বিশেষ সংখ্যা: কাছের বঙ্গবন্ধু
মিস্টার মিউজিক
১৯৭২ সালের এপ্রিল-মে মাসের ঘটনা, বাংলাদেশ সেনাবাহিনি যখন গ্রামগুলো পুনর্নির্মাণ করছিল, সেই সময় এক নাটকীয় ঘটনা ঘটে। এই নাটকের মূলচরিত্র সংগীতশিল্পী সমর দাস। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের রেডিও ও টেলিভিশনের সংগীত পরিচালক। যদিও তার সঙ্গে আমার আগে কখনো দেখা হয়নি, তবুও তাকে আমি চিনতাম। তার খ্যাতি ছিল বাংলাদেশের ‘মিস্টার মিউজিক’ হিসেবে।
তিনি অনেক দেশাত্মবোধক গানের সুর করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংযজ্ঞের দিনগুলোতে তার সুর লাখো বাঙালির কণ্ঠে ও চেতনায় আগুন জ্বালিয়েছিল। সমর দাস ও তার গান বাংলাদেশের জীবন্ত কিংবদন্তি। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের সম্পূর্ণ সুরবিন্যাসের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তাকে। তিনি শুধু অসামান্য সুরকারই ছিলেন না, খুব ভালো পারফর্মও করতে পারতেন। তিনি নিজেও ভালো গান গাইতেন, আর খুব ভালো হারমোনিয়াম বাজাতেন। বাংলাদেশে তিনিই সম্ভবত সবচেয়ে উচ্চস্তরের নামমাত্র খ্রিষ্টান ছিলেন।
১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসের ১৩ তারিখ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কার্যালয়ের দরজাটি হাট করে খুলে গেল। একজন প্রবেশ করলেন অতর্কিতে। প্রধানমন্ত্রী আর তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা হা করে তাকিয়ে রইলেন অস্থির উত্তেজিত মানুষটির দিকে। মানুষটির আকস্মিক আগমনে মন্ত্রীদের কয়েকজন হতবাক। শত হলেও তারা বাংলাদেশের নেতৃত্বের শীর্ষস্থানীয় লোকজন। জরুরি বিশেষ সভা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে ভেতরে প্রবেশ না করার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। আর প্রত্যেকেই ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের এমন অনুগত যে তার কথার নড়চড় হবে এমন কোনো উপায় নেই।
আকস্মিক আগন্তুক হলেন বাংলাদেশের বিখ্যাত সুরকার সমর দাস। দ্বিধান্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলেন দরজার কাছেই। বয়স তার তখন চল্লিশ, চুল হালকা ধূসর, বাঙালিদের তুলনায় একটু লম্বা। সুদর্শন লোকটির চোখেমুখে তখন বিষাদের ছায়া।
শেখ মুজিবুর রহমান বললেন, ‘কী হইছে সমর, তোমারে এমন দেখাইতেছে কেন?’
প্রধানমন্ত্রীর ডাক শুনেও সমর দাস কয়েক মুহূর্ত কথা খুঁজে পেলেন না। চোখেমুখে একরাশ বেদনা নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
প্রধানমন্ত্রী ধৈর্য সহকারে ডাকলেন, ‘সমর দাস, এখানে আসো। কী হইছে আমাকে বলো। কী নিয়ে এত উতলা হয়ে গেলা, বলো, যেন আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি।’
কাছে এসে সমর দাস প্রিয় নেতাকে জড়িয়ে ধরলেন, মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছিল না, বিড়বিড় করে বললেন, ‘আমার ছেলেকে বাঁচান। তাকে অন্য হাসপাতালে (চট্টগ্রামের এক মিশনারি হাসপাতাল) নিতে হবে। রাস্তাঘাটের যা অবস্থা, গাড়িতে নিয়ে গেলে পথেই সে মারা যাবে।’
পরে সমর দাস এই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছিলেন এভাবে, একজন অসহায় পিতার সমস্ত আকুলতা নিয়ে, তার সমস্ত শক্তি আর আশা একত্রিত করে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করলেন, ‘আপনার ব্যক্তিগত হেলিকপ্টারটি আমার এই মুহূর্তে দরকার।’
এই ঘটনার সাথে জড়িয়ে পড়ার কারণে সমর দাসকে আমি প্রথম দেখি। তখন তার একেবারেই ভগ্নদশা। তার সাথে সাক্ষাতের আগেই তার গুরুতর অসুস্থ ছেলেকে আমি দেখতে এসেছিলাম। আমাকে যে বন্ধুটি নিয়ে এসেছিলেন, (ঢাকা মিশনারির ক্যালভিন ওলসন) তিনি সমর দাসেরও বন্ধু ছিলেন। ঢাকা হাসপাতালের অন্ধকার ওয়ার্ডের এক বিছানায় ১১ বছর বয়সি আলবার্ট দাস অচেতন হয়ে পড়ে আছে। ১৩ দিন ধরে সে গভীর কোমায়। পোঁছানোমাত্রই আমি তার নাকের ফুটো দিয়ে ঢুকানো তরল খাওয়ানোর নলটি দেখেছি। আবছা আলোয় ছেলেটিকে বড় ফ্যাকাশে লাগছিল। স্থির হয়ে পড়ে আছে। শ্বাসযন্ত্রের মৃদু স্পন্দন ছাড়া শরীরে প্রাণের আর কোনো সাড়া নেই। পরিবারের আপজনরা নিঃশব্দে কাঁদছিলেন। মুমূর্ষু রোগী পাহারা দিতে দিতে তাদের চোখেমুখে রাত্রি জাগরনের ক্লান্তি। ছেলেটির বাবাকে কোথাও দেখলাম না।
ছেলেটির কী হয়েছে সব জেনেবুঝে নিয়ে, তার বাবা আসার আগেই আলবার্টের মায়ের সাথে কিছুক্ষণ কথা বললাম। তিনি দ্রুত সব বললেন, স্পষ্ট বাংলায়। ওই দেশে অনেক দিন থাকার কারণে তার কথা বুঝতে আমার সমস্যা হয়নি। তার কথা শুনে বুঝলাম শিশুটির সমস্যা কল্পনার চেয়ে দুরূহ। চিকিৎসকদের সে এক ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে। আলবার্ট শুধু অচেতনই না, তার বাঁম হাত, বাঁম পা এবং মুখের একটা অংশ সম্পূর্ণ পক্ষাঘাতগ্রস্ত। আমি নিশ্চিত যে তার মস্তিষ্কে এমন কোনো টিউমার বেড়ে উঠেছে, যার ফলে তার মস্তিষ্কে ঠিক মতো অক্সিজেন পৌঁছাচ্ছে না। যাকে বলে ‘ইন্ট্রাক্রেনিয়াল স্পেস-অকুপাইং লেজন’। এরকম পিণ্ড সাধারণত মস্তিষ্কে টিউমার হলেই হয়।
এর মধ্যে সমর দাস এলেন। নিজের পরিচয় দিলেন, ‘ও, আপনি এসেছেন! আমি তেমন ধার্মিক মানুষ নই, তারপরও দুদিন ধরে প্রার্থনা করছিলাম কোনোভাবে যদি আপনার দেখা পাওয়া যায়। শুনেছিলাম আপনি বাংলাদেশে এসেছেন। আর কী ভাগ্য, এখন আপনি আমার ছেলের পাশে।’
সমর সংক্ষেপে জানালেন কেন তিনি এতক্ষণ হাসপাতালে ছিলেন না। ‘‘ডা. ওলসেন, আপনার সাথে সাক্ষাতের কোনো উপায়ই আমার জানা ছিল না। আমি পাগলের মতো চেষ্টা চালিয়েছি। তেরোটা দিন গেল, আমার ছেলের কোনো উন্নতি নাই। দিন দিন অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে। চরম হতাশার মধ্যেই আমি ভাবলাম, ‘আমার ছেলের জন্য যা করার আমি করব। তার জন্য যত মূল্য দিতে হয় হোক।’ তাই আমি পররাষ্ট্র মন্ত্রীর কাছে গিয়েছিলাম সাহায্য চাওয়ার জন্য। যদি আমার ছেলেকে বিদেশে কোথাও নিয়ে যাওয়া যায়। যে- কোনো দেশে। আমি আমার ছেলেকে এভাবে মরতে দিতে চাই না। হাসপাতালে ঢুকে যখন আপনাকে দেখলাম, যার কথা আমি এত শুনেছি, এত অভিজ্ঞ সার্জন আপনি, আমার ছেলের মুখের ওপর উপুড় হয়ে আছেন, এটা আমার কাছে ঈশ্বরের কাছ থেকে পাওয়া এক অলৌকিক ঘটনা বলে মনে হলো!’’
‘তেমন ধার্মিক নই’ এমন মানুষের মুখে এসব কথা বড় অদ্ভুত শুনাল।
শিশুটির পিতা জানতে চাইলেন তার সন্তানের জন্য কী করা যায়। আলবার্টের চিকিৎসার দায়িত্বে আছেন এখন এক মেডিসিনের ডাক্তার, তার সাথে আগে কথা বলা দরকার। তিনি আমার পুরনো বন্ধু। তিনি পূর্ণ সহযোগিতা করলেন। রোগীর খুলিতে ফুটো করে মস্তিষ্কে বাতাস ঢুকাতে হবে। আমার প্রস্তাবে রাজি হলেন পরিবারটি। প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল। কিন্তু, এ ছাড়া আর কী-ইবা করার আছে? আলবার্টকে বাঁচানোর আর কোনো পথ নেই। একঘণ্টার মধ্যে অপারেশনটি সারতে হবে, পুরো মস্তিষ্ক খুলে মাথার ভেতরের টিউমারটি কাটতে হবে। অধ্যাপক প্রতিজ্ঞা করলেন এমন জটিল অপারেশনের করার মতো নিউরোসার্জন ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ঢাকায় আছে কি না খোঁজ নিয়ে আমাকে পরদিন জানাবেন।
রাতে সমর ও তার স্ত্রীকে সব জানালাম। স্বাভাবিকভাবেই শিশুটির পিতা-মাতা এ নিয়ে চিন্তায় অস্থির হয়ে ছিলেন। অনেক রাতে তাদের সব উদ্বিগ্ন প্রশ্নের উত্তর দিলাম। আমি জানলাম চার বছর আগে তাদের একটি সুন্দর কন্যার মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে উপর থেকে পড়ে। কিছু প্রশ্ন ছিল আধ্যাত্মিক ঘরনার, সমর দাস ও তার স্ত্রী এখন ঈশ্বরের শুভদৃষ্টির ওপর নির্ভর করছেন। পরিত্রাণ এবং অনন্ত জীবন সম্পর্কে বাইবেলের শিক্ষার সাথে সমর দাস ও তার স্ত্রীর কোনো পরিচয় ছিল না বলেও জানালেন। আমি তাদের আমার বিশ্বাসের কথা জানালাম। বললাম, চলুন একসঙ্গে প্রার্থনা করি, যেন আপনাদের সন্তানকে ঈশ্বর আপনাদের কাছে ফিরিয়ে দেন।
পরদিন সেই অধ্যাপক জানালেন ঢাকা শহরে ওই অপারেশন করা সম্ভব না। যুদ্ধ-পরবর্তী ঢাকা শহর তখনো ভঙ্গুর। পরিবারটিকে আমি জানালাম, বিদেশে নিয়ে যেতে পারলে খুব ভালো হয়। বিদেশের কোনো নিউরোসার্জনের হাতে সবচেয়ে অত্যাধুনিক চিকিৎসা পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু, এখন সেই সময়ও নেই হাতে। আমি বললাম, যদিও আমরা সাধারণ সার্জন, তবুও প্রয়োজনে আমরা নিউরোসার্জিক্যাল কেস হাতে তুলে নেই। সে ক্ষেত্রে রোগীকে মেমোরিয়াল খ্রিষ্টান হাসপাতালে (চট্টগ্রামের মালুমঘাটের খ্রিষ্টান মেমোরিয়াল হাসপাতাল) নিয়ে যেতে হবে।
সমর দাস বেপরোয়া হয়ে জবাব দিলেন, ‘আমি আর আমার স্ত্রী বিশ্বাস করি আমাদের প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে ঈশ্বর আপনাকে এখানে পাঠিয়েছেন। আলবার্টকে আপনার হাসপাতালে নিয়ে যান। ‘তেমন ধার্মিক নই’ মানুষটির মুখে এ-কথা আরো বেশি অদ্ভুত শুনাল।
কিন্তু, কথা হচ্ছে, এখন এই অসুস্থ শিশুটিকে ঢাকা থেকে এতদূর আমাদের হাসপাতালে কীভাবে নিয়ে যাই? অবশ্যই আমাদের বিমানে যেতে হবে। ২৫০ মাইলের ভাঙা রাস্তায় আলবার্টকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। যেখানে বাণিজ্যিক বিমান উঠা-নামা করে সেই বিমানবন্দরটিও হাসপাতাল থেকে ৭০ মাইল দূরে। আলবার্টের জন্য বিশেষ ফ্লাইটের প্রয়োজন।
বিমানবন্দরে গিয়ে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সর্বাধিনায়কের সাথে দেখা করব বলে জানালাম। (কমান্ডার ইন চিফ এ কে খন্দকার)। একজন অফিসার নিরাপত্তার বেষ্টনী দিয়ে আমাকে তার কাছে নিয়ে গেলেন। কংক্রিটঘেরা এক বিল্ডিংয়ের ভেতরে। বিমান বাহিনির প্রধান বললেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটা পরিত্যক্ত বিমানঘাঁটি আছে আপনাদের হাসপাতালের ৬ মাইলের মধ্যে, জাতিসংঘের একটা ছোট বিমানও আছে সেখানে নামতে পারবে, কিন্তু, ওই বিমানবন্দর এখন কী অবস্থায় আছে সেটা আগে দেখতে হবে। বিমান অবতরণের অবস্থা আছে কি না জানি না। তার কথা শুনে আমি দমে গেলাম। বিমান বাহিনির প্রধান বললেন, ‘এ ছাড়া আর একটা উপায়ই আছে, যদি প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত হেলিকপ্টারটা পাওয়া যায়। আমার মনে হয় না পাওয়া যাবে। কিছুদিন আগে একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীও হেলিকপ্টারটা চেয়ে পাননি।’
আমি ক্যালভিন ওলসনকে পাঠালাম সমর দাসের কাছে। বললাম, তাকে গিয়ে বলুন প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলতে। যে করেই হোক হেলিকপ্টারটা যোগাড় করতে হবে। আমি যে কারণে ঢাকা এসেছি এর মধ্যে সেইসব জরুরি কাজ সারব।
সমর দাস আর ক্যালভিন তখনই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ছুটে গেলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত সচিব সমরের পরিচিত, কিন্তু, তারও কিছু করার নেই। তাকে বলা হয়েছে যার যত জরুরি কাজই থাক প্রধানমন্ত্রীকে এখন বিরক্ত করা যাবে না। হৃৎপিণ্ডের ধুকধুক নিয়ে সমর দাস বসে রইলেন দরজার সামনে, আধ ঘণ্টা, এক ঘণ্টা, দেড় ঘণ্টা যায়, আর সহ্য করতে না পেলে সমর দাস তার চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলেন, নিরাপত্তারক্ষীদের উপেক্ষা করে এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে, আচম্বিতে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লেন ভেতরে। একেবারে প্রধানমন্ত্রীর সামনে উপস্থিত, দাঁড়িয়ে রইলেন বাকরুদ্ধ হয়ে।
শেষ পর্যন্ত সমর দাস সব কথা খুলে বলতে পারলেন, শেষ ভরসা হিসেবে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত হেলিকপ্টারটি ব্যবহারের অনুমতি চাইলেন। বিচলিত মানুষটির মু্খের দিকে তাকিয়ে, তার আর্জি শুনে শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠক বন্ধ রাখেন, দ্রুত ঘুরে দাঁড়ান, টেলিফোনের রিসিভারটি হাতে তুলে নেন। বিমান বাহিনীর প্রধানকে ফোন করেন। সমর দাসের ছেলেকে নিয়ে মেমোরিয়াল ক্রিশ্চিয়ান হাসপাতালে যাওয়ার জন্য হেলিকপ্টারটি প্রস্তুত করার নির্দেশ দিলেন।
সমর দাস পরে বলেছেন, “আমি ওখান থেকে চলে আসার আগে, প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি তোমার ছেলের জন্য দোয়া করব। তোমার ছেলে তো আমারই ছেলে’।”
বর্ষার আগে আগে যা ঘটে, সেদিন বিকেলেও শুরু হলো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড়। কোনো বিমান আর আকাশে উড়তে পারল না সেদিন। পরদিন সকালে অ্যাম্বুলেন্সে করে আলবার্টকে নিয়ে এলাম বিমানবন্দর। স্ট্রেচারসমেত ওর অচেতন দুর্বল দেহটি হেলিকপ্টারের মেঝেতে শুইয়ে রাখলাম। সেলাইনের ব্যাগটি হেলিকপ্টারের সিলিংয়ের এক আংটায় লাগিয়ে দিলাম। গাদাগাদি করে হেলিকপ্টারে ঢুকলাম আমি, আলবার্টের বাবা, মা, বোন, মাসি। (আলবার্টের মা তখন নয় মাসের পোয়াতি!) হেলিক্টটারের ইঞ্জিন গর্জে উঠল, পাখা ঘুরতে শুরু করলো। হেলিকপ্টারের ভেতরটা কাঁপছে, বাতাস আমাদের উড়িয়ে নিচ্ছে।
দীর্ঘ যাত্রা পথে মনোরম গ্রাম আর পেঁচানো নদী পেরিয়ে যেতে যেতে বারবারই আমি আলবার্টকে পরীক্ষা করছিলাম। অবশ পায়ে কয়েকটি অনিচ্ছাকৃত কম্পন ছাড়া তার আর কোনো নড়াচড়া নেই। কিন্তু, তার ছোট্ট হৃৎপিণ্ডটি কাঁপছে। হাসপাতালের ০১ মাইলের মধ্যবর্তী দূরে হেলিকপ্টারটি নামল। বাকিটা পথ আমরা গেলাম অ্যাম্বুলেন্সে করে।
অবিলম্বে আমি জটিল নিউমো-এনসেফালোগ্রাম পরীক্ষার ব্যবস্থার পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু, কী যেন আমার মনকে নাড়া দিল। একটা পরিকল্পনা বাদ দিতে পারলাম না। পরীক্ষাটিতে একটু দেরি করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার কেন যেন মনে হলো অ্যালবার্টের মস্তিষ্কের বস্তুটি যক্ষ্মার জিবাণুদ্বারা সৃষ্ট পিণ্ডও হতে পারে। আমি ওকে যক্ষ্মা-বিরোধী শক্তিশালী ডোজ দিলাম। এতে আমার ঝুঁকি ও সম্ভাবনা ছিল অর্ধা-অর্ধি।
ডা. ডন কেচাম আর আমি এই চিকিৎসা তদারকি করছি। ঔষধ শুরু করার ছত্রিশ ঘণ্টা পরে, খুব সামন্যই উন্নতি লক্ষ্য করলাম।
হাসপাতালের কর্মচারীরাও ছোট্ট আলবার্টের জন্য প্রার্থনা করছিল, যেন ও আমাদের নিজেদেরই সন্তান। কাছের গির্জায় ওর জন্য বিশেষ প্রার্থনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
আরো ছত্রিশ ঘণ্টা একই চিকিৎসা চালিয়েছিলাম। প্রশ্নাতীতভাবে, আমরা রোগীর উন্নতি লক্ষ্য করলাম। পরম পিতার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালাম আকুণ্ঠ চিত্তে।
বিপজ্জনক অপারেশনটি আমাদের আর করতে হয়নি। একটু একটু করে দিনে দিনে ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় অ্যালবার্ট বিস্মৃতি থেকে জেগে উঠল।
একদিন জন্ম হলো আলবার্টের ছোট ভাইয়ের। চেতন ফেরার পর বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে আলবার্ট অস্থির হয়ে উঠল। ডন কেচাম বললেন, ছেলেটি ওর মায়ের অভাব অনুভব করছে। যে অস্পষ্ট জগতে সে এতদিন ডুবে ছিল তার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কয়েক দিন পরই আলবার্ট প্রথম শব্দটি উচ্চারণ করল। এটা একটা বেশ লক্ষণীয় উন্নতি। আলবার্টের পিতা-মাতার খুশি আর ধরে না। হাসপাতালের কর্মীরাও উচ্ছসিত। সবাই আত্মহারা।
সমর দাস গভীর আবেগে আমাকে বললেন, ‘ওর মা আর আমার বুক থেকে একটা পাথর নামল। যখন আপনি সেই বিপজ্জনক অপারেশনটি করার অনুমতি চাইলেন, আমরা চিন্তায় অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম, পিতা-মাতার পক্ষে কীভাবে এমন একটি অপারেশনের অনুমতি দেয়া সম্ভব, যখন ডাক্তার নিজে জানেন না তাদের সন্তানকে তিনি তাদের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারবেন কি না? কিন্তু, ঈশ্বর আমাদের ওই পাথর বুকে ধারণ করতে বাধ্য করেছেন। আর এখন মনে হচ্ছে এটা একটা অলৌকিক ঘটনা। অ্যালবার্টের আর অপারেশনের দরকার হবে না। আমার ছেলে তো মারাই গিয়েছিল। কিন্তু, এখন সে জীবিত!’
আলবার্টের বাবা হাসপাতাল কক্ষের জন্য একটা পেইন্টিং কিনে এনেছিলেন। যিশু খ্রিস্টের অপূর্ব এক ছবি, যেখানে দেখা যাচ্ছে জেসাস দরজায় ঠকঠক করছেন। শিল্পী হোলম্যান হান্টকে যে-কারণে ছবিটি আঁকতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল, আমরা জেসাসের সেই কথাগুলো নিয়ে একসঙ্গে অনেক আলোচনা করেছি, ‘দেখো, আমি তোমার দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে আছি, দরজার কড়া নাড়ছি, যদি কেউ আমার কণ্ঠস্বর শুনে, এবং দরজা খোলে, আমি তার কাছে আসি।’
সমর বুঝতে পেরেছিলেন যে এটি তার অনন্ত জীবনের উত্তর। এখন তার ক্ষমাপ্রার্থনার সময়। এখন তার হৃদয়ের দরজা উম্মুক্ত করা প্রয়োজন। জীবনে যিশুকে ধারণ প্রয়োজন। আলবার্ট হাসপাতালে আসার বারো দিনের মাথায় এক ভোরবেলা- সমর দাস সারারাত সজাগ থেকে, তার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন থেকে, ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তার সন্তানের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য সেই বিরাট সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করেন- সেই মহান চিকিৎসকের জন্য তার হৃদয়ের দরজা খুলে দেন।
সমর দাসের সঙ্গে আমার এক ভাতৃত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়। আমার নতুন ভাইটি আমাকে পরে বলেছেন, ‘আমি আপনাকে বলেছিলাম ডাক্তার, যদি বিশ্বাসী হই, আপনিই প্রথম জানতে পারবেন।’ আনন্দ ও স্বস্তিতে তার চোখ ভরে গিয়েছিল অশ্রুজলে।
একদিন আলবার্ট উঠে বসল। কিছুদিনের মধ্যেই তার অবশ পায়ে নড়াচড়া সৃষ্টি হলো। সবশেষে সাড়া দেয় তার বাঁম হাতে। ফিজিওথেরাপি চলতে থাকে। অনেক কষ্টে একদিন ও উঠে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। দুএকটি পা ফেলে। শীঘ্রই সে পুরো হাসপাতাল মাতিয়ে তোলে। তার হাসি সংক্রামকের মতো পুরো হাসপাতাল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। অন্য রোগীরা তাকে দেখে উল্লাশে মেতে ওঠে। আমার মনে আছে, একদিন আমি আর ডন ওর কক্ষে গেছি, আলবার্ট ওর ড্রয়ার থেকে বের করে আমাদের ক্যান্ডি বার দিল। ও চকোলেট ভালোবাসতো খুব!
সন্তানকে ফিরে পাওয়া আনন্দে এবং নিজের বিশ্বাস ফিরে পাওয়ার রোমাঞ্চে সমর ঈশ্বরের নাম নিতে চাইলেন সংগীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। মালুমঘাটে আমরা প্রথমবারের মতো সংগীত-পরিবেশনার আয়োজন করলাম। জেসাসের সত্যিকারের ফুল তার সংগীতসাধনার মধ্য দিয়ে ফুটেছে। তার পরিবেশনা আমাদের হৃদয়কে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল।
আলবার্ট যখন ঠিকঠাক হাঁটতে সক্ষম হলো আমরা তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিলাম। দাস পরিবার যখন ঢাকার দিকে রওয়ানা দিচ্ছিল সেদিনটি ছিল দেখার মতো। সেই আনন্দের দিনে হাসপাতলের সব কর্মচারীরা তাদের বিদায় জানিয়েছিল।
ঢাকা ফেরার কিছুদিন পরেই সমর দাস প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন। এবার আর অতর্কিতে ঢুকে পড়েননি, আগে থেকে জানিয়ে সব নির্দেশনা মেনেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। কিন্তু আবেগের মুহূর্তটি ছিল আগের মতোই। আগের মতো এবারও তার চোখ ভরা ছিল জলে। তবে, এবার আনন্দের অশ্রু। এবার প্রধানমন্ত্রীর সামনে দাঁড়াতে সমর দাস ভয়ও পাননি। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে সব জানালেন। কীভাবে হেলিকপ্টারে করে ছেলেকে নিয়ে গেছেন। ওটা ছিল ছেলেকে বাঁচানোর যাত্রা। অপারেশনে দেরি করার কঠিন সিদ্ধান্তটির কথা জানালেন। চিকিৎসা-ব্যবস্থার সব কথাই জানালেন। জানালেন কী করে আলবার্ট একটু একটু করে কথা বলতে শিখল, উঠে বসতে শিখল, পা ফেলতে শিখল, আর সবার সাথে চকোলেট ভাগাভাগী করতে শিখল।
সমর দাস শেখ মুজিবকে বললেন, ‘স্যার, হাসপাতালের সবকিছুর সাথে মিশে ছিল মানুষের প্রার্থনা। গির্জার মানুষেরা সবরকমভাবে আমাদের সাহায্য করেছেন, সব সময় আমাদের জন্য প্রার্থনা করেছেন। সেবিকারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে আলবার্টের দেখাশোনা করেছেন, আর প্রার্থনা করেছেন। ডা. ওলসেন আর ডা. কাচেমও খুব দক্ষতার সাথে আলবার্টের চিকিৎসা করেছেন আর প্রার্থনা করেছেন। ঈশ্বর তাদের পরিচালনা করেছেন। অপারেশন করাতে দেরি করাতে ঈশ্বরেরই হাত ছিল। আর যথাযথ ওষুধ দেয়াতেও। ঈশ্বর আমাদের সব প্রার্থনা শুনেছেন। আপনার ব্যক্তিগত হেলিকপ্টারটি দেয়াতেই সব সম্ভব হলো। আপনাকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা আমার জানা নাই’
মহামান্য শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা, সাড়ে সাত কোটি মানুষের নেতা ছোট্ট ছেলেটির সুস্থতার খবরে আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন।
তিনি বললেন, ‘সমর, শুনে ভালো লাগছে যে তোমার ছেলে সুস্থ হয় গেছে। ওকে হাসপাতাল নেয়ার জন্য আমি হেলিকপ্টারটি দিতে পেরে সত্যিই আনন্দিত। ’
একটু থেমে প্রধানমন্ত্রী নরম সুরে বললেন, ‘কিন্তু, সমর, এ কথাও মনে রেখো, আমিও তোমার ছেলের জন্য দোয়া করেছিলাম।’
সমর যখন মুজিবের কথা আমাকে বললেন আমি একটু ধাক্কা খেলাম। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশটি উদ্ধারে যখন তিনি ব্যস্ত, চারদিকের বিশৃঙ্খলা দূর করতে সচেষ্ট, বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশটির প্রধানমন্ত্রী প্রতিদিনের দমবন্ধ-করা কাজ সামলে, রাষ্ট্রের জটিল সব সমস্যার মধ্যেও একজন ব্যক্তিমানুষের সমস্যায় এগিয়ে আসেন! এমনই মানুষ ছিলেন শেখ মুজিব!
সূত্র: নিবন্ধটি ভিাগো ওলসেনের আত্মজীবনীমূলক বই ‘ডাক্তার ডিপ্লোম্যাট ইন বাংলাদেশ’ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
ভিগো ওলসেন পেশায় একজন শল্যচিকিৎসক। জন্ম যুক্তরাষ্ট্রে। তিনি ১৯৬২ সালে মিশনারি ডাক্তার হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। তার উদ্যোগে কক্সবাজারের মালুমঘাটে ১৯৬৬ সালে যাত্রা শুরু করে খ্রিষ্টান মেমোরিয়াল হাসপাতাল। এই হাসপাতালেই সংগীতশিল্পী সমর দাসের ছেলে আলবার্টের চিকিৎসা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম কয়েক মাস তিনি সেখানেই ছিলেন। তবে ৩০ মে বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য হন। স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ত্রাণ তৎপরতা চালাতে ‘বাংলাদেশ ব্রিগেড’ নিয়ে ফেরত আসেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭২ সালের ১৩ জুন তাঁর হাতে তুলে দেয়া হয় বাংলাদেশের প্রথম ভিসা, যার নম্বর ছিল ০০১।
অনুবাদ: কামরুল আহসান
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে