ভারত ভ্রমণে বাংলাদেশিদের জন্য ‘অন-অ্যারাইভাল’ ভিসা চালু এখন সময়ের দাবি
বিভিন্ন রাজনীতিক, কূটনীতিক, ব্যবসায়িক নেতা ও নীতিনির্ধারকদের মতে, বাংলাদেশের টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান এবং প্রতিবেশী দেশগুলোতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের চ্যালেঞ্জের কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশি নাগরিকদের অন-অ্যারাইভাল ভিসা দেওয়ার বিষয়টি ভারতের বিবেচনা করা উচিত।
ভারত সরকারের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জানুয়ারি-ডিসেম্বর মেয়াদে বাংলাদেশি পর্যটক (২২.২৭%) প্রতিবেশী ভারতে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছেন, এরপরেই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র (১৭.৭৯%), যুক্তরাজ্য (৯.৬৮%), কানাডা (৯.৬৮%) ও অস্ট্রেলিয়া (৪.০৫%)।
২০২৩ সালে ভারতে বাংলাদেশি পর্যটকদের আগমন আগের বছরের তুলনায় ৬০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পায়। সে বছর প্রায় ২০,৫৬,৮৮০ জন বাংলাদেশি পর্যটক প্রতিবেশী দেশটিতে যান, যেখানে ২০২২ সালে প্রায় ১২,৫৫,৯৬০ জন বাংলাদেশি পর্যটক গিয়েছিলেন।
২০২৩ সালের জানুয়ারি-ডিসেম্বর সময়ে বিদেশি পর্যটক আগমন (এফটিএ) ছিল ৯২,৩৬,১০৮ জন, যা ২০২২ সালের জানুয়ারি-ডিসেম্বরে ছিল ৬৪,৩৭,৪৬৭ জন এবং ২০১৯ সালের জানুয়ারি-ডিসেম্বরে ছিল ১,০৯,৩০,৩৫৫ জন, যা ২০২২ ও ২০১৯ সালের তুলনায় যথাক্রমে ৪৩.৫% এবং -১৫.৫% বৃদ্ধি পেয়েছে।
পর্যটক ছাড়াও প্রায় কয়েক হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ভারতের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে এবং অন্তত কয়েক লাখ বাংলাদেশি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রতিবছর ভীড় জমান।
ভারতের অভ্যন্তরীণ পর্যটনখাত উল্লেখযোগ্যভাবে ঘুরে দাঁড়ায় ২০২৩ সালে। ২০২২ সালের তুলনায় সে বছর বিদেশি পর্যটক আগমন (এফটিএ) ৬৪% বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়। অর্থাৎ ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ৯২ লাখ ৩৬ হাজার ১০৮ জন দর্শনার্থী গিয়েছেন, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৬৪ লাখ ৩৭ হাজার ৪৬৭ জন।
তবে ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, এই চমকপ্রদ প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও, এই খাতটি ২০১৯ সালে রেকর্ড করা কোভিড-১৯ মহামারির আগের সময়ের চেয়ে ১৫.৫% নিচে অবস্থান করছে।
২০২৩ সালের জানুয়ারি-ডিসেম্বর মেয়াদে, ফিন্যান্সিয়াল আর্নিংস ফ্রম এক্সপেন্ডিচার (এফইই) দাঁড়িয়েছে ২,৩১,৯২৭ কোটি, যা আগের বছরের তুলনায় ৬৫.৭৪% বৃদ্ধিকে প্রতিফলিত করে। মার্কিন ডলারের ক্ষেত্রে, এফইই-গুলো ২৮.০৭৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা একটি শক্তিশালী ৫৯.৪৩% বৃদ্ধি প্রদর্শন করে, যদিও ২০১৯ সালের তুলনায় -৮.৬১% হ্রাস পেয়েছে।
২০২২ সালের জানুয়ারি-ডিসেম্বরে ভারতে বিদেশি পর্যটক আগমনের শতকরা হার শীর্ষ ১৫টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল যুক্তরাষ্ট্র (২২.১৯%), এরপরে ছিল যথাক্রমে- বাংলাদেশ (২০.২৯%), যুক্তরাজ্য (৯.৯৮%), অস্ট্রেলিয়া (৫.৯৬%), কানাডা (৪.৪৮%), শ্রীলঙ্কা (২.৮৭%), নেপাল (২.১৯%), জার্মানি (২.০১%), সিঙ্গাপুর (১.৮৯%), মালয়েশিয়া (১.৮৮%), ফ্রান্স (১.৭৯%), রাশিয়ান ফেডারেশন (১.৫৪%), মালদ্বীপ (১.১৪%), পর্তুগাল (১.১০%), ও ইতালি (০.৯৭%)।
পর্যটনের ক্ষেত্রে, ২০১৯ সালটি ভারতের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য বছর ছিল কেননা, সে বছর দেশটিতে ১০.৯৩ মিলিয়নেরও বেশি পর্যটকের আগমন ঘটেছিল। ২০১৯ সালে এফইই-এর হিসাবে ভারতের অবস্থান ছিল বিশ্বে দ্বাদশ। এছাড়া, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পর্যটন প্রাপ্তিতে ভারত ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে।
শীর্ষে থাকা বাংলাদেশি পর্যটকের সংখ্যা ২২ লাখ ৬০ হাজার (২১ দশমিক ৩৭ শতাংশ), যুক্তরাষ্ট্র ১৪ লাখ ৬০ হাজার (১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ), যুক্তরাজ্য ১০ লাখ ৩০ হাজার (৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ)। শ্রীলঙ্কা ০.৩৫ মিলিয়ন (৩.৩৫ মিলিয়ন), কানাডা ০.৩৫ মিলিয়ন (৩.৩২ শতাংশ), অস্ট্রেলিয়া ০.৩৪ মিলিয়ন (৩.২৮%), মালয়েশিয়া ০.৩২ মিলিয়ন (৩.০২%), চীন ০.২৮ মিলিয়ন (২.৬৭%), জার্মানি ০.২৭ মিলিয়ন (২.৬০%), রাশিয়ান ফেড ০.২৬ মিলিয়ন (২.৪৮%), ফ্রান্স ০.২৬ মিলিয়ন (২.৪৮%), জাপান ০.২৪ মিলিয়ন (২.২৪%), সিঙ্গাপুর ০.১৮ মিলিয়ন (১.৭৪%), নেপাল ০.১৭ মিলিয়ন (১.৬৫%), থাইল্যান্ড ০.১৬ মিলিয়ন (১.৫৮%)।
বিশেষজ্ঞরা অভ্যন্তরীণ পর্যটন খাতে অব্যাহত বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছেন, ভিআইডিইসি কনসালট্যান্টসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও বীরেন্দ্র জৈন ২০২৪ সালের জন্য আশাবাদ প্রকাশ করেছেন। বিভিন্ন মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী জানা যায়, তাঁর মতে, “যদিও বহির্গামী ভ্রমণ প্রায় কোভিড-১৯ মহামারির আগের সময়ের উচ্চতায় ফিরে এসেছে, অভ্যন্তরীণ ভ্রমণ পরের বছর তার পুনরুদ্ধারকে আরও দৃঢ় করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই বছরটি ভারত ভ্রমণের গল্পের জন্য দুর্দান্ত ছিল এবং ভবিষ্যতের জন্য আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য একটি দৃঢ় ভিত্তি তৈরি করেছে। ভারত- ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা করছে।”
হেনলি পাসপোর্ট ইনডেক্স অনুযায়ী, বর্তমানে একজন বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী ৪২টি স্থানে ভিসা ছাড়াই ভ্রমণ করতে পারেন।
ভ্রমণের উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ব্যবসা ও পেশাদার ভ্রমণের পরিমাণ অনেক বেশি ছিল, যা মোট আগমনের ১০ দশমিক ২৮ শতাংশ, যে হার পুরো বছরে ভ্রমণের ২০% ছিল। বিপরীতে, চিকিৎসার জন্য ভ্রমণ, যা ডিসেম্বরে আগমনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ (৪৫.৭৩%) জুড়ে থাকলেও, পুরো বছরের ২৬.৫২ শতাংশের তুলনায় এর অংশ হ্রাস পেয়েছে। সূত্র অনুযায়ী, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণার ফলে প্রতিবেশী দেশে চিকিৎসার জন্য ভারতে ভ্রমণের পরিমাণ কমে যেতে পারে।
অন্যদিকে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খানের সঙ্গে সম্প্রতি সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে বৈঠকে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মা জানান, বাংলাদেশি নাগরিকদের অন-অ্যারাইভাল ভিসা দেওয়ার বিষয়টি ভারত বিবেচনা করছে। তিনি জানান, ভারতীয় হাইকমিশন গত বছর বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য প্রায় ১৬ লাখ ভিসা ইস্যু করেছে। যে সংখ্যাটি দিন দিন বেড়েই চলেছে। তিনি বলেন, “আমরা সময়মত বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা দেওয়ার সক্ষমতা বাড়িয়েছি। ভবিষ্যতে বাংলাদেশি নাগরিকদের নন-অ্যারাইভাল ভিসা দেওয়ার বিষয়টিও বিবেচনা করছে নয়াদিল্লি।” ভারতীয় হাইকমিশনার জানান, বেশ কয়েকজন ভারতীয় উদ্যোক্তা বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পে বিনিয়োগের জন্য গভীর আগ্রহ দেখিয়েছেন। বিশেষ করে ভারত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো ও বাংলাদেশের মধ্যে বিমান যোগাযোগ স্থাপনে আগ্রহী।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) একজন শীর্ষ নেতা এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ভারতীয় হাইকমিশনের উচিৎ জনবল বাড়ানো এবং হাজার হাজার বাংলাদেশি ভিসাপ্রার্থীর ভোগান্তি লাঘব করা। একজন বাংলাদেশি ভিসা প্রার্থীকে তার ভিসা আবেদন ফরম জমা দিতে যমুনা ফিউচার পার্কে ভারতীয় ভিসা আবেদনকেন্দ্রে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়সহ খাত-সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের কাছ থেকে মতামত ও সুপারিশ সংগ্রহ করা হয়। বৈঠকের পর চূড়ান্ত প্রস্তাবটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভারতের পক্ষের কাছে পাঠানো হবে এবং চুক্তি নবায়নের আগে পারস্পরিক মতবিনিময় শুরু করা হবে বলে জানা যায়।
ভিসা ডকুমেন্টেশনে 'ডেজিগনেটেড চেক পোস্ট' শব্দটির পরিবর্তে 'যেকোনো চেকপোস্টের মাধ্যমে' শব্দটি প্রতিস্থাপনের একটি উল্লেখযোগ্য প্রস্তাব আনা হয়েছে। এই পরিবর্তনের লক্ষ্য ভ্রমণকারীদের তাদের প্রবেশ এবং প্রস্থান পয়েন্টগুলি বেছে নেওয়ার নমনীয়তা সরবরাহ করা, নির্দিষ্ট চেকপোস্টগুলোতে যানজট কমান এবং ভ্রমণ প্রক্রিয়াটি সহজতর করা।
ভারতীয় পর্যটনের এক কর্মকর্তা বলেন, “বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিশ্বের পঞ্চম দীর্ঘতম স্থল সীমান্ত রয়েছে। যদিও ভারত সরকারের দৃষ্টিকোণ থেকে, পর্যটন ও অবৈধ অভিবাসনের মধ্যে একটি পাতলা রেখা রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। ভারতের পাঁচটি রাজ্যের মধ্য দিয়ে চলমান ভারত-বাংলাদেশ জটিল সীমান্ত পরিচালনা করা একটি কঠিন কাজ, যেখানে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। আন্তঃসীমান্ত অনুপ্রবেশ, অবৈধ অভিবাসন ও চোরাচালানের ঝুঁকি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে এখনও রয়ে গেছে।”
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে