বাজেট ২০২৪-২৫
অর্থ পাচার কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়
অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী আজ বৃহস্পতিবার (০৬ জুন) জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেছেন। এটি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৩তম পূর্ণাঙ্গ বাজেট এবং বর্তমান সরকারের আমলে ধারাবাহিক ১৬তম বাজেট। আর অর্থমন্ত্রী হিসেবে আবুল হাসান মাহমুদ আলীর প্রথম বাজেট।
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নীয়নশীল দেশ, যেখানে আয় এবং ব্যয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা সম্ভব হয় না সেখানে বাজেট প্রণয়ন করা সব সময়ই অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ। প্রণীত বাজেটের মাধ্যমে সব মহলকেই সন্তুষ্ট করা যায় না। বৈশ্বিক এবং অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক বাস্তবতায় আগামী অর্থবছরের জন্য গ্রহণযোগ্য এবং সুশৃঙ্খল বাজেট প্রণয়ন করা সত্যি একটি কঠিন কাজ। অতীতে বাংলাদেশের আর কোনো বাজেট সম্ভবত এমন জটিল পরিস্থিতির মধ্যে প্রণয়ন করা হয়নি।
বিশেষ করে এমন কিছু জটিল সমস্যা দেশের অর্থনীতিকে আঁকড়ে ধরেছে, যা থেকে সহসাই উত্তরণ ঘটানো সম্ভব হবে না। এরপরও বাজেট প্রস্তাব প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটের সবচেয়ে জটিল এবং বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অর্থনীতিতে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা। ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী উচ্চ মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি হয়েছিল। বেশির ভাগ দেশ ইতোমধ্যেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি অনেকটাই সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সমর্থ হলেও বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ন্যূনতম সাফল্য প্রদর্শন করতে পারছে না।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার জন্য পণ্য আমদানি কমিয়ে আনার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে; কিন্তু এই উদ্যোগ অনেক ক্ষেত্রে হিতে বিপরীত হয়েছে। অর্থনীতিবিদদের প্রায় সবাই দেশের অর্থনীতির জন্য এই মুহূর্তে উচ্চ মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। তারা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ খুবই বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে। তাই এ মুহূর্তে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দ্রুত কমিয়ে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনাটাই অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
নতুন অর্থবছরের জন্য যে বাজেট প্রস্তাব জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হয়েছে। তা নানাভাবে মূল্যায়ন করা যেতে পারে। এটি বর্তমান সরকারের ১৬তম ধারাবাহিক বাজেট। ফলে বাজেটে সরকারের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতির প্রতিফলন ঘটেছে। সরকার আগামী ১ বছরের মধ্যে দেশে মানুষের জন্য কি করতে চান তা তুলে ধরেছেন। এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না যে, নতুন অর্থবছরে সরকারের জন্য সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে দেশের অর্থনীতিতে বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে এনে গণদুর্ভোগ কমানোর ব্যবস্থা করা। সরকার অপ্রয়োজনীয় এবং বিলাসজাত পণ্য আমদানি ব্যয় হ্রাসের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এই উদ্যোগ মূল্যস্ফীতি কমানোর ক্ষেত্রে কিছুটা সহায়তা করলেও এর বিপরীত প্রতিক্রিয়াও আছে। ঢালাওভাবে আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা হলে উৎপাদন খাতে স্থবিরতা নেমে আসতে পারে।
অর্থ পাচার বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য অত্যন্ত জটিল সমস্যার সৃষ্টি করে চলেছে। যে কোনোভাবেই হোক অর্থ পাচার রোধ করে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে। পাচারকৃত অর্থ ১৫ শতাংশ ট্যাক্স প্রদানের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এ ধরনের সুযোগদানের বিরোধী। তারপর যদি জাতীয় স্বার্থে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেয়া হয় তাহলে তাদের অর্থের ওপর উচ্চ হারে ট্যাক্স আরোপ করতে হবে। সাধারণভাবে একজন বিত্তবান বা সম্পদশালী ব্যক্তি যদি তার বৈধ অর্থের ওপর ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ট্যাক্স প্রদান করেন। আর যিনি অর্থ পাচার করে অন্যায় করেছেন তিনি যদি ১৫ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে সেই টাকা বৈধ করতে পারেন, তাহলে এখানে নৈতিকতার প্রশ্নটি বড় হয়ে উঠবে। যিনি বৈধ অর্থের ওপর ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ট্যাক্স প্রদান করেন তিনি যদি তার উপার্জিত অর্থ অপ্রদর্শিত রেখে পরবর্তীতে ১৫ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে তা বৈধ করেন তাহলে তাকে কি দোষ দেয়া যাবে?
আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গৃহীত নীতির ধারাবাহিকতার ব্যত্যয় লক্ষ্য করা যায়। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আইনের ধারাবাহিকতা না থাকলে মানুষ আইনের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলতে পারেন। সাধারণ মানুষ ব্যাংকিং খাতের ওপর অনেকটাই আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। ব্যাংকিং খাতের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা ফেরানো না গেলে এই খাতটি বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ আগামী অর্থবছরের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির যৌক্তিক কারণ খুঁজে বের করে তা সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। অনেকেই বলেন, মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির কারণে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ জন্য মূল্যস্ফীতি ঘটছে। এটা প্রশ্নাতীতভাবে গ্রহণ করা যায় না। কারণ বাংলাদেশ তার মোট পণ্যের ২৫ শতাংশ আমদানি করে থাকে। অবশিষ্ট ৭৫ শতাংশ পণ্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়। তাহলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য বাড়ছে কেনো? বাজারে তৎপর শক্তিশালি ব্যবসায়ী সিন্ডেকেটের কারণে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদের দমন করতে হবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কর আদায় করতে না পারা। বর্তমানে বাংলাদেশের কর-জিডিপি রেশিও ৮ শতাংশের নিচে রয়েছে। অথচ আমাদের নিকট প্রতিবেশী দেশগুলোর কর জিডিপি রেশিও বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি। কর আদায় বাড়ানো না গেলে দেশকে বিদেশি ঋণের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হয়,যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
লেখক: সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সভাপতি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি
অনুলিখন: এম এ খালেক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে