ক্রীড়াঙ্গনে ব্যবস্থাপনায় পেশাদারিত্বের বিকল্প নেই
ক্রীড়াঙ্গনে পেশাদারিত্বের বিকল্প নেই। আর এটি সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ক্রীড়াঙ্গনে নৈপুণ্য প্রদর্শনের ক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব সব সময় এগিয়ে রাখে। দেশের ক্রীড়াঙ্গন সব সময় ধুঁকছে ব্যবস্থাপনায় অপেশাদারিত্ব কার্যকলাপ এবং পরিষেবার দুর্বলতার জন্য। একটি সময় ছিল, যখন বইয়ের পাতায় শুধু পেশাদারিত্বের আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকত। বাস্তবতায় এর প্রয়োগ ছিল ক্রীড়াঙ্গনে খুব কম। সময়ের পালা বদলে ক্রীড়াঙ্গন এখন ভীষণভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। উৎকর্ষতার পেছনে ছুটতে হলে, ক্রীড়াঙ্গন ভালোভাবে পরিচালনা করতে হলে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পেশাদারি মোড়কে মোড়ানো ব্যবস্থাপনা।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ নারী ফুটবলে যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে (এটির পরিসমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে বলা যাবে না) এর পেছনে আছে সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা। বিষয়টিকে যদি শুরু থেকে সঠিকভাবে ‘হ্যান্ডেল’ করা হতো, তাহলে পরিস্থিতির এত অবনতি ঘটত না। নারী ফুটবল চত্বর অশান্ত হওয়ার পাশাপাশি এত আলোচনা এবং সমালোচনার জন্ম হতো না। নারী ফুটবলাররা আমাদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। ওরা খুলে দিয়েছে আমাদের তৃতীয় নয়ন। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক মিডিয়া অনেক সময় সুস্থ ব্যবস্থাপনায় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। কারণ হলো বিভিন্ন ধরনের দুর্বলতা। দেশের মিডিয়া অদ্ভুত একটি সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারছে না।
সদ্য সমাপ্ত টি-টোয়েন্টি বিপিএলে বিদেশি ভালো খেলোয়াড় না থাকা সত্ত্বেও ক্রিকেট উৎসব কিন্তু জমজমাট হয়েছে। সব ভেন্যুতে উইকেট প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ভালো থাকাতে প্রতিটি ম্যাচে রান উপভোগ করেছেন ক্রিকেট প্রেমিকরা। অথচ মাঠের বাইরে কত কেলেঙ্কারি আর নাটক। দেশি এবং বিদেশি খেলোয়াড়দের চুক্তি অনুযায়ী পরিশ্রমিক পরিশোধ নিয়ে হৈ চৈ। পারিশ্রমিক পরিশোধ না করাতে বিদেশি খেলোয়াড়রা খেলতে নামেননি। এ সব ন্যক্কারজনক কার্যকলাপ পুরো ক্রিকেট দুনিয়া কম বেশি জেনেছে। ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালকদের অজ্ঞতা, দূরদর্শিতার অভাব, সাংগঠনিক কার্যকলাপে অনভ্যস্ততা এবং সর্বোপরি বোর্ডের ক্রিকেট ব্যবস্থাপনায় পদে পদে ‘ল্যাপস’ পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে গেছে।
সাংগঠনিক দক্ষতার ক্ষেত্রে দুর্বলতা এবং উদ্যোক্তা সুলভ গুণাবলির অভাব দেশের ক্রীড়াঙ্গনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এটি বার বার লক্ষণীয় হচ্ছে। স্বাধীনতার পর পাঁচ যুগের বেশি সময় অতিক্রম করার পরও এই ক্ষেত্রে অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক নয়। ক্রীড়াঙ্গনের সব মানুষ এক আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ক্রীড়াঙ্গনকে গড়ে তোলা। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় আমরা সেই আদর্শ থেকে এখনো অনেক দূরে। ক্রীড়াঙ্গনে জাতির প্রত্যাশা অনুযায়ী সঠিক সময়ে, সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি, এটি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দুর্বলতার জন্যই! ক্রীড়াঙ্গনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য আর নীতিকে ধারণ করাটা সংগঠকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যেটা মানুষকে বড় করে সেটা হলো স্বপ্ন, আমাদের ভেতরের ইচ্ছা এটা মনে রাখতে হবে। এই ক্ষেত্রে দেশের ক্রীড়া ম্যানেজমেন্ট এখনো প্রস্তুত হতে পারেনি। লক্ষ্য থেকে বারবার ‘বিচ্যুত’ হবার খেলাকে সংগঠকরা সব সময় পোষণ করছেন।
এটি তো ঠিক মানুষ মাত্রই উদ্যোক্তা, উদ্যোক্তা বিকাশের জন্য সহযোগিতা প্রয়োজন। আর এই সহযোগিতা এবং পাশে দাঁড়ানোর জন্য সহযোগিতার প্রয়োজন। আর এই সহযোগিতা এবং পাশে দাঁড়ানোর অভাব ছিল ক্রীড়াঙ্গনে। সব সময় বলা হয় ক্রীড়াঙ্গনকে বদলাতে হবে। তাহলে প্রথমে ইতিহাসের ধারা বদলে দেয়ার জন্য মতো উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা ক্রীড়াঙ্গনে সংস্কার চাচ্ছি, সবচেয়ে বড় সংস্কার হলো বিবেকের সংস্কার। ক্রীড়া সংগঠক মানুষদের উদ্যোগে উদ্যোম আমরা কতটুকু দেখার সুযোগ পেয়েছি? একত্ববাদিতা এবং ক্রীড়াঙ্গনে গণতন্ত্রীহীন অবস্থা বছরের পর বছর ধরে অনেককে তো কাছে ভিড়তে দেয়নি, তারা সংগঠক হিসেবে কীভাবে উদ্যোগী হবে!
ক্রীড়াঙ্গন অসঙ্গতিতে ভরপুর। নীতি নৈতিকতা তো শুধু কথার কথা নয়। ক্রীড়াঙ্গনে শূন্য সমস্যা হলো নেতৃত্বের অভাব। এই সমস্যার সমাধান ক্রীড়াঙ্গনের মানুষ নিজেদেরই করতে হবে। নতুন সময়ে ক্রীড়াঙ্গন বদলে যাবে এই আশা নিয়ে বসে থাকলে চলবে না, সবাই ঐক্যবদ্ধ না হতে পারলে ক্রীড়াঙ্গন এক নায়কতন্ত্র এবং কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থাপনা থেকে মুক্ত হতে পারবে না। আমাদের ক্রীড়াঙ্গনে প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট পথ নকশা। আর এটি অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারবে।
ক্রীড়াঙ্গনে স্বার্থান্বেষী নীতি নৈতিকতাহীন সংগঠকরা বছরের পর বছর ধরে খেলোয়াড় ও ক্রীড়াবিদদের অমিত সম্ভাবনা এবং সাধনাকে জলাঞ্জলি দিয়ে এসেছেন। সেই দুঃসময়ের অবসান ঘটাতে বাংলাদেশ জেগেছে। ক্রীড়াঙ্গনে ব্যক্তি এবং সম্মিলিত উদ্যোগকে আর বন্যার পানির মতো ভেসে যেতে দেওয়া উচিত নয়। গণতন্ত্রহীনতা, মর্যাদাহীনতা এবং সুশাসনের অভাবে ক্রীড়াঙ্গনে আবার ফিরে যাবার চিন্তা পুরোপুরি পরিহার করতে হবে। বিশ্বায়নের যুগে যারা পৃথিবীর ক্রীড়াঙ্গন তর তর করে এগিয়ে চলেছে ঠিক এই সময় আমরা কেনো ক্রীড়াঙ্গনে মধ্যযুগের চিন্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকব!
দেশের ক্রীড়াঙ্গন চলছে লক্ষ্যহীনভাবে। ক্রীড়াঙ্গনের জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করা সবচেয়ে জরুরি। কেননা এটা লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে। অনেক সময় আমরা আকাঙ্ক্ষা এবং স্বপ্নকে লক্ষ্যের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলি। লক্ষ্য হচ্ছে স্বপ্নকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এবং একটি কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়িত করা। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন চলছে গতানুগতিক ধারায়। তিপান্ন বছর পার হয়ে গেছে, আর কত বছর এই অবস্থার মধ্যে আমরা থাকব? পরিবর্তনকে আলিঙ্গন করার এখনি সময়। পরিস্থিতি বদলাতে হলে পরিকল্পনা চাই। আমাদের কোনো পরিকল্পনা নেই। অপ্রিয় শোনালেও সত্যি যে দেশের ক্রীড়াঙ্গন যেভাবে চলছে, এই অবস্থায় ভবিষ্যতেও যুগোপযোগী টেকসই উন্নতি অনিশ্চিত।
ক্রীড়াঙ্গনের সর্বস্তরে মূল্যায়ন বিষয়টি গুরুত্ব পায় না। প্রকৃত অবস্থা বুঝতে হলে নিজকে বুঝতে হবে চিন্তে হবে। অবাস্তব সব চিন্তা-ভাবনার জালে ক্রীড়াঙ্গন এখন আটকে আছে। সব কিছু বুঝেও ‘পাবলিকের’ সঙ্গে প্রতারণার খেলা পরিত্যাগ করা উচিত। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে টাইগারদের দৌড় কতটুকু এটা তারা আগেই জানত অযথা মানুষকে ধোঁকা দিয়ে কি কোনো লাভ হয়েছে। বরং এতে হতাশার পাল্লা আরো ভারী হয়েছে। দেশের খেলায় ক্রিকেটারদের দায়বদ্ধতা এবং দায়িত্বশীল আচরণ নিয়ে কথা উঠেছে। পেশাদারিত্বের জগতে হঠকারিতার কোনো স্থান নেই। এই ক্ষেত্রে সামর্থ্যতা, স্বচ্ছতা এবং ইতিবাচক মানসিকতায় একমাত্র কাম্য। ক্রীড়াঙ্গনের নেতৃত্বে প্রয়োজন পেশাদারী উদ্যোমী ক্রীড়া সংগঠক। এটি সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। এ ছাড়া আলোর মুখ দেখা মুশকিল হবে।
ইকরামউজ্জমান: কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে