মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ দূর করা জরুরি
‘দারিদ্র্য অসহ/পুত্র হয়ে জায়া হয়ে/কাঁদে অহরহ/আমার দুয়ার ধরি’ পঙক্তিগুচ্ছ লিখেছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মা সন্তানকে বিক্রি করে দেন, পিতা আত্মহত্যা করেন- এমন খবর প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ক্ষুধা এমন ভয়াবহ ব্যাপার, যা মানুষকে পশুতে রূপান্তরিত করে।
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ মারা গেছে স্রেফ না খেতে পেরে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে, যুদ্ধে, মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হয়ে অনেক অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ মারা গেছে চোখের নিমিষে। আধুনিক এই পৃথিবীতে মানুষ সম্পদের পরিমাণ বাড়াতে পেরেছে, খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে পেরেছে; কিন্তু মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ দূর করতে পারেনি।
তাই দেখা যায় এখনো পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ অভুক্ত। এর কারণ যুদ্ধ ও সম্পদের বিপুল বৈষম্য। বাংলাদেশে যুদ্ধ চলছে না; কিন্তু তারপরও দেখা যাচ্ছে, বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে এ বছরও মাঝারি মাত্রার ক্ষুধায় আক্রান্ত বাংলাদেশ। দেশের বহু মানুষ পুষ্টিকর ও প্রয়োজনীয় খাবার পান না।
গতকাল বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, বিশ্ব ক্ষুধা সূচক ২০২৪-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ক্ষুধা মোকাবিলায় বাংলাদেশে অগ্রগতি হলেও এখানে এখনো বিরাজ করছে মাঝারি মাত্রার ক্ষুধা। ১৯ দশমিক ৪ স্কোর পেয়ে বাংলাদেশ ১২৭ দেশের মধ্যে আছে ৮৪তম স্থানে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের স্কোর ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের চেয়ে ভালো থাকলেও নেপাল ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে পিছিয়ে।
বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকের তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ক্ষুধা নিরসনে বাংলাদেশের অগ্রগতি হলেও জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২-এর প্রকৃত ক্ষুধামুক্তির প্রতিশ্রুতি থেকে এখনো অনেক দূরে আছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও লিঙ্গবৈষম্যের কারণে এখনো দেশের বিভিন্ন জায়গায় বহু মানুষ খাবারের তীব্র সংকটে থাকে।
বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ যে খাদ্য-সংকটে থাকে, তা স্বাভাবিক চোখেই দেখা যায়। গৃহহীন, উদ্বাস্তু মানুষের কথা বাদ দিলেও দেশের অধিকাংশ পরিবার প্রতিদিনই কোনোরকমে খেয়ে-পরে বেঁচে আছে। একদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের ঊর্ধ্বগতি, আরেক দিকে অসংখ্য মানুষ কর্মহীন, বেকার, সমাজে-রাষ্ট্রে সীমাহীন বৈষম্য। ফলে স্বল্প আয়ের কোনোরকমে দিনে এনে দিনে খেয়ে টিকে আছে। এতে তার শিকার হচ্ছে প্রচণ্ড পুষ্টিহীনতায়। যা প্রভাব ফেলছে তাদের কর্মজীবনে।
অভিজিৎ ভি ব্যানার্জি এবং ইস্থার দুফ্লো তাদের ‘পুওর ইকোনমিক্স’ বইয়ে দেখিয়েছেন গরিব পরিবারের সন্তানরা স্কুলে গেলেও তেমন কিছু শিখতে পারে না অপুষ্টিতে ভোগার কারণে। এতে তারা প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরিবারের বাড়তি আয়টুকু তখন চলে যায় চিকিৎসাসেবায়, যা তাদের আরও দরিদ্র করে ফেলে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এটা চলতে থাকে। এটা একটা দুষ্টচক্র।
পুরো পৃথিবীই যেন আজ এমন এক দুষ্ট ক্ষুধাচক্রে আবদ্ধ হয়েছে। একদিকে কিছু মানুষের হাতে এসে জড়ো হচ্ছে পৃথিবীর অধিকাংশ সম্পদ, আরেকদিকে মুষ্টিমেয় মানুষ দিন দিন আক্রান্ত হচ্ছে ক্ষুধা-বঞ্চনায়। অনেক গবেষণাই এ নিয়ে হয়েছে, হবে; কিন্তু ক্ষুধামুক্ত একটা পৃথিবী কি আমরা কোনোদিন গড়ে তুলতে পারব? আমাদের সদিচ্ছা ছাড়া সেটা সম্ভব নয়।
খাদ্য মানুষের মৌলিক অধিকার, জন্মগত অধিকার- মানুষকে ক্ষুধার্ত রাখা কোনো সভ্য সমাজের পরিচয় হতে পারে না। আমরা চাই, একটি ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়ে উঠুক। পৃথিবীর সব মানুষ যেন অন্তত দুবেলা দুমুঠো পেট ভরে খেতে পারে এটা আমাদের নিশ্চত করতেই হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে