ব্যাংকিং খাতে নৈতিকতা চর্চার বিকল্প নেই
অর্থনীতিবিদ হিসেবে সব সময়ই আমি শুধু তত্ত্ব চর্চায় আটকে না থেকে গুণমুখী উন্নয়ন চিন্তাগুলো মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নে যুক্ত থাকতে সচেষ্ট হয়েছি। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নকেই সব সময় আমার গবেষণার কেন্দ্রে রেখেছি। গণমানুষের কল্যাণে অর্থনীতি চর্চাকে প্রাসঙ্গিক করার সুযোগ সবার জীবনে আসে না। তবুও সব সময়ই আগ্রহ ছিল নীতিনির্ধারণের সুযোগ পেলে এই গবেষণার অভিজ্ঞতাগুলো বাস্তবে কাজে লাগাব। ১৯৯০-এর দশকের একেবারে শেষদিকে একবার সুযোগ এসেছিল জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময়। প্রায় দুবছর সময় পেয়েছিলাম ‘জনতা ব্যাংক জনতার ব্যাংক’ স্লোগানের আলোকে ‘ঘরে ঘরে জনতা ব্যাংক’ এবং কৃষক ও খুদে উদ্যোক্তাদের জন্য আর্থিক লেনদেনের সুযোগকে অবারিত করার। পাশাপাশি ব্যাংক সেবাকে আরও গণমানুষের কাছাকাছি নেওয়ার জন্য ডিজিটাল প্রযুক্তি ও ইন্টার্নশিপ ব্যবস্থা চালু করে তরুণদের যুক্ত করতে সচেষ্ট হই। সে সময় ওই ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীসহ সব ব্যাংকারই যেভাবে এগিয়ে এসেছিলেন অংশগ্রহণমূলক ও মানবিক ব্যাংকিং চালু করতে তা এক কথায় ছিল অনন্য। তাই ব্যাংকটি সব সূচকেই বাংলাদেশের এক নম্বর ব্যাংকে পরিণত হতে পেরেছিল।
এই অভিজ্ঞতা আমাকে খানিকটা আত্মপ্রত্যয়ী হতে উৎসাহ জুগিয়েছিল বটে। অপেক্ষায় ছিলাম আর্থিক খাতের রূপান্তরের নয়া সুযোগের জন্য। ২০০৯ সালে হঠাৎ করেই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর সে সুযোগ এলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরে সমাজ ও অর্থনীতি পরিবর্তনের যে অসীম ক্ষমতা রয়েছে তা বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। ভেতরে গিয়ে বুঝতে পারলাম শুধু আর্থিক নীতিনির্ধারণ, বাস্তবায়ন এবং তত্ত্বাবধায়নই নয়, ইচ্ছে করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে নৈতিক জোর আছে তা ঠিকমতো ব্যবহার করা গেলে সত্যি দিন বদলও সম্ভব। আর এই প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে ভালো দিকটি হলো তার অপেক্ষাকৃত তরুণ ও মেধাবী জনশক্তি। তাদের ঠিকমতো অনুপ্রাণিত করতে পারলে যে তারা অসাধ্য সাধন করতে পারে তা আমি কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝতে পেরেছিলাম। তাই তাদের অফুরন্ত প্রাণশক্তি ব্যবহারে আমি দ্রুতই তৎপর হয়েছিলাম।
যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব পেলাম তখন চলছিল বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট। কী করে এই সংকট মোকাবিলা করা যায় সে বিষয়ে তো দুশ্চিন্তা ছিলই। আমাদের মতো দেশের প্রকৃত অর্থনীতি তথা কৃষি, শিল্প এবং ছোটখাটো উদ্যোগের দিকে বিশেষ নীতি মনোযোগের প্রয়োজন খুব করে অনুভব করলাম। আর ভাবলাম নতুন সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার প্রত্যয়ের সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করবে কী করে সমাজের নিচের দিকে অর্থ প্রবাহ করা যায় তার ওপর। আর অর্থায়নের এই ধারার প্রবাহে ডিজিটাল প্রযুক্তি যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে সে কথাটিও মনে বাজছিল। বিশেষ করে প্রত্যেক মানুষের কাছেই তদ্দিনে মোবাইল ফোন পৌঁছে গেছে। হয়তো সবাই স্মার্টফোন ব্যবহার করছিলেন না। কিন্তু একটু চেষ্টা করলেই কম দামের সাধারণ মোবাইলকেও বিশেষ কোড প্রদান করে আর্থিক লেনদেনের কাজে যে ব্যবহার করা সম্ভব সে কথাটিও জানতে পারলাম। সেই জানা থেকেই ২০১১ সালে মোবাইল আর্থিক সেবার গাইডলাইন চালু করলাম। এই গাইডলাইনের আলোকেই গড়ে উঠল রকেট ও বিকাশের মতো মোবাইল আর্থিক সেবা অপারেটর। পরে আরও কয়েকটি অপারেটর গড়ে উঠেছে। এই সেবার মাধ্যমেই এ দেশের প্রান্তজনের কাছে আর্থিক লেনদেন সহজলভ্য হয়ে ওঠে।
যে ভিখারি বা রিকশাওয়ালা কোনোদিন ব্যাংকে ঢোকার কথা স্বপ্নেও ভাবেননি তিনিও এখন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের স্বাদ পাচ্ছেন। বিপদে-আপদে আর্থিক লেনদেনের সুযোগ পাচ্ছেন। ছোটখাটো ব্যবসা-বাণিজ্য যারা করছেন তারা সর্বক্ষণ এই নয়া ধারার অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক সেবা পাচ্ছেন। এদের জন্য এখন বাংলা কিউ আর (কুইক রেসপন্স) ব্যবস্থা চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্যাশলেস ডিজিটাল আর্থিক সেবার নয়াদিগন্ত উন্মোচন করেছে। ব্যাংকের সঙ্গে অংশীদারত্ব গড়ে তুলে বিকাশ ন্যানো ক্রেডিট, প্রবাসী আয় লেনদেন, লাখ লাখ নারীকে সঞ্চয় সুবিধা প্রদানসহ অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নের নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে কোভিড-১৯ এর সংকটকালে এই ডিজিটাল আর্থিক সেবা মানুষের জীবনচলায় যে কী পরিমাণ সহায়তা করেছে তা ভাবতেই অবাক লাগে। একই সঙ্গে এই অর্থায়ন চালু থাকায় লাখ লাখ ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা ঘরে বসেই ব্যবসা-বাণিজ্যের যে সুযোগ পেয়েছেন তা এক কথায় অভাবনীয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ব্যাংকিং খাত নিশ্চয় এর জন্য ধন্যবাদ পেতেই পারে। নিঃসন্দেহে সমাজের পিরামিডের নিচের তলার মানুষের কাছে অর্থ লেনদেনের সুযোগ অবারিত করার তাদের প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাতেই হয়।
তার মানে এই নয় যে, ব্যাংকিং খাতে কোনো অসঙ্গতি ও অনাচার নেই। ঋণখেলাপি, ওভার ইনভয়েসিং, আন্ডার ইনভয়েসিং এবং অর্থপাচারের মতো সমস্যা ব্যাংকিং খাতে আগেও ছিল, এখনো আছে। নেতিবাচক এসব দুষ্টু গ্রহ থেকে ব্যাংকিং খাতকে মুক্ত করার জন্য এই খাতের মনোজগতের পরিবর্তন ছিল অপরিহার্য। সেই ভাবনা থেকেই এই খাতের জনসম্পদের মনোজগৎ বা মাইন্ডসেট পরিবর্তনের জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছিলাম কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। ব্যাংকিং খাত সমাজ ও সংস্কৃতির বাইরে নয়। বিশেষ করে সংস্কৃতির যে অংশটি মানবীয় বৈশিষ্ট্যের উৎকর্ষ সাধনের মধ্যে পড়ে সেদিকে নজর দেওয়াটা খুবই প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছিল আমার কাছে। তাই শুরু করেছিলাম কেন্দ্রীয় ব্যাংকারদের মনে জ্ঞান ও সাহিত্য ও নাট্যচর্চা এবং ক্রীড়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়ানোর প্রয়াসের মাধ্যমে। তাদের জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে স্বদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রভাব গেঁথে দেওয়ার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করি।
রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধুর জীবনের নানা ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তাদের পরিচিত করার সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টার দিকে নজর দিই। রবীন্দ্রনাথের দেড়শতম জন্মজয়ন্তীকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘রবীন্দ্রনাথ বাঙালির চিরসঙ্গী’ নামের চমৎকার একটি নান্দনিক স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করে। স্মারক মুদ্রা ও নোটও বের করে। দেশের প্রথিতযশা চারুকলা শিল্পীদের সঙ্গে নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য গুণমানের চিত্রকলা সংগ্রহ বৃদ্ধি, টাকা জাদুঘর নির্মাণ, টাকায় বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারকের ছবি প্রতিস্থাপনসহ অসংখ্য উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর ফলে ধীরে ধীরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকারদের মনে সুকুমার বৃত্তির প্রতি আকর্ষণ বাড়তে থাকে এবং এ দেশের বঞ্চিতজনের প্রতি তাদের দরদ বাড়তে থাকে। তারা প্রায়ই গ্রামগঞ্জে মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার সঙ্গে নিজেদের জড়াতে থাকেন। আমিও প্রায়ই তাদের নিয়ে গ্রামগঞ্জ চষে বেড়াতে থাকে। তাদের সামষ্টিক আচরণে চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন চোখে পড়তে থাকে।
একই সঙ্গে তাদের সংস্পর্শে আসা অন্য ব্যাংকারদেরও মনবদলের শুভসূচনা হতে থাকে। তারা মিলেমিশে সাধারণ মানুষের কল্যাণে ব্যাংকিং সেবাকে গ্রামগঞ্জে নেওয়ার জন্য ‘রোড শো’সহ নানা আয়োজন করতে থাকেন। এর মাধ্যমে তারা মানবিক ব্যাংকিংয়ের সূত্রপাত করেন। তারা সামাজিক দায়বদ্ধ নানা কার্যক্রম হাতে নিতে থাকেন। স্কুল শিক্ষার্থী, পথশিশু, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, কৃষক, শ্রমিক ও নারীদের সহজেই ব্যাংক হিসেবে প্রদান করে তারা মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিংয়ের এক নয়া অধ্যায়ের সূচনা করেন। বিশেষ করে কৃষক ও প্রান্তজনের জন্য দশ টাকার ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ করে দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মানবিক ব্যাংকিংয়ের এক নয়া অভিযাত্রাকে উৎসাহিত করে।
এমনি এক বাস্তবতায় দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সব অফিসে শুদ্ধাচার চর্চা চালু করার নির্দেশ প্রদান করেন। সরকারি অফিসগুলোর পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতেও শুদ্ধাচার চর্চা চালু করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে বিষয়টিকে আমি খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিই এবং বাংলাদেশ ব্যাংকসহ ব্যাংকিং খাতে শুদ্ধাচার বিষয়ে প্রচারণা ও নিয়মনীতি প্রয়োগের উদ্যোগ গ্রহণ করি। ইতোমধ্যেই আমরা মানবিক ব্যাংকিং গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছি। এর সঙ্গে শুদ্ধাচারের এই আহ্বান খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়েছিল আমার কাছে। কেননা ব্যাংকিংসহ পুরো আর্থিক সেবা খাতের টিকে থাকা এবং বিকাশের বিষয়গুলো বহুলাংশে নির্ভর করে এ খাতের গ্রাহকরা সেবাদানকারীদের ওপর কতটা আস্থা রাখতে পারছেন তার ওপর। আর আমার মনে হয়েছিল গ্রাহকদের মধ্যে আস্থার জায়গাটি মজবুত করার একটি খুবই কার্যকর উপায় হতে পারে ব্যাংকসহ আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে শুদ্ধাচার অনুশীলনের বিষয়টি আনুষ্ঠানিক রূপ দেওয়া এবং সেখানে ধীরে হলেও একটি শুদ্ধাচারের সংস্কৃতি গড়ে তোলা।
একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে যে গ্রাহকরা রয়েছেন তাদের কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম। কিন্তু সামাজিক পিরামিডের পাটাতনে থাকা মানুষদের মধ্যে দেশের আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং সেবা নিয়ে নানারকম ভয়-দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। ব্যাংকিং খাতে নৈতিকতার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করার জন্য শুদ্ধাচারের সংস্কৃতি গড়ে তুলে সে বার্তাটি তাদের কাছে নিয়ে যেতে পারলে তাদের এ ভয়-দ্বিধা বহুলাংশে কাটানো সম্ভব বলে আমার মনে হয়েছিল।
ড. আতিউর রহমান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে