Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাত ধরে মঙ্গলে যাবেন ইলন মাস্ক

Kamrul  Ahsan

কামরুল আহসান

সোমবার, ১১ নভেম্বর ২০২৪

দ্বিতীয়বারের মতো ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে বিশ্বমিডিয়ায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন ইলন মাস্ক। অনেক মিডিয়া এমনো খবর প্রকাশ করছে যে, জিতল কি আসলে ট্রাম্প না কি ইলন মাস্ক? আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে যারা খবর রাখেন তারা জানেন ট্রাম্পের নামে এবারের মার্কিন নির্বাচনে বড় বাজি ধরেছিলেন বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক। ট্রাম্পের নির্বাচনি প্রচারণায় তিনি ব্যয় করেছিলেন ১১ কোটি ৯০ লাখ ডলার। শুধু অর্থ দিয়েই খ্যান্ত হননি, নিজেও নির্বাচনি প্রচারণায় অংশ নিয়েছিলেন। ট্রাম্প তাকে আখ্যা দিয়েছিলেন রিপাবলিকান দলের সবচেয়ে বড় তারকা। অনেকে তাই বলছেন এবারের মার্কিন নির্বাচনে আসলে ট্রাম্প জিতেননি, জিতেছেন ইলন মাস্কই এবং ট্রাম্পের হাত ধরে হোয়াইট হাউস বস্তুত চালাবেন ইলন মাস্ক।

ট্রাম্প জয়ের পর পরই ইলন মাস্কের একটি ছবি পোস্ট করেছেন তার এক্স-এ। টুইটার কেনার পরও ইলন মাস্ক এই ছবিটি পোস্ট করেছিলেন, একটি বাথরুম সিঙ্ক হাতে টুইটারের হেড অফিসে প্রবেশ করেছিলেন। সেই ছবিটিই এডিট করে পোস্ট করছেন, এ দেখা যাচ্ছে এবার তিনি সেই সিঙ্ক হাতে হোয়াইট হাউজে ঢুকছেন। ক্যাপশন একই- ‘লেট দ্যাট সিঙ্ক ইন!’ অর্থাৎ, ‘বুঝো নাই ব্যাপারটা!’ কিন্তু কী আসলে তিনি বোঝাতে চান? অনেকের ধারা, ট্রাম্পের হাত ধরে ইলন মাস্ক তার স্পেসএক্স-এর ব্যবসা বাড়াবেন। এবার তিনি মঙ্গলগ্রহে নভযান পাঠিয়েই ছাড়বেন। অনেকে আবার বলছেন, ট্রাম্পের হাত ধরে ইলন মাস্ক বস্তুত রাজনীতিতে প্রবেশ করছেন। আগামী মার্কিন প্রেসিডেন্ট যে ইলন মাস্কই হতে যাচ্ছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে যদি ইলন মাস্কের সম্পর্ক দহরম-মহরমের হয় তাহলে চীনের সঙ্গে ইলন মাস্কের সম্পর্ক কীরকম হবে এখন? অর্থনৈতিক দুই পরাশক্তি হিসেবে তো যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্ক। দুই রথারূঢ় যোদ্ধার মতো। অন্যদিকে ইলন মাস্কের ইলেকট্টনিক গাড়ি ব্যবসা টেসলা কোম্পানির ব্যবসা অনেকটাই চীনের ওপর নির্ভরশীল। যে তাইওয়ান নিয়ে চীন-মার্কিন দ্বৈরথ সবচেয়ে বেশি, এ বছরের শুরুর দিকে চীন সফরে গিয়ে সেই তাইওয়ান নিয়ে ইলন মাস্ক মন্তব্য করেছিলেন, ‘তাইওয়ান তো চীনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ।’ চীন-যুক্তরাষ্ট্রের যে ভূ-রাজনৈতিক-কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব ইলন মাস্ক তার কতখানি সমাধান করতে পারবেন? বা দুপক্ষের চাপে পড়ে নিজেকেই-বা কতখানি সামাল দিতে পারবেন?

এদিকে এ কথা বেশ কয়েক বছর ধরেই প্রচলিত, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে নিয়মিতই যোগাযোগ হয় ইলন মাস্কের, নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ পুতিনের সাক্ষাৎকার প্রকাশের সুযোগ দেন, অন্য দিকে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় ইউক্রেনকে নিজের স্টারলিংক স্যাটেলাইটের মাধ্যমে যোগাযোগের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন ইলন মাস্ক। আরও চমকপ্রদ ব্যাপার, ট্রাম্প নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর জেলেনস্কি তাকে ফোন করেছিলেন অভিনন্দন জানানোর জন্য, তখন ট্রাম্পের পাশে ছিলেন ইলন মাস্ক, জেলেনস্কির সঙ্গে কথা বলার জন্য ট্রাম্প সেই ফোন ধরিয়ে দেন ইলন মাস্ককে। এসব ঘটনার বিশ্লেষণ করে অনেকেই এখন অনুমান করছেন, দুনিয়ার রাজনীতির ভবিষ্যৎ এখন অনেকটা ইলন মাস্কের হাতেই। তার সহযোগিতাতেই হয়তো বন্ধ হবে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ।

এখন যুদ্ধ বন্ধ করে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা কি ইলন মাস্কের লক্ষ্য, না কি নিজের ব্যবসার সম্প্রসারণই তার আসল লক্ষ্য তা নিয়েও কথাবার্তা হচ্ছে। বৈদ্যুতিক গাড়ির চার্জিং প্ল্যাটফর্ম চার্জওয়ের সিইও ম্যাট টেস্ক মনে করেন, মাস্কের মূল আগ্রহ মূলত নিজের ব্যবসার সম্প্রসারণ। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গর্ডনও মনে করেন, ইলন মাস্ক কোনো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আটকে থাকতে চান না। তিনি মনে করেন যে সরকারি হস্তক্ষেপ প্রযুক্তির বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করেছে। অদম্য উদ্যোক্তা হিসেবে এমন কোনো নিয়মের মধ্যে আটকা পড়তে চান না, যাতে প্রযুক্তির অগ্রগতি পাঁচ, ১০, ২০ বছর পিছিয়ে যায়। তার মানে কি রাজনীতিবিদদেরদ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে রাজনীতিবিদদেরই তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে চান? পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধনী থেকে কি পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হতে চান?

কিন্তু কথা হচ্ছে এত ক্ষমতা দিয়ে ইলন মাস্ক কী করবেন? অধ্যাপক গর্ডন মনে করেন, তিনি মঙ্গল গ্রহে যেতে চান। মঙ্গল গ্রহে পৌঁছানো নিয়ে স্পেসএক্সের উচ্চাকাঙ্ক্ষী মিশন এখন আর শুধু গ্রহে পৌঁছানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। ইলন মাস্ক এবং তার সহকর্মীরা ভবিষ্যতে মানুষ কীভাবে সেখানে বসবাস করতে পারবে, সে বিষয়েও গভীর গবেষণা করছেন। মঙ্গলগ্রহে বসবাসযোগ্য আবাস গড়া, জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সাপোর্ট সিস্টেম তৈরি করা এবং এমনকি মানুষ সেখানে জন্ম দিতে পারবে কি না, তা নিয়েও চলছে বিশদ আলোচনা।এই ধনকুবের অনেক আগেই ঘোষণা দিয়েছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে মঙ্গলগ্রহে ১০ লাখ মানুষের বসতি গড়ে তুলবেন। আগামী ২ বছরের মধ্যেই মঙ্গলগ্রহে ৫টি মহাকাশযান পাঠাতে চান।

তার জন্য যত দ্রুত যত সব প্রস্তুতি ও ক্ষমতা অর্জন প্রয়োজন তার সবই তিনি করছেন। এবারের মার্কিন নির্বাচনে আমরা দেখলাম নিজের লক্ষ্যে তিনি অনেকটাই এগিয়ে গেছেন। নিজের লক্ষ্যের দিকে যে তিনি দুর্বারগতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন তার নজির ট্রাম্প জয়ের একদিন পরেই স্থাপন করেছেন ইলন মাস্ক। ট্রাম্প জয়ের পর ইলন মাস্কই যে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছেন তার পরিসংখ্যান হাতে কলমেই পাওয়া গেছে, এক দিনের মাথায় এক্স, টেসলা, স্পেসএক্স ও নিউরালিংকের মালিক ইলন মাস্কের সম্পদ বেড়েছে ২৬ দশমিক ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২ হাজার ৬৫০ কোটি মার্কিন ডলার। অর্থাৎ এক দিনেই বাংলাদেশের মোট রিজার্ভের চেয়েও বেশি অর্থ আয় করেছেন পৃথিবীর শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক।

ব্লুমবার্গের বিলিওনিয়ারস ইনডেক্সের তথ্য মতে, শেয়ারের দাম বাড়ার ফলে ইলন মাস্কের বর্তমান মোট সম্পদমূল্যের পরিমাণ প্রায় ২৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২৯ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। ধনকুবের এই প্রযুক্তিপ্রেমী বাস করেন অনেকটা হাইপার-রিয়েলিটির জগতে। এক সময় ডিডিও- গেমস খেলতে ভালোবাসতেন। জীবন তার কাছে অনেকটা ভিডিও-গেমসের মতো। প্রতি মুহূর্তে নিজের সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়াই তার লক্ষ্য। কল্পবিশ্বকেই তাই তিনি বাস্তবতায় রূপ দিতে চান। আর যা তিনি করতে চান, তার জন্য রাজনীতিই সবচেয়ে বড় বাধা, তাই এবার তিনি রাজনীতিকেই নিয়ন্ত্রণ করতে চান।

স্পেসএক্সের শীর্ষস্থানীয় একজন সাবেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিদ্যমান সব নিয়মকানুনকে মাস্ক তার ব্যবসা ও উদ্ভাবনের পথে বাধা হিসেবে দেখে থাকেন। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর তার প্রশাসনকে মাস্ক ওই সব নিয়মকানুন বা বিধিনিষেধ কাটানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবেন, যাতে যা ইচ্ছা তিনি তা করতে পারেন। গত সেপ্টেম্বরে ইলন মাস্ক পোস্ট দিয়েছিলেন, কামলা জিতলে আমরা কোনাদিন মঙ্গলে পৌঁছুতে পারব না। অন্যদিকে গত অক্টোবরে ডোনাল্ড ট্রাম্প ফক্স নিউজে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আমি তাকে মঙ্গলে রকেট পাঠাতে দেব। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আমি যদি প্রেসিডেন্ট হই, আমার প্রশাসনিক মেয়াদকালেই তিনি মঙ্গলে পৌঁছুতে পারবেন।

দুনিয়ার কোনো সমস্যা নিয়ে ইলন মাস্কের তেমন মাথাব্যথা নাই। বরং কী করে মঙ্গলে পৌঁছানো যাবে এটাই তার একমাত্র লক্ষ্য। এর জন্য যা দরকার সবই তিনি করছেন বেপরোয়াভাবে। ব্যক্তিগতভাবে বিনিয়োগ করছেন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। কারও ব্যক্তিগত উদ্যোগে এমন ব্যয়বহুল স্বপ্ন পৃথিবীর মানুষ আগে দেখেনি। পৃথিবীর অনেক মানুষই ব্যক্তি-উদ্যোগে অনেক মহান বিরাট কীর্তি স্থাপন করেছেন। কিন্তু ইলন মাস্ক একেবারেই ব্যতিক্রম। কল্পবিজ্ঞানকে তিনি বাস্তবে রূপ দিতে চাচ্ছেন। এবং পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ তার স্বপ্নের প্রতি আস্থা রাখছেন, যে, এই পাগল পাগল মানুষটি হয়তো সত্যিই তার স্বপ্নের বাস্তবায়ন করবেন।

ট্রাম্পের হাত ধরে ইলন মাস্ক মঙ্গলে যাবেন, আর ইলন মাস্কের হাত ধরে যদি মানুষ লাল গ্রহটিতে যেতে পারে তাহলে তা হবে মানুষের এই সভ্যতার জন্য এক বিস্ময়কর মুহূর্ত। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ তাকিয়ে আছ ইলন মাস্কের সেই স্বপ্নযাত্রার দিকে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ