অর্থ পাচার রোধ করা না গেলে উন্নয়ন অর্থহীন হয়ে পড়তে পারে
সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. শামসুল আলম গত ২০ জুন বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি আয়োজিত এক সেমিনারে প্রধান আলোচক হিসেবে বক্তব্য উপস্থাপনকালে অর্থ পাচার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সেমিনারের বিষয় ছিল ‘বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনীতি: প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, খাদ্য ও পুষ্টি’। ড. শামসুল আলম বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। বর্তমান দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের যে সংকট চলছে তার পেছনে অর্থ পাচার একটি বড় কারণ। সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী আরও বলেছেন, দেশের অর্থনীতির জন্য অর্থ পাচার জটিল সমস্যা সৃষ্টি করে চলেছে।
সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী দেশের একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। শীর্ষ পর্যায়ের একজন চাকরিজীবীও বটে। তিনি দেশের অর্থনীতির হাল-হকিকত সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখেন। তার দেয়া বক্তব্য বিশেষ গুরুত্ব পাওয়ার দাবিদার। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট, প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম দেশ থেকে অর্থ পাচারের যে পরিসংখ্যান উল্লেখ করেছেন, তার বাস্তবতা নিয়ে তিনি নিজেও নিশ্চিত নন। এই পরিসংখ্যান অনুমাননির্ভর। কারণ তিনি বলেছেন, প্রতি বছর ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার থেকে ৮০০ কোটি মার্কিন ডলার পাচার হচ্ছে। অর্থাৎ দেশ থেকে প্রতি বছর কি পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে, সে সম্পর্কে সাবেক প্রতিমন্ত্রী নিশ্চিত নন। তার দেয়া পরিসংখ্যানের মধ্যে বিরাট ফারাক রয়েছে। তিনি এটাই বুঝাতে চেয়েছেন, প্রতি বছর যে অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে, তার পরিমাণ ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার হতে পারে। আবার ৮০০ কোটি মার্কিন ডলারও হতে পারে।
উল্লেখ্য, অর্থ পাচার, মানি লন্ডারিং, কালো টাকা এবং অপ্রদর্শিত অর্থের মোট পরিমাণ বা পরিসংখ্যান কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা নিশ্চিতভাবে বলতে পারবেন না। কারণ যারা অর্থ পাচার করেন বা এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত আছেন, তারা কখনোই তাদের উপার্জিত অর্থের পরিমাণ এবং উৎস কারও কাছে প্রকাশ করেন না। তাই কোনো ব্যক্তি বা সংস্থার পক্ষে আন্ডারগ্রাউন্ড ইকোনমির আকার কত বড়, তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। তবে এটা অনুমান করা যায়, দেশে বিপুল পরিমাণ কালো টাকা আছে। এসব কালো টাকা নানাভাবে সাদা করা হচ্ছে। বিভিন্ন সময় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো মানি লন্ডারিং এবং অর্থ পাচার সম্পর্কে যে সব পরিসংখ্যান প্রকাশ করে থাকে, তাও নিশ্চিত তথ্যভিত্তিক নয়। অনুমানভিত্তিক মাত্র। ২০১২ সালে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল বাংলাদেশের আন্ডার গ্রাউন্ড ইকোনমির আকার জিডিপির ৪৫ শতাংশ থেকে ৮৫ শতাংশ। এটাও অনুমাননির্ভর পরিসংখ্যান।
কয়েক বছর আগে বিশ্বব্যাংকের একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট উল্লেখ করেছিলেন, প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী যে পরিমাণ অর্থ মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে অর্থনীতির মূল শ্রোতে প্রবিষ্ঠ করানো হয়, তা বিশ্ব জিডিপির ২ থেকে ৫ শতাংশের সমান। অর্থের পরিমাণে তা ৮৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার থেকে ২ লাখ কোটি মার্কিন ডলার। তার দেয়া এই পরিসংখ্যান যে অনুমাননির্ভর, তা বলাই বাহুল্য। কারণ তিনি বিশ্বব্যাংকের মতো একটি সংস্থার প্রধান হিসেবেও নিশ্চিত করে বলতে পারেননি বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর কত কোটি মার্কিন ডলার মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে সাদা করা হচ্ছে। অনেকেই তাদের উপার্জিত কালো টাকা নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্থনীতির মূল শ্রোতে নিয়ে আসছেন, যারা তা করতে পারছেন না তারা বিদেশি অর্থ পাচার করছেন। যতদিন দেশে দুর্নীতির প্রাধান্য থাকবে ততদিন অর্থ পাচার চলতেই থাকবে। বিশ্বে কোনো দেশই দাবি করতে পারবে না যে, তারা অর্থ পাচার সমস্যা থেকে মুক্ত।
একটি দেশের অর্থনীতিতে কালো টাকা নানাভাবে সমস্যার সৃষ্টি করছে। সৃষ্ট কালো টাকা যেহেতু ব্যবহারের ক্ষেত্রে আইনি সমস্যা আছে, তাই যাদের সুযোগ আছে, তারা তাদের উপার্জিত অবৈধ অর্থ বিদেশে পাচার করে দেন। অর্থ পাচারের কারণে সরকার প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কালো টাকার উপস্থিতি বৃদ্ধি পাবার কারণে দেশে বিত্তবান-বিত্তহীনের মধ্যে ব্যবধান দ্রুত বাড়ছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম চেতনা ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে শোষণমুক্ত একটি সমাজ গড়ে তোলা। যেখানে প্রত্যেক নাগরিক তাদের যোগ্যতা অনুসারে রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের সুফল ভোগ করবে; কিন্তু স্বাধীনতার এই চেতনা আজ ভূলুণ্ঠিত হবার পথে। গিনি সহগ এর তথ্য মোতাবেক স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ বিত্তবান-বিত্তহীনের মাঝে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল অনেকটাই সহনীয় পর্যায়ে। বর্তমান তা অসহনীয় পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।
সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সাম্প্রতি ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জানিয়েছেন, তিনি এক সময় ব্যক্তিগত উদ্যোগে কানাডার বেগমপাড়ায় যেসব বাংলাদেশির বাড়ি বা ফ্ল্যাট আছে, তাদের ব্যাপারে অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন। তিনি বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেন রাজনীতিবিদ বা ব্যবসায়ীদের চেয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের বাড়ির সংখ্যা বেশি। পুলিশের সাবেক প্রধান ড. বেনজীর আহমেদ দুর্নীতির যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা তার একার দৃষ্টান্ত নয়। পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ে খোঁজ নিলে এমন হাজার হাজার বেনজীরের সন্ধান পাওয়া যাবে।
দেশের মানুষ বেনজীরের মতো দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছেন; কিন্তু সরকার সে পথে না গিয়ে বরং দুর্নীতিবাজদের ‘দায়মুক্তি’ দেবার ব্যবস্থা করেছেন। আগামী অর্থবছরের (২০২৪-২৫) জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ১৫ শতাংশ কর প্রদানের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেবার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তার অর্থ হচ্ছে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি দুর্নীতির মাধ্যমে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত বিপুল সম্পদ অর্জন করেন এবং উপার্জিত সম্পদের ওপর ১৫ শতাংশ ট্যাক্স প্রদান করেন, তাহলে তাকে সম্পদ অর্জনের উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করা হবে না। আর যাদের সৎভাবে উপার্জিত অর্থ রয়েছে, তাদের সেই অর্থের ওপর ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কর দিতে হবে। এটা অবৈধ অর্থ উপার্জনকারীদের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন এবং বৈধ করদাতাদের ওপর জুলুম করার শামিল। ইংরেজ আমলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের নানা অনৈতিক সুযোগ দিয়ে অনুগত করে রাখা হতো। এখনো সেই রীতি অব্যাহত আছে। সরকারি দলের স্থানীয় পর্যায়ের যেসব নেতাকে কোনো পদ-পদবি দেয়া সম্ভব হয় না, তাদের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা বোর্ডে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। নিয়োগ পাবার পর তাদের অধিকাংশেরই প্রাথমিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থবিত্ত গড়ে তোলা।
সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেছেন, অর্থ পাচার দেশের বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের অন্যতম কারণ। তার এই বক্তব্য ব্যাখার দাবি রাখে। তিনি অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি প্রসঙ্গে কথা বলেছেন, যারা নানা অনৈতিক পন্থায় অর্থ উপার্জন করে থাকেন তারা সেই অর্থ দেশের অভ্যন্তরে প্রশ্নাতীতভাবে ব্যবহার করতে পারেন না। তাই তারা অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থের নিরাপত্তা বিধানের জন্য তা বিদেশে পাচার করে থাকেন। বিদেশে অর্থ পাচারের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অবৈধ অর্থকে অর্থনীতির মূল ধারায় প্রবিষ্ঠ করানো। এভাবে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অবৈধ অর্থকে বৈধ করার পদ্ধতিকে মানি লন্ডারিং বলা হয়। মানি লন্ডারিং দেশের অভ্যন্তরেও হতে পারে। আবার অর্থ বিদেশে পাচার করার মাধ্যমেও মানি লন্ডারিং করা যেতে পারে। মানি লন্ডারিংয়ের সবচেয়ে নিকৃষ্ট এবং ক্ষতিকর কৌশল হচ্ছে বিদেশে অর্থ পাচার করা। একবার বিদেশে অর্থ পাচার করা গেলে সেই অর্থ কোনো না কোনোভাবে বৈধতা দেয়া সম্ভব হয়। যারা অবৈধ অর্থের মালিক, তারা যদি উপার্জিত অর্থ দেশের অভ্যন্তরে ব্যবহার করেন, তাহলে দেশ উপকৃত হতে পারতো; কিন্তু তা না করে তারা দেশের অভ্যন্তরে উপার্জিত অর্থ বিদেশে ব্যবহার করছেন। ফলে সংশ্লিষ্ট বিদেশি রাষ্ট্র উপকৃত হচ্ছে। কথায় বলে, ‘এক সময় বিদেশি তস্কররা আমাদের দেশ থেকে অর্থ লুটে নিয়ে যেত। আর এখন আমাদের দেশের এক শ্রেণির দুষ্কৃতকারি দেশের অর্থ বিদেশিদের হাতে তুলে দিচ্ছে।’ যারা দেশে উপার্জিত অর্থ অবৈধভাবে বিদেশে ব্যবহার করেন, তারা কখনোই দেশের বন্ধু হতে পারেন না। তারা দেশ ও জাতির শত্রু। এদের প্রতি কোনো ধরনের অনুকম্পা প্রদর্শন করা ঠিক নয়।
সরকার আগামী বাজেটে ১৫ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ দানের বিধান রাখতে চাচ্ছেন, তা কোনোভাবেই সঙ্গত হবে না। এতে খুব সামান্য পরিমাণ অর্থই দেশে আসবে। কারণ যারা অর্থ পাচার করেন, তারা ভালো করেই জানেন তারা সরকারি আহ্বানে সাড়া না দিলেও কিছু হবে না। আর কালো টাকার মালিকদের ট্যাক্সের হার কোনোভাবেই বৈধভাবে যারা ট্যাক্স প্রদান করেন তাদের চেয়ে কম হওয়া উচিত নয়।
এভাবে বারবার কালো টাকার মালিকদের অনৈতিক সুযোগ না দিয়ে একটি নির্দিষ্ট সময় দিয়ে তাদের বলা যেতে পারে এই সময়ের মধ্যে তারা যদি কালো টাকা সাদা করার উদ্যোগ গ্রহণ না করেন, তাহলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, কেউ যাতে অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনের সুযোগ না পান, তা নিশ্চিত করতে হবে। কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়ে যাবার পর তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের চেয়ে পূর্ব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়াই উত্তম। অর্থাৎ কেউ যাতে কালো টাকা অর্জন করতে না পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ে সৎ এবং যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগদানের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা নির্মোহভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন।
এম এ খালেক: অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে