চেয়ারম্যান নিয়োগ নিয়ে সমালোচনার মুখে সরকার, অচলাবস্থায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার তিনমাসের মাথায় পদত্যাগ করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদসহ সব সদস্য। এতে স্থবির হয়ে গেছে সংস্থাটির কার্যক্রম। তবে নতুন কমিশন গঠন এবং এর কার্যকর ব্যবহারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আপাত উদাসীনতায় উদ্বিগ্ন মানবাধিকারকর্মী এবং সাধারণ মানুষ। ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব সম্পর্কে অন্ধকারে কমিশন সচিবালয়ের কর্মীরাও।
উপ-পরিচালক এবং চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ফারহানা সায়েদ জানান, প্রশাসনিক দায়িত্ব তত্ত্বাবধানে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন কমিশনের সচিব সেবাস্টিন রেমা।
মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাধীনতার পর থেকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ করেছে দেশ, যা অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ন্যায়সঙ্গত সমাজের সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষায় উজ্জীবিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির কেন্দ্রবিন্দু এবং মানবাধিকার রক্ষায় সরকারকে দায়বদ্ধ রাখতে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হতে পারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশের মাধ্যমে ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর কমিশন প্রতিষ্ঠা করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। অধ্যাদেশটি ২০০৯ সালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইনে প্রতিস্থাপিত হয়ে মানবাধিকার প্রচার এবং সুরক্ষার জাতীয় অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান হিসাবে সংস্থাটিকে পুনর্গঠন করে।
অধ্যাদেশের অধীনে প্রথম চেয়ারম্যান প্রয়াত বিচারপতি আমিরুল কবির চৌধুরী আইন প্রণয়নে মুখ্য ভূমিকা পালন এবং আইনি কাঠামোর ভিত্তি স্থাপন করেন। তবে আইনের অধীনে নিয়োগ না হওয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক ওয়েবসাইট থেকে তার নাম বাদ দেয়া হয়েছে।
আইনটি কার্যকর হওয়ার পর অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান প্রথম চেয়ারম্যান হয়ে দুই মেয়াদে ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তার স্থলাভিষিক্ত আমলা কাজী রিয়াজুল হক ২০১৬-১৯ মেয়াদে, নাসিমা বেগম ২০১৯-২২ মেয়াদে এবং ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ ২০২২ থেকে পদত্যাগের আগ পর্যন্ত চেয়ারম্যান ছিলেন। তারা প্রাক্তন বেসামরিক কর্মকর্তাদের পরিবর্তে মানবাধিকারকর্মী বা আইনি পেশাদারদের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগে সরকারের কৌশল বদলের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
প্রাক্তন চেয়ারম্যানদের মধ্যে ড. মিজানুর রহমান মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে সোচ্চার হয়ে গণমাধ্যমের উল্লেখযোগ্য মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন। যদিও সীমিত প্রভাবের কারণে তার নেতৃত্বাধীন কমিশনকে ‘দন্তহীন সিংহ’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন সমালোচকরা।
কাজী রিয়াজুল হক কমিশন সচিবালয় স্থানান্তরের তত্ত্বাবধান এবং এর অভ্যন্তরীণ কাঠামোর উন্নতি করেন। নতুন কার্যালয়ে নিশ্চিত করেন আরও ভালো মানবাধিকার অনুশীলনও।
গণমাধ্যমের নিম্নমুখী মনোযোগ পাওয়ায় সমালোচিত হলেও কমিশনের কার্যকারিতা বাড়িয়েছেন পরবর্তী চেয়ারম্যান নাসিমা বেগম। তিনি কার্যকরী অভিযোগ ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা এবং জেলা-পর্যায়ের কমিটি প্রবর্তন করেছিলেন। তবে এই ব্যবস্থাগুলো সরকার-নিয়ন্ত্রিত জেলা প্রশাসনে নির্ভরশীল হওয়ায় সমালোচনাও হয়েছিল।
ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ মানবাধিকার মামলার তদন্তে কমিশন কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত করায় দিকে মনোনিবেশ এবং পদত্যাগের আগে সাংবিধানিক ও নির্বাচনী সংস্কারের প্রস্তাব তৈরি করছিলেন।
দীর্ঘদিন ধরে কমিশনের নেতৃত্বে আমলাদের নিয়োগে সরকারের সমালোচনামুখর মানবাধিকারকর্মীরা। তাদের যুক্তি, সরকার-সংযুক্ত পটভূমি চেয়ারম্যান বা সদস্যদের স্বাধীনতাকে সীমিত করে। তবে কেউ কেউ যুক্তি দিচ্ছেন, অতীতে তাদের প্রশাসনিক দক্ষতা কমিশনকে উপকৃত করেছে।
কমিশনের কণ্ঠস্বরকে ‘বাধা’ দেয়ায় সরকারের সমালোচনা করেছেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলীও। সংস্থাটি যেন কার্যকর এবং স্বাধীনভাবে কাজ করে, তা নিশ্চিতে আইনি দক্ষতা বা তৃণমূল মানবাধিকারের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নেতাদের প্রয়োজনীয়তায় জোর দেন তিনি।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারপার্সন নিয়োগে আমলাদের প্রাধান্য দেয়াকে প্রতিবেশী দেশগুলোর অনুশীলনের সাথে বাংলাদেশের বৈপরীত্যেরও প্রমাণ বলেও অভিযোগ মানবাধিকারকর্মীদের।
ভারতে মানবাধিকার কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন বিজয়া ভারতী সায়ানি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। নেপালে শীর্ষ নেতৃত্বে থাকা বাহাদুর মাগার সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি। শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপেও সংস্থার নেতৃত্বে আছেন মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ এবং আইন পেশাজীবীরা। বাংলাদেশের মতো পাকিস্তানও এর আগে আমলাদের নিয়োগ করেছিল। তবে এর বর্তমান চেয়ারপারসন রাবিয়া জাভেরি আগা প্রখ্যাত মানবাধিকার আইনজীবী। ভুটানই দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ, যেখানে মানবাধিকার কমিশন নেই।
এদিকে বিদায়ী কমিশন নেতৃত্বের পদত্যাগের পর নতুন সদস্যদের নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং অন্তর্ভুক্তিকে অগ্রাধিকার দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে নেতৃস্থানীয় অধিকারভিত্তিক এনজিওগুলোর জোট মানবাধিকার ফোরাম৷ কমিশন আইনে নির্ধারিত নিয়োগ চূড়ান্ত করার আগে সুশীল সমাজের সাথে অংশগ্রহণমূলক আলোচনারও সুপারিশ করেছে তারা।
কমিশনের স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা বাড়াতে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন মোকাবেলায় আরও কার্যকরভাবে কাজে সক্ষম করতে ২০০৯ সালে প্রণীত আইনটির সংশোধনও চায় ফোরাম।
মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংস্থাটির চলমান অচলাবস্থা কৌশলগত সংস্কার এবং দূরদর্শী নেতৃত্বের জরুরি প্রয়োজনকেই তুলে ধরে। অভিজ্ঞ মানবাধিকার আইনজীবী বা আইন পেশাজীবী নিয়োগের মাধ্যমে কমিশনের প্রতি জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে পারে সরকার। এটিও নিশ্চিত করতে পারে যে, সবার জন্য মানবাধিকার রক্ষা ও প্রচারের ম্যান্ডেট পূরণ করছে রাষ্ট্রীয় সংস্থাটি।
‘দেশ এখন অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ন্যায়সঙ্গত সমাজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চায়। তাই সঠিক নেতৃত্ব এবং আইনি কাঠামোর সাথে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ক্ষমতায়ন এক্ষেত্রে অপরিহার্য’- বলছেন সংশ্লিষ্টরাও।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে