লক্ষাধিক পুলিশ সদস্য এখনো কাজে যোগ দেয়নি। এদিকে প্রশাসনযন্ত্রও তছনছ করে ফেলা হয়েছে। সচিবালয়সহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এক দলের বদলে অন্য দলের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে, ঢালাও পদোন্নতি দেয়া হয়েছে, ফলে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, এমন কর্মকর্তারাও বঞ্চিত হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। এমনও হচ্ছে একেকজন কয়েকদিনের মধ্যে দুই দফা প্রমোশন পেয়েছেন কেবল আগে বঞ্চিত হওয়ার দোহাই দিয়ে।

পুলিশ ও প্রশাসন পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় কিছু মানুষ নিজেরাই রাষ্ট্রের অভিভাবক সেজে ভাঙচুর ও হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত অবিলম্বে এই নৈরাজ্য বন্ধ করা। এরকম বালখিল্য আচরণ থেকে দেশকে এবং দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলে আইনি কাঠামোর মধ্যে সব ন্যায় বিচার নিশ্চিত করবে হবে। এই তথাকথিত ছাত্র-জনতার মব জাস্টিসের মাধ্যমে নয়। সরকারকে আর দেরি না করে মব জাস্টিসওয়ালাদের হাতে-পায়ে আইনের বেড়ি পরাতে হবে। এজন্য যত দ্রুত সম্ভব পুলিশ ও প্রশাসনকে সক্রিয় করতে হবে। প্রয়োজনীয় সেনাবাহিনীর ভূমিকা ও তৎপরতা আরও বাড়াতে হবে। মনে রাখা দরকার যে, রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করে যে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়, সেই ফ্যাসিস্ট। দেশে নতুন করে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হোক, তা কেউ চায় না। ফ্যাসিবাদের পুনর্জন্ম রোধ করতে হবে। সেটা যে কোনো মূল্যে এবং এখনই।

লেখক: কলামিস্ট।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ