ক্রীড়াঙ্গনে বাড়ছে কাদা ছোড়াছুড়ি
কাবাডি খেলার গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হচ্ছে রেইডারকে টেনে ধরা। দেশের নানা সেক্টরে কাবাডির এ কৌশলের মতো পেছন থেকে টেনে ধরার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এ কারণেই কি কাবাডিকে জাতীয় খেলার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে? প্রশ্নটা হাস্যকর বটে; কিন্তু অবান্তর নয়। এ কথায় যদি আপনার আপত্তি থাকে ক্রীড়াঙ্গনের একটু গভীরে প্রবেশ করে দেখুন। পেছন থেকে টেনে ধরার চিত্রটা পরিষ্কার হবে। পরিষ্কার হচ্ছে ৯ জাতীয় ক্রীড়া ফেডারেশনে অ্যাডহক কমিটি গঠনের পর থেকে।
৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে ক্রীড়াঙ্গনকে রাজনীতির জিম্মিদশা থেকে মুক্ত করতে সার্চ কমিটি গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সে কমিটি বিভিন্ন ক্রীড়া ফেডারেশনের সবার সঙ্গে আলোচনা করেছে। তার ভিত্তিতে বিভিন্ন ফেডারেশনের কমিটি গঠনে সুপারিশ করছে। যাদের নিয়ে কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়েছিল, তাদের অতীত-বর্তমান যাচাই করা হয়েছে। নেয়া হয়েছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনও। এভাবে কয়েক স্তরের যাচাই-বাছাইয়ের পর ক্রীড়া ফেডারেশনের কমিটি ঘোষণা করা হয়। ঘোষিত কমিটির কর্মকর্তাদের এখন আওয়ামী দোসর বানানোর প্রচেষ্টা বিদ্যমান!
আন্তর্জাতিক কাবাডি প্রতিযোগিতায় অ্যাকশনে বাংলাদেশ দল। এ ছবির মতো কাবাডি সংশ্লিষ্টদদের মাঝেও একজন আরেকজনকে টেনে ধরার প্রবণতা লক্ষনীয়। ছবি: সংগৃহীত
দেশের ক্রীড়াঙ্গনে ক্রীড়াসুলভ আচরণের অভাব ছিল। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেটা উধাও হয়ে যাচ্ছে। হকি ফেডারেশন, কাবাডি ফেডারেশন, অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের কমিটি নিয়ে যে কাদা ছোড়াছুড়ি শুরু হয়েছে বা হচ্ছে। তা ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে কোনোভাবেই মানানসই নয়। সার্চ কমিটি কাজ শুরুর পর হকি সংশ্লিষ্টরা রীতিমতো হাস্যরসের খোরাক জুগিয়েছে। সার্চ কমিটিতে থাকা সাবেক হকি খেলোয়াড় মেজর (অব.) ইমরোজ আহমেদের বিরুদ্ধে হুট করেই মানবন্ধন করে একটা পক্ষ। পরদিন আরেক পক্ষ তার প্রতিবাদে একাট্টা হয়েছিল। কমিটি গঠনের পর নানা ফিরিস্তি টেনে আনেন হকি ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাজেদ এ এ আদেল; যিনি অ্যাডহক কমিটির সাধারণ সম্পাদক হওয়ার দৌড়ে ছিলেন। এটা পরিষ্কার যে, পদ না পাওয়ার হতাশা থেকে গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে পাঠানো বার্তায় বিভিন্ন ব্যক্তিকে নিয়ে তির্যক মন্তব্য করা হয়েছে।
সাজেদ এ এ আদেল সাবেক খেলোয়াড়, অভিজ্ঞ সংগঠক- দীর্ঘদিন মোহামেডানের হকি কমিটির দায়িত্ব পালন করেছেন। তার চিঠির ভাষা তির্যক হলেও সেটা হজম করা যাচ্ছে; কিন্তু বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশনের যা শুরু হয়েছে, তা আসলে সভ্যতার ধার ধারছে না! ফেডারেশনের সাবেক কর্মকর্তা এস এম এ মান্নান বিভিন্ন মাধ্যমে অ্যাডহক কমিটির সাধারণ সম্পাদক এস এম নেওয়াজ সোহাগের দুর্নীতি নিয়ে বেশ সরব। তার দাবির পক্ষে আদৌ কোনো প্রমাণ আছে কি না- জানতে চাওয়া হয়েছিল। কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি। আমতা আমতা করে এস এম এ মান্নান এক পর্যায়ে বল ঠেলে দিয়েছেন বিগত কমিটির যুগ্ম সম্পাদক এবং পুলিশের অ্যাডিশনাল ডিআইজি (ডেভেলপমেন্ট) গাজী মোজাম্মেল হকের কোর্টে। গাজী মোজাম্মেল হক দাবি করেন, প্রতিশ্রুতি মাফিক কাবাডি ফেডারেশনকে অর্থ প্রদান করেননি এস এম নেওয়াজ সোহাগ; কিন্তু তার পক্ষে কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি।
কাবাডি ফেডারেশন নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি ওই পর্যন্ত থেমে গেলে মেনে নেয়া যেত; কিন্তু সেটা ওখানে থামেনি। ১৯ নভেম্বর কাবাডি ফেডারেশনের সাবেক দুই সদস্য মো. মেহেদী হাসান সুমন এবং মো. দেলোয়ার হোসেন স্বাক্ষরিত দুটি অভিযোগ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে (এনএসসি) জমা পড়েছে। সেখানে অর্থ লোপাটের নানা অভিযোগ আনা হয়েছে, এস এম নেওয়াজ সোহাগকে বিগত সরকারের দোসর হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টাও করা হয়েছে। ৪ কোটি ২৪ লাখ এবং ২০ কোটি টাকার লোপাটের অভিযোগ এনে অ্যাডহক কমিটি বাতিল করার দাবি জানানো হয়।
টার্ফে জাতীয় হকি দল। এ দৃশ্যটা অবশ্য কমই দেখা যায়। বছরজুড়েই নানা নেতিবাচক খবরের শিরোনামে থাকে খেলাটি। ছবি: সংগৃহীত
দুটি চিঠির ভাষা এবং অভিযোগের ধরন একই। ২০১৬ সাল থেকে এস এম নেওয়াজ সোহাগ কাবাডি থেকে ফায়দা লুটছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। দুটি চিঠি এবং বিভিন্ন কর্মকর্তার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনার গভীরে গিয়ে দেখা গেছে, উত্থাপিত অভিযোগ এবং বাস্তবতায় কোনো মিল নেই। অ্যাডহক কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পাওয়া এস এম নেওয়াজ সোহাগ ২০১৬ সাল থেকে কাবাডি ফেডারেশনে যুক্ত বলে দাবি করা হচ্ছে; কিন্তু ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তার কাবাডিতে সম্পৃক্ততা ২০১৭ সালের শেষ দিকে। ২০১৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন কাবাডি ফেডারেশনের সভাপতি ও পুলিশের আইজি এ কে এম শহীদুল হক স্বাক্ষরিত পত্রে অ্যাডটাচ নামক প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশনের পার্টনার নিয়োগ দেয়া হয়। অ্যাডটাচের মালিক বর্তমান অ্যাডহক কমিটির সাধারণ সম্পাদক এস এম নেওয়াজ সোহাগ।
পার্টনার নিয়োগ দেয়া পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, ৫ বছরের চুক্তিতে অফিসিয়াল পার্টনার হিসেবে অ্যাডটাচ ৫৫-৬০ ইভেন্ট কভার করবে। ঘরোয়া এবং আন্তর্জাতিক ইভেন্টগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা চুক্তি, টেলিভিশন ও মিডিয়া স্বত্ব, ব্র্যান্ডিং খাত থেকে অ্যাডটাচকে মুনাফা ভাগ করে নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়। চুক্তির কোথাও ৫৩ লাখ টাকা কোনো ধারা উল্লেখ করা নেই। অথচ দাবি করা হচ্ছে, প্রতি বছর অ্যাডটাচ থেকে কাবাডি ফেডারেশনকে ৫৩ লাখ টাকা করে দেয়ার কথা ছিল। চুক্তি হয়েছে ৫ বছরের; কিন্তু হিসাব করা হচ্ছে ৮ বছরের। দাবি করা হচ্ছে, ৮ বছরে ৪ কোটি ২৪ লাখ টাকা দেয়নি এস এম নেওয়াজ সোহাগের প্রতিষ্ঠান অ্যাডটাচ।
কাবাডি ফেডারেশনে চলমান নানা ঘটনার আলোকে এমন ফিরিস্তি টানার কারণ হলো, আপনি যখন কারোর বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং অনিয়মের অভিযোগ তুলবেন; তার পক্ষে সুস্পষ্ট প্রমাণাদি থাকা চাই। নইলে সে অভিযোগটা প্রহসন হতে বাধ্য। মজার বিষয় হচ্ছে, কাবাডি ফেডারেশন নিয়ে এমন কাদা ছোড়াছুড়ির পেছনে কিন্তু হালুয়া রুটির গন্ধ স্পষ্ট। বিগত দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করা কমিটি খেলাটির উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে না পারলেও, আর্থিক সচ্ছলতা এনেছে। একাধিক স্থায়ী আমানত এবং ব্যাংকে রক্ষিত অর্থ মিলিয়ে কাবাডি ফেডারেশনের কোষাগারে জমা আছে ৮ কোটি টাকার বেশি। ক্রিকেট ফুটবলের বাইরে এ পরিমাণ অর্থ দারুণ এক দৃষ্টান্ত বটে।
দ্রুততম মানবী শিরিন আক্তারের সঙ্গে দ্রুততম মানব ইমরানুর রহমান। বছরে মাত্র দুটি ঘরোয়া আসরে ট্র্যাকে নামার সুযোগ হয় তাদের। ছবি: সংগৃহীত
অর্থ-সংক্রান্ত মধুর লালসায় কাবাডির মসনদে বসতে দৌড়ঝাঁপ করেছেন অন্তত চারজন; কিন্তু আলোচনার বাইরে থাকা এস এম নেওয়াজ সোহাগকে অ্যাডহক কমিটির সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে, যা দেখে রীতিমতো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা মসনদের স্বপ্ন দেখা ব্যক্তিদের। নানা অভিযোগ এবং কাদা ছোড়াছুড়ির মাধ্যমে স্বপ্ন ভঙের হতাশার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। সে ব্যক্তিদের কেউ কেউ ক্রীড়া সংশ্লিষ্টদের বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে নানা বিভ্রান্তিকর তথ্যও ছড়াচ্ছেন।
কাবাডি এবং হকি ফেডারেশনের মতো কাদা ছোড়াছুড়ি না থাকলেও, অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের কমিটি নিয়েও বিভিন্ন ব্যক্তির হতাশা এবং অপপ্রচার স্পষ্ট হচ্ছে। অ্যাডহক কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পাওয়া শাহ আলমকে নিয়ে নানা প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। মজার বিষয় হচ্ছে, কাবাডি, হকি এবং অ্যাথলেটিকসের কমিটি নিয়ে ঘোলা জলে মাছ শিকারের চেষ্টা করা হলেও তিনটি খেলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ ব্যক্তি কিন্তু খুশি।
দেশের হকিতে দলাদলি পুরোনো ঘটনা। বছরজুড়েই নানা নেতিবাচক খবরের শিরোনাম হচ্ছে খেলাটি। সে অবস্থা থেকে হকিকে বের করে আনার জন্য এমন একজনকে খোঁজা হচ্ছিল, যাকে নিয়ে বিতর্ক নেই এবং খেলাটিতে ইতিবাচক অবস্থা তৈরি করতে পারবেন। সে প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে লে. কর্নেল (অব.) রিয়াজুল হাসানকে অ্যাডহক কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। উদ্দেশ্যটা সফল হয় কি না- সময়ই বলতে পারবে। তার আগে তো নবগঠিত এ কমিটিকে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।
এদিকে বলা হচ্ছে, এস এম নেওয়াজ সোহাগ কাবাডির লোক নন। ২০১৭ সালের আগে কাবাডির সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা ছিল না- এটা সত্যি। তার অর্থ এই নয় যে, এস এম নেওয়াজ সোহাগকে দিয়ে হবে না। ১৯৯০ সালের এশিয়ান গেমসের ডিসিপ্লিন হিসেবে যুক্ত হওয়ার পর থেকে কাবাডিতে নিয়মিত পদক পেয়েছে বাংলাদেশ। পুরুষ কাবাডিতে সে ধারায় ছেদ পড়েছে ২০১০ সালে, ২০১৪ সালের পর থেকে নারী কাবাডিতে এশিয়াডে পদকশূন্য বাংলাদেশ। গেমসে কাবাডি যুক্ত হওয়ার পর থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত খেলাটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন প্রথাগত কাবাডি সংগঠকরাই। তাদের সময়েই সাফল্যর চেনা পথ হারিয়ে ব্যর্থতার অন্ধকার গলিতে ঢুকে পড়েছে খেলাটি।
মাঝে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং যুগ্ম সম্পাদকের কারণে ‘পুলিশ কমিটি’ নাম পেয়েছিল কাবাডি ফেডারেশন। পুলিশ কমিটি ব্যর্থতার বৃত্ত ভাঙতে না পারলেও আর্থিক ভিত্তি মজবুত করেছে। এ অবস্থায় সার্চ বিকল্প খুঁজছিল। তাতেই অপ্রত্যাশিতভাবে দৃশ্যপটে আসেন এস এম নেওয়াজ সোহাগ; কিন্তু সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরুর আগেই কয়েকজন মিলে যেভাবে পেছন থেকে টেনে ধরার চেষ্টা করছেন- তা অস্বাভাবিক বটে!
সার্চ কমিটি, এনএসসি এবং মন্ত্রণালয় কয়েক দফা যাচাই-বাছাই করে যে প্রক্রিয়ায় অ্যাডহক কমিটি গঠন করেছে, তাতে মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তির অমন অপপ্রচারে সবকিছু বদলে যাবে- এমনটা ভাবা বোকার স্বর্গে বসবাসের শামিল। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানাচ্ছে, অ্যাডহক কমিটি গঠনের মাধ্যমে যাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে; তাদের ওপর পূর্ণ আস্থা আছে। ক্রীড়াঙ্গনের নীতিনির্ধারকরা নতুনত্বে বিশ্বাসী। বৈরী পরিস্থিতির মধ্যে দায়িত্বশীলরা নতুন কিছু উপহার দিতে পারবে তো!
মাহবুব সরকার: ক্রীড়া লেখক ও সাংবাদিক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে