প্রবাসী শ্রমিক নির্যাতন
জনশক্তি রপ্তানিতে আরও কার্যকর ভূমিকা প্রয়োজন
বলতে দ্বিধা নেই, বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের একটা অংশের বিকাশ হয়েছে এসব প্রবাসী-শ্রমিকের আয়ে। পরে প্রবাসী-শ্রমিকরা দেশে ফিরে অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেছেন, কৃষি-খামার করেছেন, বাড়িতে দালানকোঠা তুলেছেন, ফসলের জমি বাড়িয়েছেন। এ দেখে নব্বই ও পরবর্তী দশকগুলোতেও অনেকে বিদেশে যেতে উৎসাহিত হয়েছেন।
আর এই শ্রমিক সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের আনাচে-কানাচে বেড়ে উঠেছে একদল ভূঁইফোঁড় দালাল, রিক্রুটিং এজেন্সি। দালাল ও অবৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির হাত ধরে বিদেশে গিয়ে অনেকে ঠিকমতো কাজ পাননি, প্রতারণার শিকার হয়ে সর্বস্ব খুইয়েছেন এমন খবর বহু এসেছে। দেশ-গ্রামে এসব গল্প বহুল প্রচলিত, সাধারণ মানুষও এখন এসব বিষয়ে খুব সচেতন। সরকারও দালালচক্র ও অবৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির হাত থেকে জনসাধারণরকে বাঁচাতে যথেষ্ট উদ্যোগই গ্রহণ করেছে। তারপরও এখনো অনেকে এসব চক্রে পড়ে নিজের জীবনকে হুমকির মধ্যে ফেলেন।
বিশেষ করে ফ্রি ভিসার নামে এখনো অনেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যান। গিয়ে কাজ না পেলে তাদের অনেককে না খেয়েই দিনাতিপাত করতে হয়। প্রয়োজনে বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে ধার করে, বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে চলতে হয়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কাজ না পেয়ে অনেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের দেশগুলোতে যেতে গিয়ে সাগরেই ট্রলারডুবি হয়ে মারা গেছেন এমন অনেক খবরই আমরা জানি। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে, কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশ গিয়ে অনেক নারী শারীরিক-নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। কাজ না পেয়ে অনেকে খালি হাতেই দেশে ফিরে আসছেন। কারও বা আসছে মরদেহ।
আরও ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে, অবৈধভাবে বিদেশে গেলে অনেক সময় পুলিশের নির্যাতন সহ্য করতে হয়, জেল খাটতে হয়। আর কোনো দুষ্ট দালালচক্রের পাল্লায় পড়লে জীবন আরও শেষ। সেই দালালচক্র দেশেও ফিরতে দেয় না। নানা ভয় দেখিয়ে, নির্যাতন করে রাত-দিন যতটা পারে কাজ করিয়ে নেয়। বেতন দেয়ার তো কথাই নেই বরং মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে আটক-ব্যক্তির দেশ থেকে টাকা আনানো হয়।
সম্প্রতি কিরগিজস্তানে আটক এক তরুণের আর্তনাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে আধুনিক এই দাসব্যবস্থার ভয়াবহতা দেখে বিশ্ববাসী চমকে ওঠে। কী করুণ পরিণতির শিকার বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিক! গত বৃহস্পতিবার (২৩ মে) সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, দুই বছর আগে আরিফ তার এক আত্মীয়ের সঙ্গে ঢাকায় ইলেকট্রনিকস দোকানে কাজ করতেন। সেখান থেকে আদম ব্যবসায়ী তুহিনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তুহিন আরিফকে মালয়েশিয়ায় কাজের জন্য পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে ৪ লাখ টাকা নেয়; কিন্তু তাকে মালয়েশিয়ায় না পাঠিয়ে জরুরি ভিসা করে কিরগিজস্তান পাঠিয়ে দেয়।
দেশটির বিমানবন্দরে নেমে আরিফ কাউকে না পেয়ে অসহায়ভাবে তিন দিন কাটান। এ সময় নিরুপায় হয়ে পাকিস্তানি একটি হোটেলে যান। পরে পুলিশি হয়রানির ভয়ে আরিফ এক দালালের মাধ্যমে কৃষি কাজে যোগ দেন। দালাল তাকে আটকে রেখে কাজ করায় এবং বিভিন্ন অজুহাতে অমানসিক নির্যাতন করে। দালালের চোখ ফাঁকি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও বার্তায় নির্যাতনের বিষয়টি জানান আরিফ। সেই ভিডিও দেখে আরিফের বাবা-মা কান্নায় ভেঙে পড়েন।
নানা বাস্তবতার কারণেই বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ কাজের খোঁজে বিদেশে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কাজের সংখ্যা কমে যাওয়াসহ নানা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক টানাপোড়নের কারণে সরকারিভাবে জনশক্তি রপ্তানি অনেক কমে গেছে। দেশে বেকার ও কর্মহীন মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। তাই ব্যক্তিগত অনেক সূত্র ধরেই মানুষ জীবনবাজি রেখে বিদেশে যাচ্ছেন। গিয়ে জীবন-মৃত্যুর হুমকির মধ্যে পড়ছেন। পরিবার-পরিজনকেও নানা উদ্বিগ্নতা ও চিন্তার মধ্যে ফেলছেন। এ ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে যে, কোনো প্রলোভনেই বৈধ উপায় ছাড়া বিদেশে যাওয়া যাবে না।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কেও জনশক্তি রপ্তানি বাড়াতে হবে, এবং কোনো দালালচক্র বা অবৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি যেন আর কারও জীবনকে বিপদে ফেলতে না পারে, তার জন্য যথাবিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জনশক্তি রপ্তানিতে সরকারের কার্যকর ভূমিকা ছাড়া আসলে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ নেই। তাই আর কোনো তরুণকে যেন আরিফের মতো অবস্থায় পড়তে না হয়,তার ব্যবস্থা এখনই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে গ্রহণ করতে হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে