হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা: ৫ আগস্টের আগেই অন্তত একটি মামলার রায়ের চেষ্টা
শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিসভার বেশ কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনায় হওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন আগামী মার্চের মধ্যেই দেয়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিম, তদন্ত সংস্থা ও পুলিশের ১০টি বিশেষ টিম এর জন্য কাজ করছে, যাতে দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন দিয়ে বিচার শুরু করা যায়। একই সঙ্গে আগামী ৫ আগস্টের মধ্যে যে কোনো অন্তত একটি মামলার রায় দেয়া সম্ভব হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনায় সারা দেশে প্রায় ২ হাজার ১০০ মামলা হয়েছে। ২০২৪ সালের ৬ আগস্ট থেকে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত করা এসব মামলায় আসামিদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিসভার বেশ কয়েকজন সদস্য, এমপি থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী, সামরিক-বেসামরিক আমলা ও পুলিশ সদস্য। এর মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন বরাবর এখন পর্যন্ত প্রায় ৩ শতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। যার মধ্যে আর ১৭টি মামলায় ১১০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
মামলাগুলোর আসামি প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার। এসব আসামির সিংগভাগের বিরুদ্ধেই আনা হয়েছে হত্যার অভিযোগ। আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে করা মামলার আসামিদের একটি ‘বিশেষ’ তালিকা তৈরি হয়েছে। পুলিশ ও ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিমের পক্ষ থেকে এ তালিকা করা হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ মামলার পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তার এবং গ্রেপ্তার আসামিদের জামিন ঠেকাতে কেন্দ্রীয়ভাবে এই তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এই তালিকায় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলা, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর ও মোবাইল ফোনের নম্বর থাকছে। তাদের জামিন প্রতিরোধে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে বিরোধিতা করার পরিকল্পনাও রয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মো. তাজুল ইসলাম ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের একাধিক তদন্ত প্রতিবেদন এরই মধ্যে প্রায় প্রস্তুত। এর মধ্যে শেখ হাসিনাসহ সাবেক বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, এমপি, আমলা ও পুলিশ কর্মকর্তা বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া হত্যা মামলার চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন আগামী মার্চ মাসের মধ্যেই দিবে ট্রাব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। এরপরই শুরু হবে আনুষ্ঠানিক বিচার কার্যক্রম। আমরা প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে এসব মামলার দ্রুত শুনানির চেষ্টা করব। যাতে করে আগামী ৫ আগস্টের আগেই শেখ হাসিনাসহ অন্য বেশ কয়েকজন আসামির বিরুদ্ধে হওয়া অন্তত একটি হত্যা মামলার বিচার শেষ করা যায়। সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি। আশা করছি, আমাদের পক্ষ থেকে এটা আমরা পারব। তবে এতে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা প্রয়োজন হবে। আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার পাশাপাশি দ্রুততম সময়েই বিচার সম্পন্ন হবে।’
শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘ট্রাইব্যুনাল থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠানো হয়েছে ভারতের কাছে। কিন্তু ভারত এখনো ওই চিঠির কোনো জবাব দেয়নি। এখন শেখ হাসিনা যেহেতু আমাদের হেফাজতে নেই, আছেন ভারতে। তাই ভারত এখন কি করবে সেটাই দেখার বিষয়। তবে এখন এক অবস্থা আর রায় হওয়ার পরে হবে অন্য অবস্থা। তখন বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে।’ তিনি বলেন ‘কোনো শাসকগোষ্ঠী এরকম ঘৃণ্য কোনো অপরাধ করার দুঃসাহস যাতে না দেখায় সেজন্য নিরপেক্ষতার সঙ্গে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের মাধ্যমে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। আমরা আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুচারুভাবে ও দক্ষতার সঙ্গে পালন করব।’ তাজুল ইসলাম আরও বলেন, যেসব অপরাধীর বিচার ট্রাইব্যুনালে চলছে তাদের অনেক টাকা আছে।
বিগত সরকারের সময় নানা উপায়ে তারা বিপুল অর্থ হাতিয়েছেন। দেশ-বিদেশে প্রপাগান্ডার মাধ্যমে তারা এই বিচার বিতর্কিত করার জন্য নানামুখী প্রচেষ্টা চালাচ্ছে; কিন্তু তারা সফল হবে না।’ ব্রিটিশ আইনজীবী, লন্ডনভিত্তিক ল’ ফার্ম ‘গুয়ের্নিকা ৩৭’ গ্রুপের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও ‘গুয়ের্নিকা-৩৭ চের্ম্বাস’-এর যুগ্ম প্রধান এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের বিশেষ পরামর্শক টবি ক্যাডম্যান বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলাগুলো যেহেতু অনেক জটিল এবং এর কার্যবিধি সময়সাপেক্ষ, তাই এ বিধিগুলো সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে তাড়াহুড়া করার কোনো সুযোগ নেই। এরপরেও প্রসিকিউশন টিম যেভাবে সবকিছু গুছিয়ে এনেছেন এবং নিশ্চিত করেছেন যেন আইন আমাদের সম্পূর্ণভাবে সহযোগিতা করে, সেটা দেখার পর আমি আত্মবিশ্বাসী যে কাজগুলো সঠিকভাবে করা সম্ভব হবে।
ট্রাইব্যুনালে যতদিন কাজ করব ততোদিন আইনের বিদ্যমান কাঠামোতেই করব। যাতে নিরপেক্ষ, সহজতর ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে স্বীকৃত হবার যোগ্য একটি বিচার হয়।’ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন মার্চের মধ্যে ও রায় আগস্টের মধ্যে হতে পারার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সবকিছুই প্রসিকিউশন টিম ও তদন্ত সংস্থা দ্রুততার সঙ্গে করছে। তবে রায় তো দেবেন আদালত। সেটা আমি দিন-তারিখ কীভাবে নির্ধারণ করব?
অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান এ ব্যাপারে ভিউজ বাংলাদেশেকে বলেন, ‘শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে হওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন মার্চে দেয়া যেতেই পারে। কারণ তদন্ত সংস্থা এ ব্যfপারে অনেকটাই কাজ শেষ করে ফেলেছে। তবে আগামী ৫ আগস্টের আগে রায় ঘোষণা হওয়াটা আদালতের ওপর নির্ভর করে। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব, যাতে ওই তারিখের আগেই অন্তত একটি মামলার রায় ঘোষণা করা যায়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে