'মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ শুধু সিনেমা নয়, জাতির দলিল
অবশেষে প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে মুক্তি পেতে চলেছে ৭ বার ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী পরিচালক শ্যাম বেনেগালের পরিচালনায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বায়োপিক ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’। ইতিহাসের বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী নিয়ে শ্যাম বেনেগালের কাজের অভিজ্ঞতা এই প্রথম নয়। এর আগেও নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ও জওহরলাল নেহেরুকে নিয়ে বায়োপিক নির্মাণ করেছিলেন তিনি। এই সিনেমাগুলো সমালোচক ও দর্শকদের মন কেড়ে নিয়েছিল।
তা ছাড়াও মন্থন, অঙ্কুর, নিশান্তের মতো বিখ্যাত সব সিনেমার নির্মাতা শ্যাম বেনেগাল ভারতীয় টেলিভিশনের জন্যও ‘ভারত এক খোঁজ’ কিংবা ভারতীয় রেলকে নিয়ে ‘যাত্রা’র মতো নানা এপিকধর্মী কাজ করেছেন। এখন দেখার বিষয়, তিনি বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক কেমন নির্মাণ করলেন। এ ক্ষেত্রে আমি বলব, সিনেমাটির সম্প্রতি প্রকাশিত ট্রেলারটি আমার খুবই ভালো লেগেছে।
যদিও ৭৫তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথম প্রকাশ্যে এসেছিল ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ বায়োপিকের প্রথম ট্রেলার। এরপর এই ট্রেলার ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুক, ইউটিউবসহ নানা মাধ্যমে। তারপরই বিতর্কের দানা বাঁধে। ১ মিনিট ৩৮ সেকেন্ডের ট্রেলারটি প্রকাশের পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানা মাধ্যমে শুরু হয় সমালোচনার ঝড়। সে সময় অভিযোগ উঠেছিল ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকের তথ্যে ভুল-ভ্রান্তি আছে। বিশেষ করে, বঙ্গবন্ধু চরিত্রে আরিফিন শুভর কণ্ঠ, ভিএফএক্স, ইতিহাসের সঙ্গে ট্রেলারের দৃশ্য না মেলার মতো অনেক অসামঞ্জস্যতা আছে দাবি করে হতাশা প্রকাশ করেছিলেন দেশের বিভিন্ন পেশার মানুষ। তবে পরিচালক শ্যাম বেনেগাল সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফ অনলাইনকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বিষয়টি পরিষ্কার করেছিলেন। এসব প্রতিক্রিয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেছিলেন, ‘শুধু ট্রেলার দেখে পুরো সিনেমা নিয়ে মন্তব্য করা ঠিক নয়। ৯৮ সেকেন্ডের ট্রেলার দেখে তো আপনি পুরো সিনেমা নিয়ে মন্তব্য করতে পারেন না। আপনি শুধু ট্রেলার নিয়েই মন্তব্য করতে পারেন।’
তার এ কথার সঙ্গে আমি একমত। যদিও পরবর্তীতে সেই ট্রেলারটি সরিয়ে নেন নির্মাতারা। আবার কিছু অংশ নতুন করে শুট হয়। সেই প্রেক্ষিতে আবারও মুক্তি দেওয়া হয় ট্রেলার। এবারের ট্রেলার দেখে দর্শকরা বেশ প্রশংসা করছেন। যদিও এখানেও অনেকে বলছেন, আরও ভালো করা যেতো। তারপরও আমার কাছে মনে হয়েছে ট্রেলারটা ভালোই হয়েছে।
সিনেমাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চরিত্রে দেখা যাবে জনপ্রিয় অভিনেতা আরিফিন শুভকে। ট্রেলারে তাকে দেখতে ভালো লেগেছে। পুরোপুরি না হলেও বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি আনার চেষ্টা করেছেন পরিচালক। তা ছাড়া শুভ নিজেও চরিত্রটির জন্য অনেক পরিশ্রম করেছেন, তা ট্রেলারে বেশ ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর ভয়েস, স্টাইল, জ্বালাময়ী বক্তৃতা, শারীরিক ভাষা- এসব হুবুহু করা এক প্রকার অসম্ভব। শুধু উনিশ-বিশ না, অনেক ফারাক থাকবে। তবে ট্রেইলারে আরিফিন শুভকে দেখে মনে হয়েছে, চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলতে তিনি অনেক পরিশ্রম করেছেন।
মূলত শুভ তৎকালীন বঙ্গবন্ধুর কার্যকলাপগুলো তুলে ধরবেন চরিত্রের মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনকে দর্শকের সামনে তুলে ধরাটাই আসল উদ্দেশ্য। আমার কাছে ভয়েস ছাড়া শুভর বাকি সব মন্দ লাগেনি। বিশেষ করে তার এক্সপ্রেশান, এটিটিউড দারুণ। পোষাকেও ভালো মানিয়েছে শুভকে। আমার কাছে মনে হয়েছে শুভ বেস্ট পারফর্ম করেছেন। অন্তত তার চেষ্টা নিয়ে সমালোচনা থাকবে বলে মনে হয় না। বঙ্গবন্ধুর মতো লম্বা-চওড়া বিবেচনা করলে শুভকে পারফেক্ট লেগেছে।
বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি, পরে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন যেন অনেকটা গ্রিক ট্র্যাজেডির মতোই। বাংলা ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশ, বাঙালির আত্মপ্রকাশ, একটি জাতির জন্ম- সবটাই বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু কীভাবে একটি জাতি তথা স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার হলেন, সেটিই এই ছবিতে উঠে আসবে। ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ শুরু থেকেই এই দাবিতে অনড় ছিলেন বঙ্গবন্ধু। রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই স্বাধীন বাংলাদেশের মুখ দেখেছিল পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ। এই ট্রেলারজুড়ে উঠে এসেছে সেই রক্তমাখা ইতিহাস। জাতির জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের যে সংগ্রাম, ত্যাগ, দৃঢ়তা- সেটাই চিত্রায়িত হয়েছে এই সিনেমাতে। শাসকদের চোখে চোখ রেখে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো, এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব… ইনশাআল্লাহ’। দুঃখের বিষয় তাঁর ৫৫ বছরের গৌরবোজ্জ্বল জীবন স্তব্ধ হয়ে যায় নির্মম হত্যাকাণ্ডে। এই ছবিতে বঙ্গবন্ধুর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সবটাই পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন শ্যাম বেনেগাল।
বাংলাদেশের ৬০ ভাগ ও ভারতের ৪০ ভাগ ব্যয়ে ২০১৯ সালে সিনেমাটির কাজ শুরু হয়। ২০২১ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে মুম্বাইয়ের দাদা সাহেব ফালকে স্টুডিওতে চলচ্চিত্রটির প্রথম ধাপের শুটিং শুরু হয়ে ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশে শেষ হয়। গত বছরের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীতে চলচ্চিত্রটির প্রথম পোস্টার, ৩ মে দ্বিতীয় পোস্টার ও ১৯ মে ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উৎসবে সিনেমাটির ট্রেইলার রিলিজ করা হয়। এতে সহযোগী পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন দয়াল।
সিনেমাতে ‘অচিন মাঝি’ শিরোনামে একটি গান লিখেছেন জাহিদ আকবর, সংগীত পরিচালনা করেছেন শান্তনু মৈত্র। এই সিনেমাতে শেখ হাসিনা চরিত্রে অভিনয় করেছেন নুসরাত ফারিয়া এবং বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছার চরিত্রে রয়েছেন নুসরাত ইমরোজ তিশা। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে দেখা যাবে খায়রুল আলম সবুজ (লুৎফর রহমান), দিলারা জামান (সাহেরা খাতুন), সায়েম সামাদ (সৈয়দ নজরুল ইসলাম), শহীদুল আলম সাচ্চু (এ কে ফজলুল হক), প্রার্থনা দীঘি (ছোট রেনু), রাইসুল ইসলাম আসাদ (আবদুল হামিদ খান ভাসানী), গাজী রাকায়েত (আবদুল হামিদ), তৌকীর আহমেদ (হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী), সিয়াম আহমেদ (শওকত মিয়া), মিশা সওদাগর (জেনারেল আইয়ুব খান) ও জায়েদ খান (টিক্কা খান)। আগামী ১৩ অক্টোবর একসঙ্গে ভারত ও বাংলাদেশে মুক্তি পাবে সিনেমাটি। আশা করা হচ্ছে, বাংলাদেশে প্রায় ১৫৩টি সিনেমা হলে মুক্তি পাবে ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’।
বঙ্গবন্ধুর জীবন ও একটি জাতির জন্ম নিয়ে নির্মিত ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ শুধু সিনেমা নয়, বাঙালি জাতির জন্য একটি দলিল। বঙ্গবন্ধু কীভাবে একটি জাতির রূপকার হলেন, সেটিই এই ছবিতে চিত্রায়িত হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক বিতর্কমুক্ত রাখতে পারাটা যে বিরাট এক চ্যালেঞ্জ, কাজ শুরু করার আগে সে কথা স্বীকার করেছিলেন পরিচালক। তাই আমি বলব, ৮৮ বছর বয়সী শ্যাম বেনেগাল গত ৪ বছর ধরে ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ তৈরি করেছেন। তাঁর বহু নিদ্রাহীন রাতের ফসল এই সিনেমা। এই সিনেমার মাধ্যমে দীর্ঘ ১৩ বছর পর পরিচালনায় ফিরলেন তিনি। এবার শুধু সিনেমাটা কেমন বানালেন শ্যাম বেনেগাল সেটাই দেখার বিষয়। আশা করি ভালো কিছু হবে। সিনেমাটি ভালো হোক আপাতত সেটাই প্রত্যাশা রাখছি!
লেখক: কবি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে