পর্যবেক্ষক দল ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা
এবারের নির্বাচনে বিএনপি মাঠে নেই–এটাই বড় আলোচনা এবং যত রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ। অস্বীকার করার উপায় নেই, বিএনপি বাংলাদেশের বড় দুটি দলের একটি। জামায়াতে ইসলামের রাজনীতিতে কিছু প্রভাব ও সমর্থন থাকলেও তাদের নিবন্ধনই নেই, যে কারণে আনুষ্ঠানিক নির্বাচনেরও সুযোগ নেই; কিন্তু নির্বাচনবিরোধী আন্দোলনে জামায়াত আছে। মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা হলো, যদি বিএনপি নির্বাচনে আসত, তাহলে নিবন্ধন না থাকা সত্ত্বেও জামায়াত নির্বাচনের মাঠে থাকত। বিএনপির পোশাকের আড়ালে তারা পার্লামেন্টে প্রবেশ করত। আন্দোলনেও তারা বিএনপির ব্যানারের নিচেই মূলত আছে, যদিও বিক্ষিপ্ত কিছু কর্মসূচি তারা দিয়ে থাকে।
এখন কথা হলো, বিএনপি-জামায়াত নির্বাচনে না থাকায় এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে কি না এবং নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন করে যারা ক্ষমতায় আসবেন, তারা সরকারের কার্যক্রম কন্টিনিউ করতে পারবেন কি না। এটি একটি প্রশ্ন হয়ে অনেকের মনে উঁকি দিচ্ছে। একটি আশঙ্কা দীর্ঘদিন ধরে বিরাজ করেছে, যে নির্বাচন বানচালের জন্য আন্দোলনরতদের প্রতিরোধের মুখে নির্বাচন বানচাল হয়ে যাবে কি না। তা হয়নি। আর মাত্র কয়েকদিন পরই নির্বাচন। এখন পর্যন্ত নির্বাচনের প্রক্রিয়া যথাযথভাবে চালিয়ে যেতে পেরেছে নির্বাচন কমিশন। দেশে ইতিমধ্যে নির্বাচনি উৎসব শুরু হয়েছে। আগামী দুই সপ্তাহে এমন কোনো লক্ষণ নেই যে, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া বিরোধীরা ঠেকাতে পারবে। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর পরবর্তী সরকার যে শপথ গ্রহণ করে দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারবে, তারও কিছু ইঙ্গিত আছে।
জাপান হলো যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় মিত্র দেশ। বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নানা বিষয়ে মতানৈক্য রয়েছে; কিন্তু জাপানের সঙ্গে প্রায় নেই বললেই চলে। সেই জাপানের রাষ্ট্রদূত ইয়োয়ামা কিমিনোরি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, আন্তরিক আলোচনা করেছেন এবং সীমিত আকারে হলেও নির্বাচন পর্যবেক্ষক পাঠানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। নির্বাচনে জাপানের ১৬ জন পর্যবেক্ষক থাকবেন। আগেই বলে রাখা ভালো, যে দেশই একজন হলেও পর্যবেক্ষক পাঠাবে, মনে রাখতে হবে, সেই দেশেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়াটা প্রকারান্তরে মেনে নিচ্ছে। এটি কমনসেন্স থেকেই ধরে নেওয়া যায়।
যাই হোক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন আগেই জানিয়েছিল তারা বিপুলসংখ্যক পর্যবেক্ষক পাঠাতে পারবে না। লক্ষণীয়, তারা যখন এ অপারগতার ঘোষণা দেয়, কয়েক মাস আগে, তখন কিন্তু এটা নিশ্চিত ছিল না যে বিএনপি নির্বাচনে আসবে না। তারপরও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৪ জন পর্যবেক্ষক পাঠিয়েছেন, যারা ইতিমধ্যেই ঢাকায়। এদিকে বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের ২৯ জন কর্মকর্তা বিদেশি পর্যবেক্ষক হিসেবে অ্যাক্রিডিটেশন চেয়েছেন। এ ছাড়া আফ্রিকা থেকে এবং স্থানীয় অনেক পর্যবেক্ষক নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছে, যা আলোচ্য বিষয় নয়।
পর্যবেক্ষকের সংখ্যাই বড় কথা নয়। যদি ১০ জন বিদেশি পর্যবেক্ষক থাকেন আর নির্বাচন সুষ্ঠু ও কারচুপি মুক্ত না হয়, তাহলে যেমন একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, তেমনি সীমিত পর্যবেক্ষকের উপস্থিতিতে একটি সুন্দর কারচুপিহীন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন সম্পন্ন করে ফেলতে পারলে নির্বাচন কমিশন এবং সরকার একটি বড় সফলতা পাবে বলে আমরা মনে করি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়কণ্ঠে বারবার উল্লেখ করেছেন, তিনি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করবেন। তার এই ইচ্ছার প্রতিফলন আওয়ামী লীগের জন্যই ভীষণ প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ চেয়েছে একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ ভোটকেন্দ্রে আসুক এবং নিজেদের ভোট নিজেরা প্রয়োগ করুক, যাতে গোটা বিশ্ব দেখতে পায়, বাংলাদেশে মানুষ তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পেরেছে। এতে পরবর্তী সরকারের গ্রহণযোগ্যতাও তৈরি হবে।
এ কথাও ঠিক, বিএনপি যতই ভোটে না থাকুক, জনগণ যদি পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নিজের মতের প্রতিফলন ঘটানোর সুযোগ পায়, তাহলে ঝাঁপিয়ে পড়বে ভোটকেন্দ্রে। এমনকি বিএনপির কট্টর সমর্থকরাও আসবে ভোট দিতে। কারণ বাংলাদেশ একটি হোমোজেনিয়াস ন্যাশন। এখানে স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক পরিচয়ের চেয়ে ব্যক্তিগত পরিচয় ও সখ্য কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যে কোনো কারণেই যেসব মানুষ ভোটকেন্দ্রে কাউকে ভোট দিতে আসবেন, তারা আর নির্বাচন-পরবর্তী বিএনপির আন্দোলনে নিজেদের শরিক করতে পারবেন না নৈতিক কারণেই।
আমাদের বুঝতে কোনোই অসুবিধা নেই যে, নির্বাচনের পরপরই বিএনপি এবং কয়েকটি ছোট দল এই নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণা দিয়ে একটি আন্দোলন জমাতে চেষ্টা করবে। সেই আন্দোলন কতটা জমাতে পারবে, তারা সেটাও নির্ভর করছে এই নির্বাচনের ধরনের ওপর। আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি, যদি সত্যিই মানুষ তার ভোটের মূল্য পায়, তাহলে বিএনপি আন্দোলন ঠিক জমিয়ে তুলতে পারবে না। আর যদি ২০১৮ সালের মতো একটি নির্বাচন হয়, তাহলে এখনো যারা দুই প্ল্যাটফর্মের বাইরে আছেন, তারাও আন্দোলনের সমর্থক হয়ে উঠতে পারেন।
এতে নির্বাচন-পূর্ব আন্দোলনের চেয়ে নির্বাচন-পরবর্তী আন্দোলন বেগবান হয়ে উঠতে পারে। সুতরাং নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের এখন প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হয়ে পড়েছে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের প্রধান কাজ দলীয় নেতাকর্মীদের আইন ও নিয়ম কানুনের অধীন থাকতে বাধ্য করা। এখন ইন্টারনেট-মোবাইল টেলিফোনের যুগ। একটি এলাকায় কারচুপি বা ছিনিমিনি ঘটলে তা মুহূর্তের মধ্যে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে। সঙ্গে সঙ্গে দলের এবং দলের বাইরের প্রত্যেক প্রার্থী মরিয়া হয়ে উঠবে ছিনিমিনি খেলার জন্য।
পাশাপাশি একথাও সত্য, সুষ্ঠু একটি নির্বাচন সম্পন্ন করা গেলে বহির্বিশ্বে যেসব দেশ নেতিবাচক অবস্থান গ্রহণ করেছে তারাও সরকারবিরোধী অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য হবে। এ কথা পত্রিকান্তরে বলেছি। নির্বাচনটি যদি কাটাকাটির মধ্যে দিয়ে সম্পন্ন হয় তাহলে সরকারের বন্ধু দেশগুলোও সমর্থন অব্যাহত রাখার মনোবল হারিয়ে ফেলতে পারে। আফটার অল সারা বিশ্বের মানুষ, বিশেষ করে পৃথিবীর সব দেশ মুখে অন্তত স্বীকার করে জনতা জনার্ধন। তাই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে নির্বাচনের চেহারাটি দেখার জন্য। বোঝা যায়, ৭ জানুয়ারির এই নির্বাচনের আগে কোনো শক্তিশালী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আপাতত আর কোনো বৈরী খবর আসবে না, সেটা সরকারের জন্য একটি স্বস্তির বিষয়। সঙ্গে এটাও বলা জরুরি যে, একটি ভালো নির্বাচন করলে শুধু নির্বাচনই গ্রহণযোগ্য হবে না, সেই সঙ্গে কয়েকটি দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক পুনপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
লেখক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে