সুনামগঞ্জে কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ
মূল্যবোধের চর্চার আরও গুরুত্ব দিতে হবে
প্রায়ই নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের ঘটনাকে গণমাধ্যমের খবর হতে দেখা যায়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, নারী ও কন্যাশিশুরা অপরিচিত ব্যক্তিদের চেয়ে বেশি নির্যাতিত হয় পরিচিতজনদের দ্বারা; কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ ঘটনাগুলো প্রকাশ হয় না। লোকলজ্জা ও সামাজিক বন্ধনজনিত কারণে বিষয়গুলো পরিবার ও সমাজের মধ্যেই মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়।
জগতে যত খারাপ খবর আছে তার মধ্যে সবচেয়ে গ্লানিকর সম্ভবত ধর্ষণের খবর। মানুষের সমগ্র সভ্যতাকেই এই বর্বরতা প্রশ্নের সম্মুখে দাঁড় করায়, আমরা তাহলে কতদূর অগ্রসর হলাম! এখনো কেন মানুষের মধ্যে এমন পাশবিক আচরণ?
গতকাল রোববার (১০ মার্চ) একাধিক সাংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যমতে, সুনামগঞ্জে প্রেমিককে বেঁধে কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ করেছে একদল পাষণ্ড। অভিযুক্ত হিসেবে এসেছে আওয়ামী লীগের এক নেতা ও তার বন্ধুদের নাম। এ-ঘটনায় নির্যাতিতা কিশোরী ধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি এ-ধরনের মামলা অনেক সময় আপোষে মীমাংসা হয়ে যায়। হয়তো নির্যাতিত নারী ও তার পরিবারকে কিছু জরিমানা দিতে বাধ্য হন অভিযুক্ত আসামি। এসব খবর পত্রিকায় এত আসে, অনেক সময় আমাদের চোখে পড়লেও একটু দুঃখ প্রকাশ করেই ক্ষান্ত দেই। এর বেশি আর প্রতিক্রিয়া জানানোর অবকাশ পাই না।
ধর্ষণ-ঘটনা নিয়ে দেশজুড়ে সর্বশেষ চরম প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেয়েছিল ২০১৬ সালে, কুমিল্লায় সোহাগী জাহান তনু ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যাকাণ্ডের পর। এর আগে ১৯৯৫ সালে দিনাজপুরের কিশোরী ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা ঘটনার প্রতিবাদ কাঁপিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশকে। ২০২০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণ ঘটনাও রাজধানী জুড়ে প্রতিবাদ উঠেছিল।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের গবেষণা বলছে, গত বছরের আগস্ট মাসে দেশে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ২৭৩ জন নারী ও কন্যা শিশু। এর মধ্যে ১৩৫টি শিশু। ধর্ষণ, হত্যা, অ্যাসিড নিক্ষেপ, অপহরণ অথবা আত্মহত্যার প্ররোচনার মতো ৩৫ ধরনের নির্যাতনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটেছে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা। সারা দেশে ৪৩ জন নারী ও কন্যাশিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে।
নারী ও কন্যাশিশুর শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন বন্ধে দেশে ইতিবাচক আইন ও নীতিমালাও আছে; কিন্তু যথাযথ আইনের প্রয়োগ ও সচেতনতার অভাবে এখনো দেশে শিশু নির্যাতনের পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক। তাই নানা ক্ষেত্রে দেশের অগ্রগতি সত্ত্বেও নারীর প্রতি এ ধরনের মনোভাব এখনো পিছিয়ে পড়া সমাজের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
দেখা গেছে, নির্যাতিত নারী ও কন্যাশিশুরা পরবর্তী জীবনে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভোগে। বিষয়টি অগ্রগতির পথে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। যার বিরূপ ফল সমাজের অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিফলিত হয়। তা ছাড়া দেশে শুধু নারী ও মেয়েশিশুই যৌন নির্যাতনের শিকার হয় এমন নয়; আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে পুরুষশিশু যৌন নির্যাতনের ঘটনাও। যৌন নির্যাতক কেবল পুরুষ নয়, নারীও হতে পারে।
নারী ও কন্যাশিশুর ওপর নির্যাতন-সহিংসতা কিংবা ধর্ষণের মতো ঘটনা অনেক ক্ষেত্রেই আদালত পর্যন্ত গড়ায় না। তা ছাড়া অপরাধীর সঙ্গে ক্ষমতাবানদের সখ্য হওয়ার কারণে নির্যাতিতের পরিবার সঠিক বিচার পায় না! কখনো কখনো নির্যাতক কোনো কোনো রাজনীতিকের আশীর্বাদও পেয়ে থাকে।
তাই সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে নারী ও শিশুদের যথাযথ অধিকার, শিক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। এ লক্ষ্যে সরকার জাতীয় শিশুনীতি ও নারী উন্নয়ননীতি প্রণয়ন করেছে। গৃহীত এসব পদক্ষেপের ফলে বাল্যবিবাহ, নারী নির্যাতন উল্লেখযোগ্য হারে কমলেও এখনো প্রত্যাশিত হারে কমেনি। তাই নারী ও শিশুদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে নিরাপদ ও সুষ্ঠু পরিবেশ, মানসম্পন্ন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা এবং নিপীড়নমুক্ত সমাজব্যবস্থ্যা। সেই সঙ্গে নারী ও শিশুর প্রতি আপনজনসহ সবাইকে মানবিক আচরণ করতে হবে এবং নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চার ওপর আরও গুরুত্ব দিতে হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে