Views Bangladesh Logo

পাঠ্যপুস্তক সরবরাহে দেরির ৬ কারণ জানিয়েছে এনসিটিবি

পাঠ্যপুস্তক ছাপানো সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রত্যাশিত সহায়তা না পাওয়ায় এবার সরবরাহে দেরি হয়েছে বলে জানিয়েছে এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ। বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন নতুন বিষয় যুক্ত হওয়া, মাধ্যমিকে বিভাগ বিভাজন এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বোর্ডের ২০১২ সালের কারিকুলামে ফেরায় গতবারের চেয়ে এবার ৯ কোটিরও কিছু বেশি পাঠ্যবই বাড়তি ছাপাতে হবে।

এ ছাড়া দীর্ঘ ১৫ বছর পর এবার প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সব পাঠ্যবই ছাপা হবে দেশের ছাপাখানায়। এর আগে ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর পাঠ্যবইয়ের একটি বড় অংশ ভারত থেকে ছেপে আনা হতো। উদ্ভূত পরিস্থিতে এবার ভারতে বই ছাপার কাজ দেয়া হয়নি। ফলে চাপ বাড়ে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরেও। এ সময় সবার সমন্বিত পদক্ষেপের প্রয়োজন থাকলেও মুদ্রণ শিল্প সমিতি এবং আনুষঙ্গিক অফিসগুলোর সহায়তা পায়নি এনসিটিবি, বলে অভিযোগ করেন এই কর্মকর্তারা।

তবে বোর্ডের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, এই বছর পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর সমগ্র প্রক্রিয়াতে ৬টি সমস্যা থাকায় পাঠ্যপুস্তক সরবারহে দেরি হয়েছে। তার মতে এবার প্রধান সমস্যা ছিল সময়। এ ছাড়া প্রেসের সঠিক সক্ষমতা যাচাই না করতে পারা, গত বছরের তুলনায় অধিক পরিমাণে পাঠ্যপুস্তক ছাপানো, ব্যাংকের সহযোগিতা না পাওয়া, প্রেসগুলোর সহযোগিতার অভাব, বেশি লাভের প্রত্যাশা, মানসম্মত প্রকাশনায় কঠোর অবস্থান গ্রহণ এবং রি-টেন্ডারে বাধ্য হওয়াও অন্যতম কারণ বলে জানান তিনি।

গত বৃহস্পতিবার (জানুয়ারি ২৩) কারণগুলো ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, সময় আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। যে সময়ে অন্যান্য বছর টেন্ডার হয়ে ছাপাখানায় কাজ চলে যায় সেই সময়ে এবার জুলাই গণঅভ্যুত্থান হয়। সেপ্টেম্বরে মাঝামঝি মন্ত্রণালয় থেকে পরিমার্জন কমিটি গঠন করে ছাপানোর উপযোগী কপি হাতে পেতে পেতে নভেম্বরের শুরু। আবার এবার দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য প্রথমবারের মতো নতুন বই ছাপানোর চাপ বেড়ে যাওয়ার কথাও বলেন তিনি।

অধ্যাপক রিয়াজুল বলেন, ‘এ সময়ে ছাপাখানা থেকে আমরা সর্বোচ্চ সহায়তা আশা করেছিলাম; কিন্তু তা হয়নি। বরং সব ছাপাখানা মিলে যেন বই ছাপানোর কাজ দ্রুত শেষ করতে পারে তার জন্য আমাদের সকল ধরনের সহায়তা দিতে হয়েছে। তবুও ছাপাখানার মালিকরা যখন জানালো দেশে ১১৬টি ছাপাখানায় দিনে প্রায় ১ কোটি ৪২ লাখ পাঠ্যপুস্তক ছাপানো সম্ভব তখন ডিসেম্বরের প্রথম একুশ দিনে এবারের প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তক ছাপানো এবং জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই বাধাই শেষে সরবারহ সম্ভব হবে বলে ধারণা ছিল। সে হিসাব করেই কিন্তু বই সরবরাহের সময় ঘোষণা দেয়া হয়েছিল।'

'কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি যে দিনে ৪৮ লাখ ৪৮ হাজার পাঠ্যপুস্তক ছাপানো সম্ভব হচ্ছে। আসলে সময় স্বল্পতার কারণে এবার ছাপাখানাগুলোর সক্ষমতা যাচাই করা হয়ে উঠেনি। এসব সমস্যা না হলে সঠিক সময়েই পাঠ্যপুস্তক ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে তুলে দিতে পারতাম। ছাপাখানার সমস্যার কিন্তু এখানেই শেষ নয়। তারা যে কাগজ, অন্যান্য কাঁচামাল কিনবে তার জন্য আবার ব্যাংক লোন দরকার। সেই ঝামেলা মেটাতে আমাদের দেন-দরবার করতে হলো। আবার আর্টকার্ড কাগজ দরকার সেখানেও আমাদের সহায়তা করতে হয়েছে।'

আর্টকার্ড আমদানিকারক ইউনিয়ন আসোসিয়েটের অ্যাডভাইজর এসএম রিয়াজ রশীদ জানান তারা সাধারণত ছাপাখানার সঙ্গে কাজ করেন। এবার বিশেষ পরিস্থিতিতে সরাসরি সরকারের সঙ্গে কাজ করছেন। তারা আর্টকার্ড দেশে নিয়েও এসেছেন। এখন খালাস করা বাকি। এ ছাড়া ছাপাখানার মালিকরা দেশের ক্রাইসিস মুহূর্ত বিবেচনা না করে লাভের দিকে অযাচিত নজর দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেন অধ্যাপক রিয়াজুল। 'এমনকি নিম্নমানের কাগজের পাঠ্যপুস্তক সরবারহের মতো ঘটনাও আমরা দেখেছি। অনেকে ছাপার কাজ ইচ্ছে করে দেরি করছেন বলেও অভিযোগ আছে। কারণ তাহলে শেষের দিকে কাজের চাপের দোহাই দিয়ে নিম্নমানের কাগজও দিতে পারবেন তাই।'

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রধান সম্পাদক মুহাম্মদ ফাতিহুল কাদীর জানান মান খারাপের কারণে চতুর্থ শ্রেণির একটিসহ মোট দুটি পাঠ্যপুস্তক ফেরত দিয়ে পুনরায় ছাপাতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্পের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, লাভ করার আশা কে না করে? এবং এই সরকারি অর্ডার ছাপাখানাগুলোর আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। তাই অধিক আয়ের জন্য ইচ্ছে করে ছাপানো দেরি করে পরবর্তীতে নিম্নমানের কাগজে পাঠ্যপুস্তক সরবারহের চেষ্টা করে। আগে কিছু বলা হতো না। এবার সরকার কঠোর অবস্থানে আছে, এটাই পার্থক্য।

যেহেতু দেরি করে ছাপানো নিয়ে সরাসরি অভিযোগ দেয়া যাচ্ছে না, তাই যারা অর্ডারের বিপরীতে কম পাঠ্যপুস্তক ছাপাতে পেরেছেন তাদের ওয়ার্ক অর্ডার কমিয়ে দিয়ে যে ছাপাখানাগুলো কাজ দ্রুত করেছে তাদের দিয়ে দেয়াও হচ্ছে বলে জানান এনসিটিবির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক রিয়াজুল। যদিও এবার সকল শিক্ষার্থীকে পাঠ্যপুস্তক দিতে দিতে মার্চ মাস পুরোটা লাগতে পারে বলে গুঞ্জন আছে, এনসিটিবির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখের মধ্যে সব বই সরবারহের জন্য হাতে পাওয়া যাবে। তাই ফেব্রুয়ারি মাসের ২৫ তারিখের মধ্যে সব শিক্ষার্থীর কাছে পাঠ্যপুস্তক পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে এনসিটিবি।

এনসিটিবি বলছে এ বছর এবার মাধ্যমিক স্তরের জন্য ৩০ কোটি ৯৬ লাখ ১২ হাজার ৮৪৭টি ও প্রাক-প্রাথমিক এবং প্রাথমিক স্তরের জন্য ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫০ হাজার ৩৫৫টি পাঠ্যপুস্তক ছাপানো হবে। অর্থাৎ ৪০ কোটি ১৫ লাখ ৬৩ হাজার ২০২টি পাঠ্যপুস্তক ছাপা হবে। ২০২৪ সালের জন্য ৩০ কোটি ৭০ লাখ ৮৩ হাজার পাঠ্যপুস্তক ছাপানো হয়েছিল। এনসিটিবি সূত্র বলছে ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত মাধ্যমিক স্তরের জন্য ১১ কোটি ৩ লাখ ৯১ হাজার ৭০২টি ও প্রাক-প্রাথমিক এবং প্রাথমিক স্তরের জন্য ৭ কোটি ২০ লাখ ৪৩ হাজার ৫৫৫টি পাঠ্যপুস্তক ছাপানো হয়েছে।

অধ্যাপক রিয়াজুল বলেন, এবার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলো দশম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা। কারণ তাদের নতুন সিলেবাসে এক বছর পরেই পরীক্ষায় বসতে হবে। ১০ম শ্রেণির জন্য আমাদের প্রায় ৬ কোটি পাঠ্যপুস্তক লাগবে। এর মধ্যে প্রায় ৪ কোটি (২ কোটি ৮০ লাখ) দিয়ে দেয়া হয়েছে।

'আগামী ৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নবম শ্রেণির বাকি সব পাঠ্যপুস্তক পৌঁছে দেয়া হলে ছাপাখানার ওপরে চাপ কমে আসবে। কারণ নবম এবং দশম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক ৪৭ ফর্মার যেখানে অন্যান্য শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক সর্বোচ্চ ১৭ ফর্মার। এবার সবচেয়ে বকম ছাপা হয়েছে ৪র্থ এবং ৫ম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক। তাই যে সব প্রেসে ৩টি ছাপা মেশিন, তাদের একটিতে ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক ছাপাতে বলা হয়েছে এবং যাদের ৫টি ছাপা মেশিন আছে তাদের ২টিতে ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক ছাপাতে বলা হয়েছে।'

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ