Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষ মারা যাচ্ছে, অনেক যুদ্ধেও এত মানুষ মারা যায় না

Ilias Kanchan

ইলিয়াস কাঞ্চন

শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪

জনপ্রিয় চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন দীর্ঘ ৩১ বছর ধরে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ (নিসচা) ব্যানারে আন্দোলন করে আসছেন। তার আন্দোলনের কারণে এখন পালিত হয় ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’। বহুবারই এই নায়ককে রাস্তায় নেমে গাড়ি চালকদের সচেতন করতে দেখা গেছে; কিন্তু তার আন্দোলনে সড়কে কতটা সুফল এসেছে? কিংবা কেন আসেনি? কেন আজও অনিরাপদ আমাদের সড়ক? এসব নিয়ে সম্প্রতি তিনি মুখোমুখি হয়েছিলেন ভিউজ বাংলাদেশের। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ভিউজ বাংলাদেশের সহযোগী সম্পাদক গিরীশ গৈরিক

ভিউজ বাংলাদেশ: ১৯৯৩ সাল থেকে আপনি ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন করে আসছেন। এই ৩১ বছরে আপনি বিএনপি সরকার পেয়েছেন, আওয়ামী লীগ সরকার পেয়েছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পেয়েছেন, আর এখন পেলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আপনার কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা, এত দীর্ঘকাল ধরে আপনাকে কেন নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে এবং এখনো কেন আমাদের সড়ক নিরাপদ হচ্ছে না। তার মানে কি আমাদের কোনো সরকারই নিরাপদ সড়কের ব্যাপারে আন্তরিক নন?

ইলিয়াস কাঞ্চন: একদম সঠিক কথা বলেছেন। আমার মনের কথাটা বলেছেন। সত্যি বলতে আমি একটা সরকারও পাইনি, যারা এই রোড সেফটিটাকে ওন করে। এসব কথা আমি অনেকবার বলেছি। টেলিভিশনে বলেছি, সংবাদমাধ্যমে বলেছি ও টকশোতে বলেছি। তারা যদি ওন করত তাহলে আমাকে ৩১ বছর আন্দোলন করতে হতো না। এই ৩১ বছরে যারা মারা গেছেন, আহত হয়েছেন, যে মানুষগুলো পঙ্গু হয়েছেন, যে পরিবারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সরকার যদি রোড সেফটির ব্যাপারে সচেতন হতো, আন্তরিক হতো তাহলে সেগুলো এত হতো না।

আমি এ পর্যন্ত যত দেশ-বিদেশে সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছি, সব জায়গাতেই শুনেছি, এটা বুঝেছি সরকার যতক্ষণ পর্যন্ত রোড ক্রাশ রোধ করার ইচ্ছা প্রকাশ না করবে, ততক্ষণ এটি থামানো সম্ভব না। কেন সম্ভব না? কারণ অনেক কাজ আছে যেগুলো সরকারকেই করতে হবে। সরকার অনেক সময় ভয় পায়, যার কারণে সঠিক উদ্যোগ নিতে চায় না। ভয়টা কী? ভয়টা হচ্ছে পরিবহন সেক্টরে যে মানুষগুলো আছে, তাদের ভয়। তাদের ভয়ে সরকার অনেক কাজ করতে চায় না। তারা স্ট্রাইক করে, গাড়িঘোড়া বন্ধ করে দেয়, এমন এমন বিষয় সামনে নিয়ে আসে, যাতে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়, মানুষের হয়রানি শুরু হয়, বিরোধী দলে তখন যারা থাকেন, তারা এটাকে আবার উসকানি দেয়।

আপনারা জানেন যে, এরশাদ সরকার আমলেও এমন হয়েছিল। আওয়ামী লীগ-বিএনপি পরিববহন সেক্টরের লোকদের নিয়ে আন্দোলন করেই এরশাদ সরকারের পতন ঘটায়। তো সরকারে যারা থাকেন, তাদের মাথায় কিন্তু এটা সব সময়ই থাকে। যে আমি যদি আইনটাকে সেভাবে করতে চাই, এটাকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চাই, এটাকে বাস্তবায়ন করতে চাই, তাহলে এর সঙ্গে বিরোধী দল এসে যুক্ত হবে।

যে কারণে প্রথম থেকেই আমি সব সময়ই বলে আসছি, সরকারি দল, বিরোধী দল যখন যে ছিল একই সঙ্গে তাদের উভয়ের কাছে আমি গিয়েছি, গিয়ে তাদের বলেছি, দেখেন এটা একটা জাতীয় ইস্যু, সড়কে মানুষ মারা যাচ্ছে। কেমন মানুষ মারা যাচ্ছে? যত মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে, একটা রাষ্ট্রে যুদ্ধ করলেও কিন্তু এত মানুষ মারা যায় না। কত মানুষ মারা যায়, তার সঠিক ডাটাও নাই। এটা করার দায়িত্বও সরকারের; কিন্তু সরকার এটা করে না। জাতিসংঘের মাধ্যমে যে ডাটা পাওয়া যায় তাতে জানা যায়, বছরে প্রায় ৩১ হাজার মানুষ মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনায়। ৩১ হাজার মানুষ কিন্তু কোনো যুদ্ধেও মারা যায় না।

ভিউজ বাংলাদেশ: এই জাতীয় ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলো কেন এক হয় না?

ইলিয়াস কাঞ্চন: আমি সেটাই তাদের বলেছি, বিরোধী দলকে বলেছি, আপনারা জাতীয় ইস্যুর ব্যাপারে ঐকমত্য হন। সরকার যদি কোনো আইন করে, সরকার যাতে তা বাস্তবায়ন করতে পারে, আপনারা অন্তত এই জায়গাটাতে সরকারকে হেল্প করেন; কিন্তু দেখা গেছে, তারা কখনোই এই হেল্প করেনি। আমাদের দেশে সরকার ও বিরোধী দল কোনো বিষয়েই ঐকমত্যে আসে না। জাতীয় ইস্যুতে কিন্তু সারা পৃথিবীর সব দেশই এক হয়। এই যে আজকে ইন্ডিয়া আমাদের বিরুদ্ধে যেসব প্রোপাগান্ডা করছে সেই জায়গাতেও কিন্তু তারা এক।

আমরা কিন্তু একত্রিত হতে পারিনি। হতে পারি না বলেই ৩১ বছর ধরে আমাকে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। এবার যখন অন্তবর্তীকালীন সরকার আসল আমি ভেবেছিলাম এই ইস্যুটা নিয়ে তারা এক হবেন। ভারতের প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে লড়তে কিন্তু সব রাজনৈতিক দর একটা ঐক্যে পৌঁছেছে। নিরাপদ সড়কের ব্যাপারেও যদি তারা এরকম ঐকমত্যে পৌঁছান তাহলে আমরা একটা নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠা করতে পারব। তা নাহলে কিন্তু পারব না।

ভিউজ বাংলাদেশ: সরকারের সহযোগিতা ছাড়া কি নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠা সম্ভব?

ইলিয়াস কাঞ্চন: সরকারের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব না। সরকার ছাড়া কেন সম্ভব না? আমাদের পক্ষে কেন সম্ভব না? তার কারণ হলো এই দেশের বেশির ভাগ গাড়ি আমদানি করা। এই আমদানি করা হয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আন্ডারে। এখন সড়ক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যারা জড়িত আছেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কোনোদিনই তাদের কিছু জিজ্ঞেস করে না। যে আমাদের সড়ক কেমন, কী ধরনের গাড়ি আনলে, কী গাড়ি আমাদের রাস্তায় চললে সুবিধা হবে, কোনটা অসুবিধা হবে। কী ব্যবস্থাপনা মেইনটেইন করলে সড়কে দুর্ঘটনা কম হবে। তাদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। যার যার খেয়াল-খুশিমতো তারা কাজ করছেন। এখন আমাদের দেশে নছিমন, করিমন উৎপাদন হচ্ছে, রাস্তায় চলছে। এটাও শিল্প মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে চলছে। এই যে এখন ব্যাটারিচালিত রিকশা চলছে। রাস্তায় সমানে দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব নিয়ে শিল্প মন্ত্রণালেয়ের কোনো মাথাব্যথা নেই। অথচ তাদের অনুমতিতেই এসব চলছে।

ভিউজ বাংলাদেশ: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ ক্ষেত্রে ভূমিকা কীরকম?

ইলিয়াস কাঞ্চন: আমাদের এখানে আইন যারা প্রয়োগ করেন, রাস্তায় যারা ট্রাফিক কন্ট্রোল করেন তাদের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের একটা দা-কুমড়ো সম্পর্ক। কেন এই বৈরী সম্পর্ক? তার কারণটা হলো, আমাদের এখানে ট্রাফিক সিগন্যালের যে বাতিগুলো আছে, এগুলো কোটি কোটি টাকা খরচ করে এনে লাগানো হয়। প্রত্যেকটি ট্রাফিক মোড়েই দেখবেন চারটি রাস্তায় বাতিগুলো লাগানো আছে। এটা প্রচুর টাকার ব্যাপার। এটা সিটি করপোরেশনের দায়িত্বে আছে; কিন্তু এটাকে মেইনটেইন করার দায়িত্ব পুলিশের। এখন পুলিশ ও সিটি করপোরেশনের দ্বন্দ্ব-বৈরিতার সম্পর্কের কারণে পুলিশ ভাবে এগুলো তো সিটি করপোরেশন লাগিয়েছে, তারা টাকা খেয়েছে, আমরা কেন এগুলো দেখে রাখব? এখন আমাদের ডিজিটাল ট্রাফিক সিগন্যাল থাকার পরও পুলিশকে কেন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ট্রাফিক কন্ট্রোল করতে হয়, হাত দিয়ে ডাকতে হয় তার কারণটা হলো এটি।

তাদের মধ্যে রেষারেষি থাকার কারণেই কিন্তু এই জিনিসটা আমাদের এখানে হয় নাই। না থাকার কারণে আমাদের দেশে যারা গাড়ি চালায়, পথচারী তাদের একটা ভুল মেসেজ দেয়া হয়েছে। গত ১৫-২০ বছর ধরে এই মেসেজটা দিয়ে আসছে। মানুষ জানে লাল বাতি জ্বললে মানুষ থামবে, তখন পথচারী মনে করে, লাল বাতি জ্বললে আমি রাস্তা পার হতে পারব; কিন্তু এখানে দেখা যায় লাল বাতি জ্বললে পুলিশ হাত দিয়ে গাড়ি ডাকে, চলতে বলে। পথচারী ও গাড়ি চালকদের সঙ্গে এখানে একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়।

এই ২০ বছরে যে ভুল মেসেজ ছড়িয়েছে, এটা দূর করতে আরও অন্তত ৫ বছর লাগবে। কন্টিনিউয়াস যদি আমরা কাজ করি, তাহলে হয়তো ৫ বছরের মধ্যে এটা ঠিক করতে পারব না। এই দুর্নীতি, অনিয়ম, পরিবহন শ্রমিকদের মাফিয়াগিরি মিলিয়ে সড়ককে অনিরাপদ করে ফেলা হয়েছে। আমরা যারা সামাজিকভাবে এর বিরুদ্ধে কাজ করি, আমাদের পক্ষে এটা ঠিক করা সম্ভব না। আমরা এই মাফিয়া বন্ধ করতে পারব না। এটা সরকারের দায়িত্ব, সরকারকেই করতে হবে।

ভিউজ বাংলাদেশ: সড়ক নিরাপদ করার জন্য সরকার কী করতে পারে?

ইলিয়াস কাঞ্চন: সরকারকে নিরাপদ উপযোগী সড়ক বানাতে হবে। ভালো গাড়ি যেন রাস্তায় চলাচল করে, সেদিকে নজর দিতে হবে। ড্রাইভারদের ট্রেনিং দিতে হবে। বেশির ভাগ ড্রাইভারের প্রোপার ট্রেনিং নাই। রাস্তা যদি ভালো না থাকে, গাড়ি যদি ভালো না থাকে, ট্রাফিক পুলিশ যদি ঠিকমতো দায়িত্ব পালন না করে তাহলে ৩১ বছর কেন, ১০০ বছর চেষ্টা করলেও সড়ক নিরাপদ করা সম্ভব না। এটা কিন্তু আমরা পারব না। এটা সরকাকেই করতে হবে। আমরা বড়জোর সরকারকে হেল্প করতে পারব। সরকার যদি মনে করে আমার দেশের মানুষগুলো আমার রক্ষা করতে হবে, আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা ঠিক করতে হবে, তাহলেই এটা সম্ভব। তা নাহলে কোনোভাবেই সম্ভব না। এই যে আপনারা রিকশার মধ্যে ব্যাটারি লাগিয়ে দিলেন, ৬০ থেকে ৭০ লাখ গাড়ি, এটা আপনি কেন করলেন? এখন চাইলেও তো এদের বন্ধ করা যাচ্ছে না। বন্ধ করতে চাইলে এরা রাস্তায় নামে প্রতিবাদ শুরু করে।

ভিউজ বাংলাদেশ: করোনা মহামারির সময় সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে। সড়ক দুর্ঘটনাও আমাদের দেশে মহামারির মতো; কিন্তু এদিকে সরকারের তেমন নজর নেই। এত এত মৃত্যুকে উপেক্ষা করার শক্তি সরকার কোথায় পায়?

ইলিয়াস কাঞ্চন: উপেক্ষা করার শক্তিটা, আগে যা হওয়ার হয়েছে, বিশেষ করে গত ১৫-১৬ বছরে যা হয়েছে তাহলো কোনো বিষয়ে সরকারের কারও কাছে জবাবদিহির কিছু ছিল না। জবাবদিহিতার বিষয়টি যেহেতু ছিল না সেহেতু কোনো কাজই তারা মন দিয়ে করেনি। তাদের যা মন চেয়েছে তারা তাই করেছে। তারা জনগণের কথা ভাবেনি।

ভিউজ বাংলাদেশ: পরিবহন মালিকদের অরাজকতা নিয়ে আপনি সব সময়ই সরব। এর জন্য আপনাকে অনেক ধরনের সমস্যায়ও পড়তে হয়েছে। এই সমস্যাগুলো কে বা কারা তৈরি করেন?

ইলিয়াস কাঞ্চন: এই সমস্যাগুলো যারা তৈরি করেছেন, তারা হলো সড়কের মধ্যে বিশাল এক বেনিফিটেড পারসন। বিশেষ করে পরিবহন সেক্টরের নেতা নামধারীরা। তারা সাধারণ মালিক ও শ্রমিকদের উসকে দিয়ে কাজটা করেন। এই পরিবহন মালিকরা চান না, সাধারণ পরিবহন শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত হোক। তারা চায় না, তাদের জীবনবোধ বাড়ুক।

জীবনবোধ বাড়ালেই সে মানবিক হবে, অন্যের জীবন রক্ষা করতে চাইবে। এদের যদি যথাযথ ট্রেনিং দেয়া যেত, তাহলে কিন্তু এত দুর্ঘটনা ঘটত না। মালিকপক্ষ ও শ্রমিকদের পক্ষদের নেতৃত্বদানকারী লোকগুলোই সব নষ্টের গোড়া। এরা চালককে বলে, তোর কিছু হবে না, যতই দুর্ঘটনা ঘটাস, আমি তোকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসব। আরেকটি বিষয়, রাস্তায় যেসব চাঁদা হয় এর ভাগ সরকার পায়। তাই সরকারও এদের কিছু বলে না। এ কারণে তারাও আমাদের বিরোধিতা করে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ওরা মনে করে দুর্ঘটনা হলো একটা নিয়তির ব্যাপার। আল্লার মাল আল্লায় নিয়ে যায়, তারা বলে! সড়ক দুর্ঘটনা কিন্তু মানুষসৃষ্ট একটা ব্যাধি। মানুষের অসচেতনার কারণেই এটা হচ্ছে। মানুষ যদি সব নিয়ম মেনে চলত তাহলে কিন্তু এত দুর্ঘটনা ঘটত না।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ