Views Bangladesh Logo

মহাসড়কে বেশিরভাগ সিসিটিভি ক্যামেরাই চুরি, এ সুযোগে তৎপর ডাকাতচক্র

ম্প্রতি ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে যাত্রীবাহী বাসে বেশ কিছু ডাকাতির ঘটনায় নতুন করে সামনে এসেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্বলতার বিষয়টি। মহাসড়কের বিভিন্ন জায়গায় চেকপোস্ট বসিয়ে ও বিশেষ অভিযান চালিয়েও বন্ধ করা যাচ্ছে না ডাকাতি এবং ছিনতাই। অস্ত্রের মুখে যাত্রীদের জিম্মি করে ডাকাতি এবং নারীদের শ্লীলতাহানির সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এসব অপরাধ কর্ম কেবল রাতের অন্ধকারেই হচ্ছে এমন না, দিনের আলোতেও হচ্ছে।

এ অপরাধগুলো ঠেকাতে কেন ব্যর্থ হচ্ছে পুলিশ? ভিউজ বাংলাদেশের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে পুলিশকে ফাঁকি দিতে ডাকাত চক্রের বেশ কিছু কৌশল। পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা-আরিচা ও নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়ক দুটিতে মোট ৩৮ কিলোমিটার সড়কে ছিল ১২১ সিসিটিভি ক্যামেরা। এর মধ্যে বর্তমানে সচল রয়েছে মাত্র ৩১টি। জানা গেছে, ৯০টি ক্যামেরার অধিকাংশই চুরি করে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। বাকি কয়েকটি বিকল ও ভাঙা অবস্থায় রয়েছে।

এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে স্থানীয় অপরাধী চক্রের সদস্যরা বলে জানিয়েছে পুলিশ। দুই পুলিশ কর্মকর্তা ভিউজ বাংলাদেশকে জানান, অপরাধীরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে পুরো এলাকা ঘুরে দেখছে মহাসড়কে সিসিটিভি ক্যামেরা ও পুলিশ চেকপোস্টগুলোর অবস্থান। একই সঙ্গে তারা চেকপোস্টগুলোতে ডিউটিরত পুলিশ সদস্যদের সংখ্যার বিষয়টিও খোঁজ নিচ্ছে। ডাকাতি করে কোন পয়েন্ট দিয়ে পালালে পুলিশের নজর এড়ানো যাবে, সেটাও তাদের জানা থাকে। এরপর, কয়েকজন যাত্রীবেশে বিভিন্ন বাসে উঠে লুটপাট চালাচ্ছে। তারা এসব করতে খুব অল্প সময় নিচ্ছে।

সর্বোচ্চ ৫ থেকে ১০ মিনিটের ভেতর যা পারছে তাই নিয়ে পূর্বনির্ধারিত স্থানে নেমে পালিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ বলছে, আগে সিসিটিভি ক্যামেরা সচল থাকায় অপরাধীদের এসব কর্মকাণ্ড সহজেই মনিটর করা যেত এবং তাদের শনাক্ত করতে খুব বেশি বেগ পেতে হতো না; কিন্তু বর্তমানে সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া না যাওয়ায় এসব অপরাধীকে শনাক্ত করা যাচ্ছে না। তাদের চিহ্নিত করতে জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে পুলিশকে। ফলে, অপরাধীদের শনাক্ত করতে এবং ধরতে অনেক বেশি সময় লাগছে।

তারা আরও জানান, এখন যেসব সিসিটিভি ক্যামেরা সচল রয়েছে, সেসব দিয়ে পুরো এলাকার নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয়। পুরো এলাকা তদারকি করতে ৯০টি ক্যামেরা প্রতিস্থাপন প্রয়োজন। সরেজমিন মহাসড়কের বিভিন্নস্থান ঘুরে দেখা যায়, সিঅ্যান্ডবি, রেডিও কলোনি বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন ইউটার্ন, ফুলবাড়িয়া, ব্যাংক টাউন এলাকায় নেই কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা। এ ছাড়া এসব স্থান অনেকটাই নির্জন। দুপুর কিংবা বিকেলে মানুষের চলাচল অনেকটাই কম থাকে এখানে।

বাসস্ট্যান্ডগুলোতে পুলিশের টহল টীম কাজ করলেও এসব নির্জন স্থানে দেখা যায়নি কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি। স্থানগুলোর একশো ফুটের মধ্যেই উভয় পাশে রয়েছে ফাঁকা মাঠ, বাজার ও বাসস্ট্যান্ড। অপরাধ করে কয়েক মিনিটের মধ্যে সহজেই পালিয়ে বা মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়া সম্ভব। আশপাশে কোনো প্রতিষ্ঠান না থাকায় ব্যক্তিগত সিসিটিভি ক্যামেরাও নেই এসব জায়গায়। ফলে, ডাকাতি করার জন্য এসব স্থানই বেছে নেয় অপরাধীরা।

গোয়েন্দা সূত্র ও স্থানীয়দের তথ্য অনুযায়ী, ৫ আগস্টের পর থেকেই এসব স্থানে চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। পুলিশ জানায়, গত দুই মাসে এসব এলাকায় শুধু ছিনতাইয়ের ঘটনায় মোট ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ফেব্রুয়ারিতে এই সংখ্যা ছিল ৭ ও মার্চে ৯ জন। এ সময় উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণ দেশি অস্ত্র।

সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই মাসে সর্বশেষ ৬টি বাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে বলে খবর পাওয়া যায়। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি দুপুরের দিকে মানিকগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা শুভযাত্রা বাসটিতে ডাকাতি হয়। এরপর ২ মার্চ একই সময় ও স্থানে রাজধানী পরিবহন, ২৪ মার্চ রাত ৮টার দিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের রেডিও কলোনিতে ডাকাতির কবলে পরে মানিকগঞ্জগামী শুভযাত্রা পরিবহনের একটি বাস। ৪ এপ্রিল একই এলাকায় ইতিহাস পরিবহন ও সর্বশেষ ১১ এপ্রিল এখানেই অস্ত্রের মুখে যাত্রীদের জিম্মি করে লুট করা হয় স্বর্ণালংকার, অর্থসহ মূল্যাবান মালপত্র।

১১ এপ্রিল ডাকাতের কবলে পড়া তায়েফুর রহমান জানান, ‘দুপুর ১২টার দিকে শ্যামলী যাওয়ার উদ্দেশ্যে স্ত্রী ও বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাংক টাউন থেকে বাসটিতে উঠি আমরা। ব্যাংক টাউন পার হয়ে পুলিশ টাউনের আগের ব্রিজের ওপর বাসটি উঠতেই বাসে আগে থেকেই অবস্থান করা ৩ থেকে ৪ জন যুবক ছুরি হাতে মূলত বাসে থাকা নারী যাত্রীদের টার্গেট করে। নারী যাত্রীদের কাছে থাকা চেইন, স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এ সময় তারা আমার স্ত্রীর গলায় থাকা লকেটসহ একটি স্বর্ণের চেইনও ছিনিয়ে নেয়।’

এ সময় বাসে প্রায় ২০-২৫ জন যাত্রী ছিল। তবে ছিনতাইকারীরা কারও ফোন/ডিভাইস নেয়নি। শুধু নারী যাত্রীদের টার্গেট করে তারা। ছিনতাইকারীরা বাসে থাকা অন্তত ৩ জন নারী যাত্রীর কাছ থেকে চেইন ছিনিয়ে নেয়। দিনদুপুরে ঘটে যাওয়া এই ছিনতাইয়ের ঘটনায় অভিযোগ করতে গেলে ভুক্তভোগীদের ৬ ঘণ্টা থানায় বসে থাকতে হয় বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা।

এদিকে মহাসড়কের সাভারের রেডিও কলোনিতে বাসটিতে থাকা এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ৫৩ ব্যাচের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস মোবাইল ফোনে বলেন, ‘সকালে রেডিও কলোনি এলাকা থেকে ক্যাম্পাসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রাজধানী পরিবহনের বাসটিতে উঠি আমি। বাসটি সিঅ্যান্ডবি ব্রিজের কাছে পৌঁছানোর আগেই তিনজন ছিনতাইকারী চাকু হাতে ড্রাইভারকে বাস থামাতে বলে। ড্রাইভার বাস থামালে তারা যাত্রীদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে টাকা ও স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নিয়ে বাস থেকে নেমে যায়। পরে আমিও ক্যাম্পাসে, ডেইরি গেটে এসে নেমে যাই।’

ওই শিক্ষার্থী আরও বলেন, ‘মোট তিনজন ছিল তারা, সম্ভবত আগে থেকেই বাসে ছিল। কারও মুখেই মাস্ক ছিল না। আর বাসেও অনেক যাত্রী ছিল। তবে কেউ আসলে প্রতিবাদ করেনি, অস্ত্রের মুখে সবাই চুপচাপ বসে ছিল।’ ঢাকা জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাভার সার্কেল) শাহিনুর কবির বলেন, কিছু ঘটনা ঘটছে। তবে অধিকাংশ ঘটনার কোনো সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে না। তবু আমরা বিভিন্ন স্থানে টহল টিম বসিয়েছি। বাসে বাসে চেক করা হচ্ছে। অনেক ছিনতাইকারীকে ধরে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।

আশা করছি এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো সচল না থাকায় অপরাধী শনাক্ত ও মহাসড়ক অপরাধ নির্মূল কাজ ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, পর্যাপ্ত ক্যামেরা বসলে এসব ঘটনায় তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। কেউ অপরাধ করার সাহস পাবে না।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ