Views Bangladesh Logo

সমস্যা-অবহেলায় আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র হতে পারছে না চন্দ্রনাথ পাহাড়

ব্যবস্থাপনা, নোংরা পরিবেশ ও নিরাপত্তাহীনতাসহ পর্যটক আকৃষ্টে কর্তৃপক্ষের কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় দর্শনীয় পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হতে পারছে না তীর্থস্থান চন্দ্রনাথ পাহাড়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নেই কোনো তৎপরতা, থাকা বা খাবার জন্য নেই উন্নত হোটেল-মোটেল, এমনকি পুরো পাহাড় বা আশপাশের এলাকায় নেই কোনো গণশৌচাগারও । ফলে আশানুরূপ পর্যটক বঞ্চিত চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলা শহরের এই পাহাড়।

চন্দ্রনাথ মন্দির থেকে নামকরণ হওয়া চন্দ্রনাথ পাহাড় মূলত হিমালয়ের বিচ্ছিন্ন পূর্বাঞ্চলীয় অংশ। হিমালয়ের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব দিক ঘুরে ভারতের আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের মাঝ দিয়ে ফেনী নদী পার হয়ে চট্টগ্রামের সঙ্গে মিশেছে এটি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ১ হাজার ২৫০ ফুট উচ্চতার পাহাড়টিতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জাগ্রত শিবমন্দির ছাড়াও রয়েছে আকর্ষণীয় দুটি জলপ্রপাত সহস্রধারা ও সুপ্তধারা। সুনসান নীরবতা, দুর্গম পাহাড়িপথের চারপাশে সবুজ গাছপালা, তার পত্রপল্লবে বাতাসের গান, এরই মাঝে ভেসে আসে পশু-পাখির ডাক।

এতকিছুর সমাহারেও আরও পর্যটক-দর্শনার্থীদের সামনে কেন নিজেকে মেলে ধরতে পারছে না সম্ভাবনায় পর্যটনকেন্দ্রটি?- জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. শরীফুল আলম খন্দকার বলেন, ‘আদর্শিক পর্যটনে পর্যটকের চাহিদা সমানুপাতিক জোগান থাকা অনিবার্য। তা না হলে প্রকৃতির নৈসর্গিক স্থানগুলোও পর্যটক স্থান হিসেবে গড়ে না উঠে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়।’

নেই উন্নত হোটেল-মোটেল ও খাবার ব্যবস্থা


সরেজমিন দেখা গেছে, নাগরিক যান্ত্রিকতা থেকে ছুটি নিতে ছুটে আসা শত শত পর্যটক ও তীর্থযাত্রীদের ভিড়ে জমজমাট চন্দ্রনাথ পাহাড়। তাদের অনেকেই জানিয়েছেন পাহাড়ের বুক থেকে পাওয়া রোমাঞ্চকর আর মনের গহীনে পাহাড়সম মানসিক প্রশান্তি ফিরে আসার অনুভূতির কথা। তবে সবার মাঝেই নানা সমস্যা-সংকটে আর প্রশাসনিক অবহেলায় দুর্ভোগ পোহানোর আক্ষেপ।

চীন প্রবাসী ড. ফররুখ উদ্দিন বলেন, এখানে এসে হতাশ হতে হয়েছে, কারণ উন্নত কোনো হোটেল মোটেল নেই। নেই ভালো মানের কোনো রেস্তোরাঁও। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মাজেদুল ইসলাম বলেন, ‘আদর্শ পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তুলতে অবশ্যই উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, পর্যাপ্ত হোটেল ও রিসোর্ট ও সব ধরনের রেঁস্তোরা থাকা আবশ্যক। তাহলেই পর্যটকরা আকর্ষিত হবেন।’

নেই গণশৌচাগার, বেশি অস্বস্তিতে নারী পর্যটকরা


সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম তীর্থ দর্শনে এসেছেন গীতা রানী দাস। তিনি বলেন, ‘এ পাহাড়ে প্রায়ই আসি। তবে পাহাড়ে তো বটেই, আশপাশেও কোনো গণশৌচাগার না থাকায় বিপাকে পড়ে যাই।’ একই অভিযোগ ঢাকা থেকে যাওয়া প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শেখ সানজিদারও। তিনি বলেন, ‘প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগে এসে আমার মতো অনেককেই অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে।’ তবে দ্রুতই গণশৌচাগার স্থাপনের আশ্বাস দিয়েছেন সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কে এম রফিকুল ইসলাম।

পরিণত হচ্ছে প্লাস্টিক বর্জ্যের স্তূপে


পাহাড়ের পাদদেশ থেকে চূড়া পর্যন্ত বেশ কিছু ছোট দোকানে বিক্রি হয় পানি, স্যালাইন, চিপস জাতীয় খাবার। সেগুলো খেয়ে ও পানের পর পানির বোতল, স্যালাইন-চিপসের খালি প্যাকেট আর পলিথিন যেখানে সেখানে ফেলে দেন পর্যটকরা। পাহাড়ে ওঠার পথের ডানে-বামেসহ পাহাড়জুড়ে, এমনকি দিন দিন বাড়তেই থাকা দোকানগুলোর সামনেও জমে থাকছে পরিত্যক্ত পলিথিন-প্লাস্টিক, ময়লা-আবর্জনার স্তূপ, যা পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ।

দোকানিদের দাবি, পাহাড়ের ময়লা প্রতিদিন নামানো সম্ভব হয় না। সপ্তাহে এক দিন পরিষ্কার করেন তারা। একজন দোকানি ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘দোকানের সামনে পর্যটকদের ফেলে যাওয়া বোতল-প্যাকেট আর ময়লা-আবর্জনাগুলো নির্দিষ্ট জায়গায় রাখি। নিচে থেকে সপ্তাহে এক দিন টোকাইরা এসে সব বোতল নিয়ে যায়; কিন্তু যেসব বোতল-প্যাকেট পর্যটকরা ছুড়ে ফেলেন, সেগুলো পরিষ্কার করা সম্ভব হয় না। সেগুলো পাহাড়েই রয়ে যায়।’

তীর্থযাত্রী মালতি দে বলেন, ‘পর্যটকদেরও সচেতনতা প্রয়োজন। আমাদের উচিত, ময়লাগুলো নিচে নিয়ে যাওয়া। তা না হলে এক সময় পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখাই দুষ্কর হয়ে যাবে।’ ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) সংগঠনের সদস্য সচিব শরীফ জামিল বলেন, ‘চন্দ্রনাথ পাহাড় দেশের বিশেষ সৌন্দর্যময় প্রাকৃতিক সম্পদ। সাধারণ মানুষ তা দেখতে যাবেন, এটাই স্বাভাবিক; কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনে অনন্য বৈশিষ্ট্যের এই নৈসর্গিক দৃশ্য আজ পলিথিন-প্লাস্টিকে ম্রিয়মাণ। চন্দ্রনাথ পাহাড় রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ জরুরি।’

নিরাপত্তাহীনতায় দর্শনার্থীরা


পাহাড় ঘুরে দেখা মেলেনি নিরাপত্তা বাহিনীর কোনো সদস্যের। আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা নিয়ে শঙ্কিত নিরাপত্তাহীনতায় থাকা দর্শনার্থীরা। নিজামপুর কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র সাফায়েত হোসেন বলেন, ‘আমাদের বাড়ি চট্টগ্রামে হওয়ায় বন্ধুরা মিলে প্রায়ই এখানে আসি। কখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাউকে দেখিনি।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কে এম রফিকুল ইসলাম অবশ্য দাবি করেন, পাহাড়ের চূড়ায় সাদা পোশাকে দশজন নিরাপত্তা কর্মী সব সময়ই থাকেন। কেউ শনাক্ত করতে না পারলেও নিজেদের দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করে চলেছেন তারা।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ