অপেক্ষমাণ শুনানির দোহাই দিয়ে চলছে মোবাইল কোর্ট
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে সারা দেশে ভ্রাম্যমাণ আদালত বা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছে সরকার। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা আইন ২০০৯-এর এক সংশোধনীর মাধ্যমে দোষীব্যক্তি দোষ স্বীকার না করলেও সাক্ষী ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে শাস্তি দেয়ার বিধান করা হয়েছে। যা বর্তমানে চলমান আছে। তবে এমন বিধান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মন্তব্য করেছেন আইনজ্ঞরা।
অন্যদিকে, ২০১৭ সালের ১১ মে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ২০০৯ সালের আইনের ১১টি ধারা ও উপধারা অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট৷ একইসঙ্গে, এই আইনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অবৈধ ঘোষণা করেন আদালত।
বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাসের হাইকোর্ট বেঞ্চের দেওয়া রায়ে বলা হয়, “নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া সংবিধানের লঙ্ঘন এবং তা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর আঘাত। এটি ক্ষমতার পৃথককরণ নীতিরও পরিপন্থী। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটসহ কর্ম-কমিশনের সব সদস্যরা প্রশাসনিক নির্বাহী। একজন নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে তারা প্রজাতন্ত্রের সার্বভৌম বিচারিক ক্ষমতা চর্চা করতে পারেন না।”
কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ এই রায় চ্যালেঞ্জ করে আপিলের আবেদন করলে তা গ্রহণ করে হাইকোর্টের রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করেন আপিল বিভাগ। আর সেই স্থগিতাদেশের ভিত্তিতে এখনো চলছে মোবাইল কোর্ট। প্রায় সাত বছর ধরে ওই আপিলের পূর্ণাঙ্গ শুনানি হয়নি।
২০২০ সালের ১৪ মার্চ রাতে অনলাইন সংবাদমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম রিগ্যানকে রাতের আঁধারে তুলে নিয়ে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিলো। পুলিশ ছাড়া আনসার নিয়ে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা দরজা ভেঙে আরিফুলের বাসায় ঢোকেন। এরপর তাকে মারধর শুরু করেন। পরে জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে নিয়ে ‘বিবস্ত্র' করে নির্যাতন করার অভিযোগও আনা হয়। পরে অবশ্য এই ঘটনায় শাস্তি পেতে হয় জেলার তৎকালিন ডিসিসহ সংশ্লিষ্ট মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারীদের।
সম্প্রতি তথ্য অধিকার আইনের অধীনে নকলা উপজেলার বিভিন্ন প্রকল্পের তথ্য চেয়ে আবেদন করেন সাংবাদিক শফিউজ্জামান রানা। এর জেরে গত ৫ মার্চ ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। এ ঘটনায় নকলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাদিয়া উম্মুল বানিন ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. শিহাবুল আরিফের বিরুদ্ধে ক্ষমতা ও আইনের অপব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। অন্যদিকে ইউএনও ও এসিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের অপব্যবহারের অভিযোগ দায়ের করেছেন সাংবাদিক রানার পরিবার। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, যে প্রক্রিয়ায় সাংবাদিক রানাকে সাজা দেওয়া হয়েছে তা যথাযথ হয়নি। এতে ভ্রাম্যমাণ আদালত সম্পর্কে জনমনে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য ইউএনও ও এসিল্যান্ড দুজনকেই শিগগিরই প্রত্যাহার করা হবে। পাশাপাশি তাদের দুজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হবে।
২০০৭ সালে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকের পর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার কার্যক্রমও বাতিল হয়ে যায়। তারপর ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে মোবাইল কোর্ট আইন জারি করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সংসদে এই অধ্যাদেশটি পাস না করায় তা বাতিল হয়ে যায়।
২০১৯ সালের ২০ আগস্ট চট্টগ্রাম চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কামরুন নাহার রুমী জেলার সব থানার অফিসার ইনচার্জদের সতর্ক করে একটি আদেশ জারি করেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন- ওসি’রা আটককৃত আসামিদের নিয়মিত আদালতে সোপর্দ না করে সংশ্লিষ্ট উপজেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, ইউএনও বা এসিল্যান্ডের সামনে উপস্থাপন করছেন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯ এর বিধান লঙ্ঘন করে আসামিদের আইনবহির্ভূতভাবে সাজা প্রদান করছেন। যা দেশের সংবিধান ও প্রচলিত অন্যান্য আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
মোবাইল কোর্ট বাতিলে রিটকারী আইনজীবী ব্যারিস্টার হাসান এম এস আজিম ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, “হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে হলে সরকারকে আইন সংশোধন ও বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটকে তা পরিচালনার ক্ষমতা দিতে হবে। মোবাইল কোর্টের অপব্যবহারের প্রশ্নের চেয়ে বড় কথা হলো এটা সংবিধানের মৌলিক নীতির পরিপন্থী। কারণ বিচারকাজে নিয়োজিত নয় এমন কেউ বিচার করতে পারেন না। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা বিচারক নন। সংবিধানে বিচার বিভাগ আলাদা ও স্বাধীন থাকার কথা বলা আছে। আর মোবাইল কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেটরা নিরপেক্ষ থাকতে পারেন না৷ কারণ তারা প্রশাসনের অধীন। পুলিশের কাজ বিচার করা নয়। যারা ম্যাজিস্ট্রেট তারা আইন পড়ে আসেন না। তাদের প্রশিক্ষণও নেই। তাই আমরা এখন মোবাইল কোর্টের অপব্যবহার দেখতে পাচ্ছি।”
তিনি আরও জানান, রাষ্ট্রপক্ষ মোবাইল কোর্ট বাতিল করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে। সেখানে আপিল বিভাগ একটি অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দিয়ে হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেছিলেন। কিন্তু এর পূর্ণাঙ্গ শুনানি গত সাত বছরেও শুরু হয়নি। ইচ্ছা করে মোবাইল কোর্ট টিকিয়ে রাখতে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল শুনানি ঝুলিয়ে রেখেছে।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, “সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, হাইকোর্ট অধস্তন আদালত নিয়ন্ত্রণ করবেন। অধস্তন আদালত মানে যাঁরা ম্যাজিস্ট্রেসি চালান। সেই অর্থে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, তা তাঁরা যে যেখানেই থাকুন না কেন, যাঁদের আমরা ঈদে বা অন্য সময়ে ভেজাল খাবার, ভেজাল ওষুধ ধরা বা র্যাবের সঙ্গে ক্যাসিনো অভিযানে যান, বিভিন্ন হোটেল রেস্তরাঁয় অভিযানে দেখি, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন ব্যাক্তিদের সাজা দিতে দেখি তাঁদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাবিধানের দায় হাইকোর্টের ওপর আপনা–আপনি বর্তায়। এখন তা শুধু জনপ্রশাসনই করছে। তারা সেটা দায়িত্বশীলতার সঙ্গে করছেন এমনটাও না। কিন্তু সংবিধান তাদের সেই দায়িত্ব দেয়নি। কারণ, ম্যাজিস্ট্রেসি নিয়ন্ত্রণ করার ভার সংবিধান নির্দিষ্টভাবে সুপ্রিম কোর্টকে দিয়েছে।”
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, “ন্যায়বিচার ছাড়া সমাজে শান্তি আসবে না। তবে ভয় দেখিয়ে ন্যায়বিচার হবে না। মোবাইল কোর্টের তাৎক্ষণিক বিচারের দর্শন আসলে ভীতি ছড়ানোর দর্শন। ভয় দেখানোর যন্ত্রগুলো জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা আত্মঘাতী।”
তিনি বলেন, “আমরা অবশ্যই দ্রুত বিচার চাই। হাইকোর্টের মোবাইল কোর্টগুলো সীমিত ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক রায় দেবেন। কিন্তু তাঁরা তা দেবেন দেশের প্রচলিত আইনের আওতায়। প্রমাণ দিতে হবে যে দেশের প্রচলিত আইনের অধীনেও দ্রুত বিচার করা যায়। কিন্তু তাতে ভুল বা গুরুতর ভুল আদেশের আশঙ্কা কম।”
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে