Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

মুনতাহার মৃত্যু ও অমানবিকতা

Chiroranjan  Sarker

চিররঞ্জন সরকার

বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪

পাঁচ বছরের ছোট্ট মুনতাহা। ঠোঁটে লাল রঙের লিপস্টিক। মুখে একরাশ হাসি। ঘাড় পর্যন্ত চিকচিকে কালো চুল। মায়াবী চোখজোড়া অপলক তাকিয়ে আছে। পরনে বেগুনি রঙের জামা। এমন ফুটফুটে সুন্দর শিশু মুনতাহা আক্তারের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। নিখোঁজের সাত দিন পর বাড়ির পাশ থেকে শিশুটির লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। শিশুটির লাশ ডোবায় কাদার মধ্যে পুঁতে রাখা ছিল। মুনতাহার বাড়ি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার বীরদল ভাড়ারিফৌদ গ্রামে।

এক ওয়াজ মাহফিল থেকে ৩ নভেম্বর সকালে বাবার সঙ্গে বাড়ি ফিরে সে বাইরে খেলতে যায়। পরে আর খোঁজ মেলেনি। এরপর শিশুটির সন্ধান চেয়ে ফেসবুকে অনেকে পোস্ট দেন। ১০ নভেম্বর ভোরে মুনতাহার লাশ পাওয়া যায়। ঘটনাটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। ফুলের মতো সুন্দর এ শিশুটিকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। নিতান্তই তুচ্ছ কারণে এমন নৃশংস ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে। পুলিশের ভাষ্য মতে, প্রায় চার মাস আগে মুনতাহার গৃহশিক্ষক হিসেবে প্রতিবেশী শামীমা পড়ানো শুরু করেন। তবে তিনি মুনতাহার পরিবারের সদস্যদের না জানিয়েই পড়ানোতে বিরতি দিতেন। পরে মুনতাহার পরিবার তাকে পড়াতে মানা করে দেয়। এতে ক্ষুব্ধ হন শামীমা। এর মধ্যে মুনতাহাদের পরিবারে কিছু কাপড় হারানোর ঘটনা ঘটে। সেসব কাপড় শামীমাদের বাড়িতে পাওয়া যায়। চুরির অপবাদ দেয়া হয় তাকে। এসব কারণেই নাকি শিশু মুনতাহাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।

বর্বরোচিত, নৃশংস, হিংস্র কোনো বিষয়কে বিশেষিত করতে চট করে ‘পাশবিক’ শব্দটা ব্যবহার করে ফেলি আমরা অনেকেই। এই ব্যবহার কতটা সঙ্গত, তা নিয়ে প্রশ্ন আগেও ছিল। কিছুটা মৃদু হয়তো। এ বার প্রশ্নটা ভীষণ জোরালো হয়ে উঠল। পশুর মতো আচরণকে যদি পাশবিক বলা হয়, তা হলে পাশবিকতা বোধ হয় মানুষের মতো আচরণ বা মানবিকতার চেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই ভালো। পশুর হিংস্রতার কারণ খুঁজে পাই। জীবন সংগ্রামের প্রয়োজনে হিংস্রতা, নৃশংসতার দাস পশু। কিন্তু সভ্য মানুষ কী করে পাঁচতলা বাড়ির ওপর থেকে অকারণে একটি নিরীহ পশুকে নিচে ফেলে দিতে পারে এবং সেই পতনের দৃশ্য রেকর্ড করে রাখতে পারে? কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না!

এমন নিষ্ঠুর ঘটনার নিন্দা করার ভাষা জানা নেই। সবচেয়ে হতাশার কথা হলো এমন একটা পৈশাচিক ঘটনা ঘটানোর পরও অভিযুক্তরা ছিলেন ভাবলেশহীন! তাদের মধ্যে কোনোরকম অনুশোচনা, ক্রন্দন, হাহাকার লক্ষ্য করা যায়নি। মুনতাহা হত্যাকাণ্ড যেন আমাদের সামাজিক অবক্ষয় ও বিকারেরই এক বীভৎস রূপ। আমাদের চারদিকে আজ হিংসার প্রকোপ বাড়ছে।

দৈনন্দিন, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক জীবন- সর্বত্রই আমরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে হিংসায় ত্রস্ত, আতঙ্কিত, দিশাহীন! হত্যা, খুন, পিটিয়ে মারা- আমাদের সমাজে এখন নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এসবের বিরুদ্ধে কার্যকর ও শক্ত কোনো প্রতিবাদ হচ্ছে না। আমাদের দেশে সুস্থ মনের মানুষগুলোও ভেতরে ভেতরে কেমন যেন সিঁটিয়ে যাচ্ছে। বোবা হয়ে যাচ্ছে। সামাজিক ভারসাম্যে এক অদ্ভুত টালমাটাল তৈরি হয়েছে বলে বোধ হয়। ভালোবাসা, সহানুভূতি, সমানুভূতি, মানবিকতা, আস্থা, নির্ভরশীলতার মতো নিত্যবন্ধুদের দূরে ঠেলে দিচ্ছি।

কারও সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে গেলে, নিজের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিতে গেলে আজকাল মনে হয় সামনের লোকটা কি আমার কথা মন দিয়ে শুনছে? শুনে ভেতরে ভেতরে হাসছে? হয়তো ভাবছে, এর জীবনে কোনো লক্ষ্য নেই। এই মাথা খারাপ লোকটা আমাকে কি পাগল ভাবছে?

বুঝতে পারি, এই বিশ্বাসহীনতা আমার একার নয়। কেউ কারও সামনে অকপট হতেই এখন ভয় পায়। নিজের ইমেজ বা ভাবমূর্তির বিষয়ে সমাজ আমাদের অতিরিক্ত সতর্ক করে তুলছে। মনন, ভাবাবেগ, কষ্ট পাওয়া, আনন্দ হলে কলকলিয়ে ওঠার সাবলীলতা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি আমরা। নিজেদের ‘ফোকাসড’, ‘পজিটিভ’, ‘কনস্ট্রাকটিভ’ প্রমাণ করার দায় থেকে, নিজেদের দারুণ শক্তিমান, প্রগতিশীল প্রমাণ করার নিরন্তর দায় থেকে।

ফেসবুকের মতো খোলা আঙিনায়ও কিন্তু খুব কম পোস্টেই কেউ নিজের ভেঙে পড়ার কথা বলে। বেশিরভাগ পোস্টই ‘আমি কত ভালো আছি’ সেই প্রচার করছে। ওই একটাই ভয়, কেউ যেন আমাকে দুর্বল না ভাবে, কেউ যেন আমাকে অসহায় ভেবে সুযোগ নেয়ার খেলায় মেতে না ওঠে।

কী দমবন্ধকর এই পরিস্থিতি। চারপাশে এত মানুষ, কেউ অকপট নয়। কেউ আনন্দ হলে হা-হা করে হাসে না, কারও দুঃখ হলে নিভৃতেও সে কথা বলতে ভয় পায়, এমনকি কোনও কারণে ভয় পেলেও সে কথা ভাগ করে নিতে সাহস করে না।

হয়তো আশপাশের অসহিষ্ণুতা, সেই অসহিষ্ণুতার আঁচ থেকে নিজেদের বাঁচানো, অসম্ভব অসুস্থ এক প্রতিযোগিতা, যা শেষ পর্যন্ত কোথাও পৌঁছে দেয় না, নিজেকে সব স্তরে, সর্বক্ষেত্রে উদার-আধুনিক প্রমাণ করার লক্ষ্যেই আমরা স্থির। তাই অন্য কারও দিকে হাত বাড়াই না, কারও হাত নিজের দিকে টেনে নিতে চাই না, কারও কানের কাছে মুখ খুলি না, কারও মুখের কাছে কান নিয়ে যাই না। ভয় হয়, আমরা বোধহয় জীবন কাটানোর উছিলায় বাঁচতেই ভুলে যাচ্ছি। ভালোবাসতে ভুলে যাচ্ছি, বিশ্বাসে আস্থা হারাচ্ছি, ভাগাভাগির ভাবের ঘরে দরজা তুলে বন্ধ করে নিচ্ছি নিজেদের।

ক্রিকেট ম্যাচ শেষ হয়ে গেলে যেমন একে একে ভিড় কমে যায়, সার্চলাইটগুলো একে একে নিভে গিয়ে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে থাকে, তেমনই একা মানুষ। চারপাশে আছে সবাই, আছে সবকিছু, তবু একা। জয়-পরাজয়ে, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতে, লাভে-ক্ষতিতে, ইচ্ছা-অনিচ্ছায়, যুদ্ধে-শান্তিতে, দুঃখে-আনন্দে, ভালোবাসা-বিরহে, জীবনে-মরণে। জন্মের পরে মায়ের কোলের নিরাপদ আশ্রয়ের ফাঁকে একলা শিশুর কচি দু’হাত খোঁজে আরও একটু শক্ত অবলম্বন, আঁকড়ে ধরে শাড়ির ভাঁজ। সেই শুরু। তারপর সারা জীবন চলে সেই অবলম্বনের সন্ধান; কিন্তু সেই অবলম্বন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।

পাঁচ বছরের একজন মুনতাহাকে বাঁচানোর দায়িত্বটি কিন্তু সমাজের সব মানুষের। কিন্তু আমরা তাকে বাঁচাতে পারলাম না। যাদের কোল ছিল শিশুটির প্রিয় ঠিকানা, অথচ তারাই কি না শিশুটিকে হত্যা করল! খুব বিভ্রান্ত হতে হচ্ছে মাঝে-মধ্যেই। মানুষের অগ্রগতি আর মানব সভ্যতার অগ্রগতি কি মোটের ওপর একই? প্রশ্ন জাগছে; কিন্তু প্রশ্নটার দ্বিধান্বিত উত্তর আসছে।

সভ্যতা তো মানব জীবনের আধার। মানবতা বলতে যা বুঝি, তারও আধার। এই সভ্যতা তথা এই সমাজই জন্ম দেয় আমাদের, এই সভ্যতা তথা এই সমাজই গড়েপিটে নেয়, অন্তিম পরিণতিতেও পৌঁছে দেয়। সভ্যতার সঙ্গেই যাত্রা আমাদের, সভ্যতার সঙ্গেই সফর গোটা মানব সমাজের। অতএব, সভ্যতার অগ্রগতির সামগ্রিক অর্থ মানুষেরই অগ্রগতি। একটা উত্তর এই রকম।

অন্য উত্তরটা বলছে, সভ্যতার অগ্রগতির অর্থ হলো আমাদের পারিপার্শ্বিকতার অগ্রগতি বা নিরন্তর বদল; কিন্তু সমগ্র মানব সমাজের অগ্রগতি তাতে হয় না। কোনও ক্ষেত্রে অগ্রগতি কিছু মানুষের হয়, কোনো ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট শ্রেণির অগ্রগতি হয়। মানবতাকে বার বার লাঞ্ছিত হতে দেখেছি বলেই বোধ হয় এই রকম দ্বিধাবিভক্ত একটা উত্তর পাচ্ছি, একটা বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ছি।

মুনতাহার হত্যাকাণ্ডটি কিন্তু বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। প্রায়ই ইতিউতি এমন অমানবিকতার প্রমাণ মিলছে। প্রায়ই শিশুদের ওপর হামলা হচ্ছে। তাদের নির্যাতন করা হচ্ছে। খুন করা হচ্ছে। দেশজুড়েই এমন ঘটনা ঘটছে। ন্যূনতম মানবতা বোধটুকু লোপ না পেলে কি এমন হয়?
মানবতাকে যদি সভ্যতার শিক্ষা বলে ধরে নিই, তা হলে সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে মানবতারও উন্নতি হওয়ার কথা। মানুষের ভিতরে সহমর্মিতা, সহানুভূতি, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, ভালোবাসা ইত্যাদির মানোন্নয়ন ঘটার কথা। কালের নিয়মে আরও উত্কৃষ্ট, উন্নততর মানবতার দিকে ধাবমান হওয়ার কথা। সংবেদনশীলতায় আরও প্রাবল্য আসার কথা। তেমনটি ঘটছে কি?

অনেকেই হয়তো বলবেন, মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে। তা হলে কিন্তু ধরে নিতে হবে মানবতারও অবক্ষয় হচ্ছে। অর্থাত্ এই সভ্যতা তার সর্বোচ্চ শিখর স্পর্শ করে ফেলেছে। আর তার অগ্রগতির সম্ভাবনা নেই। এ বার শুধু ক্ষয়, ধীরে ধীরে ক্ষয়, উন্নতির চেয়ে দ্রুত বেগে ক্ষয়। তেমনটা মেনে নিতে কি আমরা প্রস্তুত? নিশ্চয়ই প্রস্তুত নই। আমরা হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে বিশ্বাস করি, মানব সভ্যতা অসীম সম্ভাবনাময়। এখনও অনেক পথ এগনো বাকি তার। সুতরাং, অবক্ষয়ের তত্ত্ব খাড়া করে হিসেবটা মেলানো যাবে না, সমস্যার মূলে পৌঁছতে হবে। উত্কৃষ্ট মানবতা কেন এখনও চারিয়ে দেয়া যায়নি সমাজের প্রতিটা অংশে, ন্যূনতম মানবতার বোধটাও কেন এখনো জাগিয়ে তোলা যায়নি অনেকের মধ্যেই, তা বুঝে নেয়ার চেষ্টা করতে হবে, সেই দায়িত্বটা কিন্তু প্রতিটি সংবেদনশীল মানুষকে সমানভাবে নিতে হবে। সভ্যতাকে ত্রুটিমুক্ত রাখার দায়িত্ব তাদেরই।

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ