চূড়ায় থেকে আইপিএল ছাড়লেন মুস্তাফিজ
বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) এবার বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন কেবল একজনই, মুস্তাফিজুর রহমান। সাকিব আল হাসান নেই এবারের আসরে। বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা তাই তাকিয়ে ছিল মুস্তাফিজের দিকে। ‘কাটার মাস্টার’খ্যাত এই বাঁহাতি পেসার অবশ্য হতাশ করেননি, চেন্নাই সুপার কিংসের জার্সিতে উপহার দিয়েছেন দারুণ কিছু মুহূর্ত।
২০১৫ সালে মুস্তাফিজুর রহমানের ওয়ানডে অভিষেক ম্যাচে তাকে ধাক্কা মেরে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন তৎকালীন ভারতীয় অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি। এবার সেই ধোনিই খেলেছেন মুস্তাফিজের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। কাগজে-কলমে চেন্নাইয়ের অধিনায়ক রুতুরাজ গায়কোয়াড় হলেও অঘোষিত অধিনায়ক তো এই ধোনিই। ফিল্ডিং সেটআপ থেকে শুরু করে বোলিং পরিবর্তন- সব বিষয়ে ধোনির সহায়তা নিচ্ছেন গায়কোয়াড়। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে পরামর্শের জন্য চেন্নাই অধিনায়ক ছুটে যাচ্ছেন ধোনির কাছে। এই ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্ন ধোনির সংস্পর্শে মুস্তাফিজও যেন বদলে গেলেন, ফিরে পেলেন সেই পুরোনো রূপ।
বাজে ফর্ম নিয়ে আইপিএলে খেলতে গিয়েছিলেন মুস্তাফিজ। ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তিন ম্যাচের সিরিজে খেয়েছিলেন বেদম পিটুনি। ৩ ম্যাচে ১২ ওভার বোলিং করে দিয়েছিলেন ১৩১ রান, ওভারপ্রতি প্রায় ১১ রান দিয়ে শিকার করতে পেরেছিলেন মাত্র ২টি উইকেট। সেই মুস্তাফিজ বদলে গেলেন চেন্নাইয়ের জার্সি গায়ে দিয়েই। ২২ মার্চ আসরের উদ্বোধনী ম্যাচেই চেন্নাইয়ের হয়ে অভিষেক হয় তার, প্রতিপক্ষ বিরাট কোহলি, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল ও ফাফ দু-প্লেসিদের রয়্যাল চ্যালেঞ্জার বেঙ্গালুরু।
ব্যাটিং তারকায় ঠাসা দলটির বিপক্ষে নিজের জাত চেনাতে খুব বেশি সময় নেননি বাংলাদেশের এই পেসার। ম্যাচের পঞ্চম ওভারে আক্রমণে আসেন তিনি। ওই ওভারেই পতন ঘটে আইপিএল ২০২৪-এর প্রথম উইকেটটির। ওভারের তৃতীয় বলেই বেঙ্গালুরু দলপতি দু-প্লেসিকে সাজঘরে ফেরান ফিজ। দ্বিতীয় উইকেটটি নিতেও বেশি দেরি করেননি ‘কাটার মাস্টার’। ওই ওভারের শেষ বলেই সাজঘরে পাঠান রজত পতিদারকে। এই ম্যাচে তিনি শিকার করেন বিরাট কোহলির মূলবান উইকেটটিও। অজি তারকা অলরাউন্ডার ক্যামেরন গ্রিনও রেহাই পাননি ফিজের কাটার থেকে। ৪ ওভারে ২৯ রানের বিনিময়ে ৪ উইকেট নিয়ে মুস্তাফিজ জেতেন ম্যাচসেরার পুরস্কার।
এবারের আইপিএলটা বোলারদের জন্য দুঃস্বপ্নের অপর নাম হয়ে থাকবে। চার-ছক্কার ফুলঝুরিতে রানের বন্যা বসিয়ে দিচ্ছেন ব্যাটাররা। আইপিএল ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৪টি দলীয় ইনিংসই এসেছে চলতি আসরে। ২০ ওভারের ম্যাচে সানরাইজার্স হায়দরাবাদ করে ফেলেছে ২৮৭, ২৭৭ ও ২৬৬ রানের বিশাল স্কোর। কলকাতা নাইট রাইডার্সও খুব বেশি পিছিয়ে নেই। তারা এবার এক ম্যাচে তুলেছে ২৭২ রান। এদিকে পাঞ্জাব কিংস তো গড়ে ফেলেছে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রান তাড়ার রেকর্ড। ২৬২ রান তাড়া করেও ম্যাচ জিতেছে তারা। এমন রান-বন্যার টুর্নামেন্টে ব্যাটারদের লাগাম লাগানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন বোলাররা। এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ বেশিরভাগ বোলারই। সেই তালিকায় রয়েছেন অনেক নামি-দামি বোলাররাও।
প্রায় ২৫ কোটি রুপিতে আইপিএল খেলতে আসা মিচেল স্টার্ক ৮ ম্যাচ খেলে শিকার করতে পেরেছেন মাত্র ৭টি উইকেট। ওভার প্রতি তিনি দিয়েছেন প্রায় ১২ রান (১১ দশমিক ৭৮)। আরেক অজি পেসার, নিলামে যার মূল্য উঠেছিল সাড়ে ২০ কোটি রুপি, তিনি ৯ ম্যাচে পেয়েছেন ১০ উইকেট। তবে মাত্র ২ কোটি রুপির মুস্তাফিজ অনেক এগিয়ে। এবারের আসরে এখন পর্যন্ত তার চেয়ে বেশি উইকেট শিকার করতে পারেননি কোনো বোলারই। চেন্নাইয়ের জার্সিতে ৯ ম্যাচ খেলে ফিজ শিকার করেছেন মোট ১৪টি উইকেট। ভারতের তারকা পেসার জসপ্রিত বুমরাহ ও হার্শাল প্যাটেলও পেয়েছেন ১৪টি করে উইকেট। তবে এই দুজনই মুস্তাফিজের চেয়ে ম্যাচ খেলেছেন বেশি। আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য ভিসা-সংক্রান্ত কাজে চেন্নাইয়ের ম্যাচ বাদ দিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন মুস্তাফিজ। সেই ম্যাচটি মিস না করলে হয়তো উইকেট তালিকায় এককভাবেই শীর্ষে থাকতেন তিনি।
বুধবার চেন্নাই ও পাঞ্জাবের ম্যাচের মধ্য দিয়ে মুস্তাফিজের এবারের আইপিএল অভিযান শেষ হয়ে গেছে। ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ খেলতে বাংলাদেশ দলের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন তিনি। মূলত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রস্তুতি হিসেবেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলছে টাইগাররা। অনেক ক্রিকেট বিশ্লেষকের মতে, আইপিএলে খেলা চালিয়ে গেলেই মুস্তাফিজের বিশ্বকাপ প্রস্তুতিটা বেশি ভালো হতো। যদিও এটা মানতে নারাজ বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান জালাল ইউনুস। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ‘মুস্তাফিজের আইপিএলে খেলে শেখার কিছু নেই। তার শেখার সময় পার হয়ে গেছে। বরং মুস্তাফিজের থেকে শিখতে পারে আইপিএল খেলোয়াড়রা। এতে বাংলাদেশের কোনো লাভ হবে না।’
জালাল ইউনুসের এমন বক্তব্য ভালোভাবে নেননি আইপিএলের ধারাভাষ্যকাররাও। বিসিবি পরিচালক আকরাম খানের মতে, জিম্বাবুয়ে সিরিজ থেকে মুস্তাফিজুর রহমানের আইপিএল খেলা ভালো। সাকিব-মুস্তাফিজদের গুরু মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনও জানিয়েছেন তীব্র প্রতিবাদ। জালাল ইউনুসের বক্তব্য ফেসবুকে শেয়ার দিয়ে ক্যাপশনে লিখেছেন, ‘সর্বকালের সেরা কৌতুক’। মুস্তাফিজের শেখার অধ্যায় শেষ এটা মনে করেন না বিসিবি পরিচালক খালেদ মাহমুদ সুজনও। তবে তিনি চান মুস্তাফিজ জিম্বাবুয়ে সিরিজে খেলুক। সুজন বলেন, ‘দিন শেষে আমি মনে করি, দেশ সবার আগে। এটা মাথায় রাখতে হবে। মুস্তাফিজ যদি আইপিএল খেলতে পারত, আমিও খুশি হতাম। দেশের খেলা না থাকলে হয়তো সমস্যা হতো না। অনেকে হয়তো বলবে, নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটাররা আইপিএল খেলছে; কিন্তু আমাদের তো ১০টা মুস্তাফিজ নেই। এটাও চিন্তা করতে হবে।’
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম তিন ম্যাচের স্কোয়াডে অবশ্য মুস্তাফিজ নেই। তাকে দেখা যেতে পারে পরবর্তী ম্যাচগুলোতে। এরপরই পাড়ি জমাবেন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ খেলবে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ। এরপরই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। আইপিএলে যে দুর্দান্ত বোলিং মুস্তাফিজ করেছেন, বিশ্বকাপেও সেই ফর্ম অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের জন্য সেটা হবে দারুণ ব্যাপার।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে