মস্কো হামলা নিয়ে চলছে জটিল হিসাব
‘পিকনিক’ নামের বহু পুরোনো একটি রক ব্যান্ড তাদের কনসার্ট শুরু করতে প্রস্তুত। স্থান মস্কোর অদূরে। ক্রেমলিন থেকে ১২ মাইল দূরে, ক্রাসনগর্ক্স শহরে অবস্থিত ক্রকাস সিটি হল। ২২ মার্চ শুক্রবারের ঘটনা। ব্যান্ড দল তাদের জনপ্রিয় ‘অ্যাফ্রেইড অব নাথিং’ (কোনো কিছুতেই ভয় নেই) নামের পারফরম্যান্স শুরু করবে। ৬ হাজার ২০০ লোক ধারণক্ষমতার হলরুম ভরে উঠেছে। ঘড়িতে স্থানীয় সময় তখন সন্ধ্যা ৮টা ১৫ মিনিট। তখনো কেউ কেউ হলে ঢুকছেন। হঠাৎ হলের দিকে প্রবেশ করতে থাকে একদল অস্ত্রধারী। তাদের হাতে আধুনিক কালাশনিকভ অটোমেটিক অ্যাসল্ট রাইফেল এবং মাকারভ অটোমেটিক পিস্তল। গুলি করতে থাকে নির্বিচারে। এর ভিডিও চিত্রও ইন্টারনেটে রয়েছে। বীভৎস এই আক্রমণে এ পর্যন্ত ৩ শিশুসহ ১৪০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আরও ১৮২ জন গুরুতর আহত হয়ে এখনো চিকিৎসাধীন। একইসঙ্গে আক্রমণকারীরা গ্রেনেড ও আগুন ধরানোর বোমা ছুড়ে ভবনে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারপর ৪ আক্রমণকারী দ্রুত পালিয়ে যায়; কিন্তু বেশিদূর যেতে পারেনি।
এতগুলো নিরীহ মানুষ যারা হত্যা করল, তাদের অবশ্যই বিচার ও শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। সরাসরি আক্রমণে অংশগ্রহণকারী ৪ জনসহ মোট ১১ জনকে আটক করেছে রাশিয়ার ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস; কিন্তু এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারা এই আক্রমণের পেছনে ছিল? হিসাবটা জটিলই বটে। আক্রমণ সংঘটিত হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আইএসকে, অর্থাৎ ইসলামী স্টেট খোরাসান হামলার দায় স্বীকার করেছে। এই আইএসকে হলো ইসলামিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের একটি শাখা। ইরান, তুর্কমিনিস্তান এবং আফগানিস্তানের একটি অঞ্চল নিয়ে ছিল খোরাসান। জানা যায়, এদের মূল কেন্দ্রস্থল আফগানিস্তানের জালালাবাদ। সরাসরি আক্রমণে যারা জড়িত ছিল, তারা সবাই তুর্কমিনিস্তানের নাগরিক। এদের একজন রাশিয়ার তদন্তকারীদের কাছে বলেছে, মাসখানেক আগে সে একজন ধর্মীয় বক্তার বক্তব্য শুনে মোটিভেটেড হয়েছে। এবং অজানা উৎস থেকে তাকে আক্রমণের জন্য ৫ লাখ রুবল দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। ৫ লাখ রুবল মানে সাড়ে পাঁচ হাজার ইউএস ডলার। এই প্রতিশ্রুতির অর্ধেক অর্থ তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টেও ট্রান্সফার করা হয়েছে।
কিন্তু মস্কো আইএসকের দাবি গ্রহণ করেনি। তারা বলেছে, আইএস হামলা করলেও এর পেছনে আছে ইউক্রেণ। এ কথা বলার কিছু কারণ আছে তাদের। প্রথমত, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অনেক হামলার ঘটনার পর দেখা গেছে আইএস হামলার দায় স্বীকার করছে; কিন্তু অনেক হামলার পর জানা গেছে কাজটি আইএসের নয়। তারা কেবল ক্রেডিট নিতে চেয়েছে। বাংলাদেশে হলি আর্টিসান হামলার পরও আইএস দাবি জানিয়েছিল, তারা এই হামলা চালিয়েছে। হামলার পরপর ছবিও পোস্ট করেছিল তাদের ওয়েবসাইটে; কিন্তু সেই হামলার পেছনে ছিল জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ বা জেএমবি। অবশ্য আইএসের সঙ্গে তাদের পার্থক্য খুব একটা নেই। মস্কো হামলা যে আইএসকেই করেছে, এটা তাদের দাবির কারণে স্বীকার করতে নারাজ রাশিয়া।
দ্বিতীয়ত, মাত্র কয়েকদিন আগে কেনা সেকেন্ডহ্যান্ড একটি গাড়িতে করে হামলাকারীরা ইউক্রেনের সীমান্তের দিকে যাওয়ার পথে ধরা পড়ে। রাশিয়ার নিরাপত্তারক্ষীরা হামলার সঙ্গে সঙ্গে সব সীমান্ত এলাকা বন্ধ করে দেয়। তারা ১৪ ঘণ্টা পর ইউক্রেন সীমান্তের ব্রিয়ান্সক অঞ্চল থেকে প্রথম একজনকে ধরতে পারে। যেখান থেকে ধরেছে সেটা মস্কো থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূরে। বাকিরা গভীর জঙ্গলে পালিয়েছিল; কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। বাকি ৩ জনও অল্প সময় পর ধরা পড়ে। এতে ভ্লাদিমির পুতিনের মনে আরও বিশ্বাস জন্মে যে, এই হামলার পেছনে ইউক্রেন রয়েছে। তিনি অবশ্য ঘটনার পরপরই বলেছেন ইউক্রেনের কথা কোনো দ্বিতীয় চিন্তা না করেই। আর ইউক্রেন মানেই পশ্চিমারা। কারণ রাশিয়া- ইউক্রেন যে যুদ্ধ চলছে, তা আসলে একটি প্রক্সি ওয়ার। অস্ত্র, প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে ইউক্রেনের সৈন্যদের পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করছে ন্যাটোভুক্ত কয়েকটি দেশ। ইউক্রেণের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি একজন পুতুল মাত্র।
এদিকে হামলার পরপরই পশ্চিমা মিডিয়ায় প্রচার হয়েছে, ৭ মার্চ ভ্লাদিমির পুতিনকে সতর্ক করেছিল যুক্তরাষ্ট্র, কোনো কনসার্ট অথবা জনসমাবেশে বড় ধরনের হামলার ঘটনা ঘটতে পারে। মস্কো যুক্তরাষ্ট্রের সতর্ক বিশ্বাসে নেয়নি। ভ্লাদিমির পুতিন ভেবেছিলেন নির্বাচনকে সামনে রেখে এটি প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের দূতাবাসের মাধ্যমে রাশিয়ায় অবস্থিত মার্কিন নাগরিকদের জনসমাগম এড়িয়ে চলতেও সতর্ক করেছিল। হতে পারে। কারণ এ কথা সত্যি, যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা ইসলামি জঙ্গি সংগঠনের ব্যাপারে অন্যদের চেয়ে অধিক দক্ষ। দীর্ঘদিন ধরে তারা বেশ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনে নিজেদের এজেন্ট প্ল্যান্ট করে রেখেছে। তাছাড়া তাদের কার্যকলাপও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অন্য কেউ ভালো বোঝে না। পশ্চিমা অনেকে বলছেন, এই হামলার কয়েকটি মোটিভ আছে। একটি হলো, সিরিয়ায় মৌলবাদী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে রাশিয়া বাশার আল আসাদকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার কারণেই আসাদ ক্ষমতায় টিকে আছেন। দ্বিতীয়ত, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়া এবং চীন গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ভোটো দেয়ার কারণে এই হামলা; কিন্তু এটা একেবারেই অসত্য। কারণ রাশিয়া এবং চীন বলেছে, এই প্রস্তাব এক্সট্রিমলি পলিটিসাইসড। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে ইসরায়েলের বাহিনী রাফায় অপারেশনের আরও সুযোগ পাবে।
এই মস্কো হামলার পেছনে যারাই থাকুক, মস্কোকে ইউক্রেনে হামলার অযুহাত আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ইতিমধ্যে মস্কো লিভ, কিয়েভসহ কয়েকটি শহরে ভয়ানক হামলা জোরদার করেছে। অন্যদিকে হামলাকারীদের আদালতের মাধ্যমে পুলিশ কাস্টডিতে পাঠানো হয়েছে, আগামী ২২ মে পর্যন্ত তদন্তের জন্য। সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পরা ছবিতে দেখা গেছে, রাশিয়ার তদন্তকারীরা জিজ্ঞাসাবাদ করতে গিয়ে আক্রমণকারীদের হাড়-মাংস এক করে ফেলেছে। প্রকৃত ঘটনা ওদের কাছ থেকে তারা ঠিকই বের করে ফেলবে। কারণ মানুষের শরীর এমন এক স্পর্শকাতর বিষয় যে, সহ্য ক্ষমতারও মাত্রা আছে; কিন্তু এই হামলাকে রাশিয়া কীভাবে দেখবে, তা একান্তই নির্ভর করছে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ওপর।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে