এমপি আনার ‘খুন’: এখন পর্যন্ত যা জানা গেলো
ভারতে চিকিৎসা করাতে গিয়ে খুন হয়েছেন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার। তবে তার মরদেহ নিয়ে এখনও রহস্যের জট খোলেনি। এমপি আনারের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে কি না, সেই বিষয়ে এ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ।
গত ১২ মে ভারতের কলকাতায় আসার পর দিন ১৩ মে থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যান ঝিনাইদহ-৪ আসনের এই সংসদ সদস্য। চিকিৎসার কথা বলে পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার পর সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার ১২ মে দর্শনা–গেদে সীমান্ত দিয়ে কলকাতা আসেন।
কলকাতায় এসে তিনি উঠেছিলেন দীর্ঘদিনের পরিচিত বরানগরে গোপাল বিশ্বাস নামে এক বন্ধুর বাড়িতে। দু’দিন সেখানে থাকার পর ১৪ তারিখ তিনি গোপালকে জানান, বিশেষ প্রয়োজনে তিনি বের হচ্ছেন, আজই ফিরে আসবেন। তবে তার পরদিনও আনার না ফেরায় গোপাল নিখোঁজ ডায়েরি করেন।
যেভাবে খুনের খবর এলো
এরপর বুধবার সকালের দিকে তার খুনের খবর সামনে আসে। জানা যায়, কলকাতার কাছেই নিউ টাউনের অভিজাত আবাসন সঞ্জীবা গার্ডেনের (ব্লক ৫৬ বিইউ) একটি ফ্ল্যাটে আনারকে খুন করা হয়। এদিন সকালের দিকে ঘটনাস্থলে যায় স্থানীয় বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের অধীনস্ত নিউটাউন থানার পুলিশ।
পরে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসে ফরেনসিক টিম, ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিশেষজ্ঞ, পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সদস্যরা। এমনকি খুনের গুরুত্ব অনুধাবন করে তদন্তে নামে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (সিআইডি)। তখনও পুলিশ এমপি আনারের মরদেহ পাওয়া গেছে কি না, সেটা বলেনি।
বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও বলেছেন, “মরদেহ আমাদের হাতে আসেনি।” আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, বিধাননগরের যে ফ্ল্যাটে আনোয়ারুল আজিমকে হত্যা করা হয়েছে সেখানে তার মরদেহ পাওয়া যায়নি। এতে করে ‘খুন’ বিষয়টি কীভাবে নিশ্চিত হওয়া গেলো, সেই প্রশ্নও উঠেছে।
পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ যা বলছে
বুধবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের আইজি (সিআইডি) অখিলেশ চতুর্বেদী বলেন, বাংলাদেশের এমপি আনোয়ারুল আজিম ব্যক্তিগত সফরে এসে এখান থেকে নিখোঁজ হয়ে যান। ১৮ মে ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের কাছে একটি নিখোঁজ ডায়েরি করা হয়।
সংসদ সদস্যের পরিচিত গোপাল বিশ্বাস এই অভিযোগ দায়ের করেন এবং সেই অভিযোগের ভিত্তিতেই তারা তদন্ত শুরু করি। এই তদন্ত করার জন্য একটি বিশেষ তদন্তকারী দল (এসআইটি) গঠন করা হয়। এরপর গত ২০ মে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করার নির্দেশ দেয়।
তিনি বলেন, “বুধবার আমাদের কাছে একটি তথ্য আসে যে তাকে খুন করা হয়ে থাকতে পারে। এরপরই আমাদের পুলিশ এই ফ্ল্যাটটিকে শনাক্ত করে কারণ, এখানেই তাকে শেষবার তার দেখা গিয়েছিলো।” মামলার তদন্তভার সিআইডির হাতে দেয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান।
ওই পুলিশ কর্মকর্তা আরো জানান, তারা এখনো লাশ উদ্ধার করতে পারেনি। তিনি বলেন, “আমরা মামলার তদন্ত শুরু করেছি। আমাদের কাছে যা তথ্য আছে তাতে ১৩ তারিখে ওই এমপি এই আবাসনে ঢুকেছিলেন। তবে এর আগে এসেছিলেন কি না সেটি আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়।”
তার সঙ্গে আরো কয়েকজন ছিলেন কি না, তা এখনো তদন্ত সাপেক্ষ বলেও জানান পুলিশের আইজি। ওই সংসদ সদস্যের মরদেহ টুকরো টুকরো করা হয়েছে বলে যে খবর সামনে এসেছে সে বিষয়ে প্রশ্ন করলে অখিলেশ চতুর্বেদী বলেন, তদন্ত শুরু করা হয়েছে। এটা এখনই বলা সম্ভব নয়। ফরেনসিক টিম, ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিশেষজ্ঞ, ফটোগ্রাফি সকলকেই এই তদন্তে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তারা খতিয়ে দেখছেন।
তিনি জানান, যে ফ্ল্যাট বাংলাদেশের এমপি এসে উঠেছিলেন সেটি সন্দীপ রায় নামে এক ব্যক্তির। তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আবগারি দপ্তরে কাজ করেন। সন্দীপ রায় ফ্ল্যাটটি ভাড়া দিয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (প্রবাসী বাংলাদেশি) বাসিন্দা আখতারুজ্জামান নামে এক ব্যক্তিকে।
বন্ধু গোপালের ডায়েরি, অবস্থান নিয়ে বিভ্রান্তি
গত ১৮ মে বরাহনগর থানায় আনোয়ারুলের নিখোঁজের যে অভিযোগ দায়ের করা হয় তা নিয়ে চূড়ান্ত বিভ্রান্তি রয়েছে। বরাহনগর থানায় যে নিখোঁজের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে সে অনুযায়ী, গত ১২ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বরানগর থানার অন্তর্গত ১৭/৩ মণ্ডল পাড়া লেনের বাসিন্দা তার দীর্ঘদিনের পরিচিত গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন আনোয়ারুল আজিম।
মূলত চিকিৎসার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ থেকে ভারতে ওই বন্ধুর বাড়িতে যান এমপি আনোয়ারুল। পরদিন ১৩ মে দুপুর ১.৪১ মিনিটে ডাক্তার দেখানোর উদ্দেশ্যে বের হয়ে যান। যাবার সময় বলে যান, তিনি দুপুরে খাবেন না। সন্ধ্যায় ফিরবেন। যাওয়ার সময় নিজেই গাড়ি ডেকে বিধান পার্ক এলাকায় ক্যালকাটা পাবলিক স্কুলের সামনে থেকে গাড়িতে উঠে চলে যান।
কিন্তু পরে সন্ধ্যায় বন্ধুর বাসায় না ফিরে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দেন, তিনি দিল্লি চলে যাচ্ছেন। দিল্লিতে গিয়ে তিনিই ফোন করবেন। দু’দিন পর ১৫ মে সকাল ১১.২১ মিনিটে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করে জানান তিনি দিল্লি পৌঁছে গেছেন। তার সাথে বেশ কিছু ভিআইপি ব্যক্তি রয়েছে, তাই তাকে ফোন করার দরকার নেই। প্রয়োজনে তিনিই ফোন করে নেবেন।
এই সব মেসেজ নিজের ব্যক্তিগত সহকারীকে (পিএ) জানানোর পাশাপাশি বাংলাদেশে তার বাড়িতেও পাঠিয়ে রাখেন বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের এই সংসদ সদস্য। এরপর গত ১৬ মে সকালবেলা দিল্লি থেকে আনার তার ব্যক্তিগত সহকারীকে ফোন করেন। কিন্তু সে সময় তার সহকারী ফোন ধরতে পারেননি। কিন্তু পরে যখন তিনি ফিরতি ফোন করেন, সে সময় এমপির দিকে থেকে কোন রকম উত্তর পাওয়া যায়নি।
গত ১৭ মে এমপির মেয়ে বাংলাদেশ থেকে গোপাল বিশ্বাসকে ফোন করে জানান তিনিও তার বাবার সাথে কোনভাবেই যোগাযোগ করতে পারছেন না। ওই ঘটনার পর থেকেই গোপাল ঝিনাইদহে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলেও এমপি আনারের সঙ্গে নোভাবেই যোগাযোগ করে উঠতে পারেননি।
পরে গত ১৮ মে বরাহনগর থানায় একটি নিখোঁজের ডায়েরি করেন গোপাল বিশ্বাস। থানার থেকে পুলিশের এক প্রতিনিধি দল অভিযোগকারী গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে আসেন। এরপর থেকে গত কয়েকদিন ভারতে তার অবস্থান নিয়ে নানা জল্পনা ছড়ায়।
কখনও মুজাফফরপুর আর কখনও দিল্লিতে তার অবস্থান ছিলো বলে বিভিন্ন সূত্র জানায়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান হারুন অর রশীদও সাংবাদিকদের মুজাফফরপুরের কথা জানান। থানায় অভিযোগ পত্রে উল্লেখ দুইটি মোবাইল নম্বরে (একটি ভারতীয় সিম) যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তা বিফলে যায়। এমনকি পুলিশও তার মোবাইল ট্র্যাক করে ভারতের বিহার-ঝাড়খন্ড সীমান্তে শেষ লোকেশন পায়।
অবশেষে নিখোঁজ থাকার প্রায় ১০ দিন পর বুধবার তার মৃত্যুর বিষয়টি সামনে আসে। এদিন সকালে নিউটাউনের ওই অভিজাত আবাসনে আসে নিউটাউন থানার পুলিশ। পরে ওই নির্দিষ্ট ফ্ল্যাট খুলে তার ভেতরে রক্তের দাগ দেখতে পায় তারা।
এখন পর্যন্ত যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, এমপি আনার খুনের ঘটনায় দেশে তিন জনকে আটক করা হয়েছে। তাদের মধ্যে দুই জন সম্প্রতি কলকাতা থেকে বাংলাদেশে এসেছেন। আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন, হত্যাকাণ্ডের ‘মূলহোতা’সহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি পুলিশ। কলকাতা পুলিশও সন্দেহভাজন দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
দুই দেশে দুই মামলা
বুধবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় খুন করার উদ্দেশ্যে অপহরণের অভিযোগে মামলাটি দায়ের করেন এমপি আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। শেরে-বাংলা নগর থানা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহাদ আলী বলেন, অজ্ঞাতদের আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এখন তদন্ত করে আসামিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। এমপি আনার সংসদ ভবন এলাকায় থাকতেন। সেখান থেকে তিনি ভারতে গেছেন। তাই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) প্রধান হারুন-অর-রশিদের পরামর্শে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা দায়ের করেন তার মেয়ে।
এদিকে বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমের খুনের ঘটনা নিয়ে কলকাতার নিউ টাউন থানায় হত্যা মামলা দায়ে করা হয়েছে। পুলিশ বাদি হয়ে এই মামলা রুজু করেছেন। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়েছে সন্দেহে একটি গাড়ি আটক করেছে কলকাতা নিউ টাউন পুলিশ। বুধবার নিউ টাউন থানার সামনে গাড়ির ভেতর থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছে ফরেনসিক টিম। গাড়ির মালিক গাড়িটি ভাড়ায় ব্যবহার করতে দিয়েছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে