সাবেক জনপ্রতিনিধিদের অবহেলায় ভোগান্তিতে জামগড়াবাসী
প্রথম দেখায় মনে হতে পারে, আপনি কোনো এক ছোট্ট নদীর পাড় ধরে হাঁটছেন। যেখানে বড় বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে নদীর দুই তীরে; কিন্তু ধারণা পাল্টে যাবে কয়েক সেকেন্ডে। লঞ্চ বা জাহাজ নয়, এখানে চলাচল বেশি শত শত যানবাহনের। পানি ভেঙে পারাপার হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ।
দৃশ্যটি দেখতে বছরের যে কোনো সময় আসতে হবে আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল সড়কের জামগড়া এলাকায়। বছর বছর সড়কের চিত্র পাল্টালেও বদলায়নি এই সড়কের দেড় কিলোমিটার অংশে মানুষের চলাচলের চিরচেনা দৃশ্য। যেন ভোগান্তিই এই সড়কের অংশ। মাঝে মাঝে ঘটছে ছোট বড় দুর্ঘটনা। সম্প্রতি পানির নিচে থাকা গর্তে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন দুজন পোশাক শ্রমিক।
আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল সড়কের আশুলিয়ার জামগড়া থেকে ইউনিক বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত জনবহুল এলাকায় অবস্থিত ব্যস্ততম এই সড়ক। সারা বছরই জলাবদ্ধতা থাকায় চরম দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে এলাকার বাসিন্দা ও সড়ক ব্যবহারকারীদের।
রাস্তার দুই পাশ উঁচু করা, পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকা ও পরিকল্পনা অনুসারে শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত পানি নিষ্কাশনের কোনো পথ না রাখাসহ খাল দখলে পোহাতে হচ্ছে এই ভোগান্তি।
সরেজমিন দেখা গেছে, কয়েক বছর ধরে পোশাক কারখানায় ব্যবহৃত রঙিন পানি ভেঙে সারা বছরই চলাচল করতে হয় কয়েক লাখ মানুষকে। সামান্য বৃষ্টি হলেই সড়ক ছেড়ে ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত এই পানি ঢুকে পড়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়িতে। বৃষ্টি দীর্ঘ সময় থাকলে ভোগান্তি আরও বেড়ে যায় কযেকগুণ।
এলাকাবাসী জানান, সড়কটির এই দেড় কিলোমিটার অংশে নিয়মিত ঘটছে ছোট-বড় অসংখ্য দুর্ঘটনা। হেঁটে বা গাড়িতে তাদের চলাচল করতে হয় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। সম্প্রতি জামগড়ার একটি গর্তে লেগুনা উল্টে মারা যান দুজন পোশাক শ্রমিক, আহত হন বেশ কয়েকজন। অটোরিকশা উল্টে প্রায়ই আহত হচ্ছেন যাত্রীরা।
জামগড়াবাসীর অভিযোগ, পানি অপসারণের কোনো ব্যবস্থা নেননি স্থানীয় প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিরা। উল্টো খাল দখলে সহযোগিতা করেন আশুলিয়ার ইয়ারপুর ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান বাবা-ছেলে।
তাদের বিরুদ্ধে অবশিষ্ট একটি খাল থেকে এলাকাটির দূরত্ব বাড়িয়ে ভোগান্তিতে ফেলারও অভিযোগ তুলেছেন এলাকার লোকজন।
আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষের আহ্বানেও পানি অপসারণের দায়িত্ব নেননি তারা।
সরেজমিন দেখা গেছে, জামগড়া ছয়তলা থেকে ইউনিক বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত সড়কটি তৈরিই হয়েছে পানির নিচে। দুই পাশে উঁচু উঁচু প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়ি থাকায় পানি অপসারণের কোনো ব্যবস্থাই নেই। সড়ক বা আশপাশের কোনো প্রতিষ্ঠানের পানি সরাতে কোনো ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই। বাসাবাড়ির মূল ড্রেনেজ ব্যবস্থা থেকেও বিচ্ছিন্ন হওয়ায় সারা বছরই জমে থাকছে ময়লা-দুর্গন্ধময় পানি। এলাকাবাসীকে প্রয়োজনীয় কাজে এবং পোশাক শ্রমিকসহ শিক্ষার্থীদের এই পানি মাড়িয়ে চলাচলে পোহাতে হচ্ছে চরম ভোগান্তি।
এদিকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সামনে ছোট ছোট ড্রেন থাকলেও সেই পানি যাচ্ছে সড়কের উপরে। খালের মুখগুলোও দখল করে নিয়েছেন বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানসহ বাসাবাড়ির মালিকরা।
বিভিন্ন সূত্রের অভিযোগ, পানি সরাসরি সড়কে ফেলায় বৈশাখের কিছু পোশাক কারখানা, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও ভবন মালিককে চিঠি দেয় আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও তৎকালীন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান শামীম আহম্মেদ ভূইয়া ও তার বাবা সৈয়দ আহম্মদ ভূইয়া তাদের মেয়াদকালে এ বিষয়ে ছিলেন অনেকটাই নীরব। বারবার অভিযোগ করা হলেও আশ্বাস দিয়েও নেয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। উল্টো কারখানা ও ভবন মালিকদের সঙ্গে দেনদরবার করে দায় সেরেছেন বাবা-ছেলে।
আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল সড়কের পাশের একটি পোশাক কারখানার নারীশ্রমিক স্বর্না বেগম বলেন, ‘বাসা থেকে অফিসে আসতে-যেতে হাঁটু সমান পানি ভাঙতে হয়। মাঝে মাঝে আরও বেশি পানি থাকে। অনেক সময় পানিতে পড়ে যাই। এইটা তো এখন আমাদের জন্য রেগুলার হয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘কতবার যে ব্যথা পেয়েছি তার হিসাব নেই। প্রতিদিনই এক্সিডেন্ট হয় এই রাস্তায়। হাত-পা ভাঙে। অনেকে বাধ্য হয়ে কাজ ও এই এলাকা ছাড়ছেন।’
‘পচা পানিতে চুলকানি রোগ হয়ে গেছে। আমার দুই ছেলেমেয়েকে বাড়িতে রাইখা আসছি। এখন কি করবো, কাজ তো করতে হবে।’
জামগড়ার বাসিন্দা ও ভবন মালিক শরীফ চৌধুরী বলেন, ‘গত এক যুগ ধরে এই সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়নি। হোল্ডিং, ট্যাক্স সব পরিশোধ করেও নাগরিক সুবিধা পাওয়া যায়নি। বাবা-ছেলের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব থাকাকালে কয়েকবার অভিযোগ ও অর্থ দিয়ে ড্রেনেজ ব্যবস্থা করা যায়নি। বাসাবাড়ির পানি অপসারণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বাধ্য হয়ে সড়কে ফেলছেন অনেকে। সড়ক ভেঙে বিভিন্ন স্থানে তৈরি হয়েছে গর্ত। সেদিন গর্তে লেগুনা উল্টে মানুষ মারা গেছে। প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটছে।’
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ফোনে যোগাযোগ করেও কাউকে পাওয়া যায়নি। বর্তমানে ইয়ারপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন। তিনি বলেন, ‘আমি জানুয়ারিতে যোগ দিয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত এমন কোনো অভিযোগ পাইনি। পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’
তিনি বলেন, ‘আমাকে সমস্যাগুলো বললে অবশ্যই সমাধানে কাজ করব। আগে যারা দায়িত্বে ছিলেন তাদের গাফিলতি ছিল কি না বলতে পারছি না।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে