পাটে নতুন উদ্যোগ, আশায় বুক বেঁধেছেন কাজ হারানো শ্রমিকরা
“কারখানা বন্ধ ঘোষণার পর আমাদের অনেকেই টাকা পেয়েছে, অনেকেই পায়নি। তবে কাউকে হিসাব বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। কাজ হারিয়ে আমাদের বেশির ভাগই বেকার অবস্থায় আছেন। আমরা মানবেতর জীবনযাপন করছি। এই বয়সে এসে আমাদের কাজ দেবে কে? কাজ যদি না পাই তাহলে আমাদের সংসার চলবে কীভাবে?” কথাগুলো বলছিলেন খুলনার ক্রিসেন্ট জুট মিল বন্ধ হওয়ায় কাজ হারানো শ্রমিক মোশাররফ হোসেন (৫৫)।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আরও বলেন, “মিল যদি চাহিদা অনুযায়ী পাট সরবরাহ না করে, তাহলে উৎপাদন কীভাবে হবে? ৫০০ মেশিনের জায়গায় কাজ চলে ১০০ থেকে ১৫০ মেশিনে। বাকিদের বসে থাকতে হয়। এর দায় তো শ্রমিকের না। ঠিকমত পাট আসলে শ্রমিক কাজ করত। উৎপাদন বাড়ত। সরবরাহ বাড়ত। তাহলে কোনো ভাবেই লোকসান হত না।”
একসময়ে জুট মিলের চাকরি ছিল সোনার হরিণের মতো। অন্য কোথাও বোনাস দিলেও এখানে মিলতো বেতন-বোনাস। এ চাকরি ঘিরে অনেকেই দেখতো রঙিন জীবনের স্বপ্ন। সে স্বপ্নেই রাজশাহী জুট মিলে কাজ নিয়েছিলেন মাসুদ রানা, ঘোড়াশালের বাংলাদেশ জুটমিলস লিমিটেডে সেলিম হোসেন। তবে ভিউজ বাংলাদেশ তাঁরা জানান, কাজ হারিয়ে এখন তারা পেশা পরিবর্তন করেছেন। তবে আগের সেই সচ্ছ্বলতা ফেরেনি।
এদিকে সরকারের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে এ বছরের মার্চে শুরু হয়েছে যশোর জুট মিলের কার্যক্রম। চলছে আকিজ জুট পার্ক নামে। বেসরকারি তত্ত্বাবধানে হলেও কারখানা চালু হওয়ায় খুশি কাজে ফেরা শ্রমিকরা। কথা হয় তাদের অনেকের সঙ্গেই। তারা জানান, কাজ হারিয়ে ৩ বছরের বেশি সময় বেকার ছিলেন। আবার কারখানা চালু হয়েছে। উৎপাদনও ভালো হচ্ছে। ঠিকমত বেতন পাওয়ায় আবার সংসারে সচ্ছ্বলতা ফিরতে শুরু করেছে। বাকিরাও যেন কাজে ফিরতে পারে সেজন্য তারা সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন।
সম্ভাবনাময় এ খাতের দুর্দশার থেকে বেরিয়ে আসতে সরকারি উদ্যোগের বিকল্প নেই বলে মনে করছেন খুলনা অঞ্চলে পাটকল শ্রমিকদের নিয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলনের অন্যতম নেতা রুহুল আমিন। তিনি বলেন, “এই শিল্পের সম্ভাবনা আছে। তবে সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া ভালো কিছু সম্ভব নয়। কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এরইমধ্যে এ খাতে বিনিয়োগ করছে। তারা ভালোভাবে কাজও করছে। তবে সরকার যদি যথাযথ উদ্যোগ ও সহায়তা না করে তবে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো খুব বেশিদূর এগুতে পারবে না। এতে শিল্পের আকার বড় হবে না। তাই বিশাল সম্ভাবনার শিল্পকে এগিয়ে নিতে সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ ও উদ্যোগ নিতে হবে। এবং সেই উদ্যোগে কাজ হারানো শ্রমিকদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।”
একসময়ের প্রধান রপ্তানি পণ্য পাট হারিয়েছে তার জৌলুস। লোকসানে একে একে বন্ধ হয়েছে সবগুলো রাষ্ট্রায়াত্ত পাটকল। এতে একসঙ্গে কাজ হারিয়েছেন ২৫ হাজার শ্রমিক। তাদের অনেকেই আজও পাননি কোনো কাজ। পাটকল ঘিরে গড়ে ওঠা জন-জীবনে নেমে এসেছে বিপর্যয়। চাষিসহ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ৪ কোটি মানুষের জীবিকার সঙ্গে মিশে থাকা লাভজনক খাতে নেমে আসা এই দুর্দশা বারবার দেয় প্রশ্নের জন্ম। তবে বর্তমান সরকার নতুন মেয়াদে ক্ষমতায় এসেই নজর দিয়েছে এ শিল্পে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বারবার বলছেন পাট শিল্পকে এগিয়ে নেওয়ার কথা। বলছেন আবারও পাটকে বিকল্প রপ্তানি পণ্য হিসেবে তুলে ধরার কথা। এতে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন পাট শিল্পের সঙ্গে জড়িত থাকা শ্রমিক থেকে শুরু করে সকলেই।
সরকারের পরিকল্পনার বিষয়ে পাট অধিদপ্তরের উপপরিচালক (পরীক্ষণ) ও উপ প্রকল্প পরিচালক (উপসচিব) সৈয়দ ফারুক আহম্মদ ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, “সরকার এ খাতে বিভিন্ন পরিকল্পনা নিচ্ছে যেন পাটকে আরও সামনে এগিয়ে নেওয়া যায়। পাটকল গুলোকে নতুন আঙ্গিকে যেন আরও কার্যকর করা যায় যে চেষ্টা করা হচ্ছে।”
সরকার পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) দিকে এগোচ্ছে কীনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এটা পাবলিকলিই করা হবে। যে সরকারি পাটকলগুলো ২০২০ সালের মার্চে বন্ধ হয়েছে সেগুলো আবার চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। সকল পরিকল্পনা খুব দ্রুত বাস্তবায়ন হবে।”
প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের ৩০ জুন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের আওতায় শ্রমিকদের অবসরে পাঠিয়ে বন্ধ করে দেয় রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫টি পাটকল। যা কার্যকর হয়েছে সে বছরেরই পহেলা জুলাই থেকে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে