৫৩ বছরেও সম্পন্ন হয়নি ক্যান্সার রোগীদের নিবন্ধিত করার প্রক্রিয়া
দেশ স্বাধীন হবার পরে ৫৩ বছর অতিবাহিত হলেও, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীদের সরকারিভাবে নিবন্ধিত করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি। ২০২০ সাল থেকেই এই প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য সফটওয়্যার নির্মাণের কথা আলোচনাতে এলেও ২০২৫ এসেও এ ব্যাপারে অগ্রগতির বিষয়ে নতুন কিছু জানা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা এর কারণ হিসেবে যথাযথ নেতৃত্বের অভাব, দলীয়করণ এবং সরকারের উদাসীনতাকেই দায়ী করছেন।
ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্যান্সার প্রতিরোধ বা প্রতিকারে যে কোনো পদক্ষেপ নিতে হলে সর্বপ্রথম দরকার হলো একটি গ্রহণযোগ্য নিবন্ধন, যার আওতায় ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের নামের তালিকা, রোগের ধরন, চিকিৎসা প্রক্রিয়ার বিস্তারিত এবং মৃত্যুসহ অন্যান্য সব বিষয় লিপিবদ্ধ থাকবে; কিন্তু আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো নিবন্ধন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা যায়নি। পাশাপাশি ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে এলাকাভিত্তিক কোনো জরিপও এখন পর্যন্ত করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক ক্যান্সার হাসপাতালের প্রকল্প সমন্বয়কারী ও ক্যান্সার প্রতিরোধ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসাকিন বলেন, ‘আমার ৩০ বছরের অভিজ্ঞতায় ক্যান্সার প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনায় আমি তিনটি জায়গায় অমার্জনীয় গাফলতি দেখতে পেয়েছি। এর প্রথমটাই হলো ক্যান্সার রোগীর নিবন্ধন। যেহেতু আপনি নিবন্ধন প্রক্রিয়া ঠিক করেননি, এর হাত ধরে এসেছে নিয়মিত ক্যান্সার স্ক্রিনিং ব্যবস্থা না থাকা। আর এ কারণেই প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করাও সম্ভব হয় না, ফলে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা এবং যন্ত্রপাতি সংরক্ষণ করে সেবা প্রদানেও ঘাটতি থেকে যায়।’
তিনি বলেন, একটি দেশে কোনো রোগের লোড (ব্যাপ্তি) কতো সেটা যদি জানা না থাকে তাহলে রোগ প্রতিরোধে কোনো পদক্ষেপই সফল করা যায় না। রোগীদেরও ভোগান্তি বাড়ে।
বাংলাদেশ ক্যান্সার ফাউন্ডেশনের সভাপতি ডা. রাসাকিন আরও বলেন, ‘ক্যান্সার রোগীদের তথ্য সংগ্রহ করার প্রক্রিয়া দুটি। একটি হলো হাসপাতালভিত্তিক নিবন্ধন এবং জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যান্সার নিবন্ধন। হাসপাতালভিত্তিক নিবন্ধন হাসপাতালে কতজন রোগী এসেছেন তার একটি অনুমান দেয়; কিন্তু প্রকৃত চিত্র প্রকাশ করে না। সে হিসাবে জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যান্সার নিবন্ধন অনেক বেশি কার্যকরী। জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যান্সার নিবন্ধন বলতে বোঝায় বাছাইকৃত এলাকায় মোট জনগণের কতজন ক্যান্সার আক্রান্ত তা বের করা।'
‘আমি বিভাগীয় প্রধান থাকাকালে ক্যান্সার হাসপাতালভিত্তিক একটি নিবন্ধন প্রক্রিয়া সচল রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি; কিন্তু ২০২২ সালে আমি দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার পরে সেটির আর কোনো তথ্য আজ অবধি প্রকাশ পায়নি। আমি দেখেছি ক্যান্সারের রোগীদের তথ্য সংরক্ষণে আমাদের সরকার বরাবরই উদাসীন।'
জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিংয়ের জন্য প্রায় ৫০০ ভায়া সেন্টার চালু আছে সরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের হাসপাতালে। বিএসএমএমইউর গাইনি বিভাগের উদ্যোগে সরকারের সহযোগিতায় পরিচালিত একটি প্রকল্পের আওতায় ৩০ থেকে ৬০ বছর বয়সী নারীরা এখানে তাদের জরায়ুমুখ ও স্তনের ক্যান্সার নির্ণয়ের প্রাথমিক চেকআপ করিয়ে নিতে পারছেন। তবে এই কর্মসূচি অসংগঠিত, অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, বর্তমানে ক্যান্সারের স্ক্রিনিং হচ্ছে মূলত হাসপাতালে। কেউ নিজে থেকে হাসপাতালে এলে তবে সেবা পায়। আবার অন্য রোগের চিকিৎসা নিতে এসেও অনেক সময় ক্যান্সার শনাক্ত হয়। এটা হলো অসংগঠিত ক্যান্সার স্ক্রিনিং। প্রায় বিশ বছরে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার পনেরো শতাংশের মতো নারীকে এর আওতায় আনা গেছে। এ জন্য সমাজভিত্তিক সংগঠিত স্ক্রিনিং কর্মসূচির বিকল্প নেই।
তিনি মনে করেন, সমাজের মানুষকে অবহিত ও উদ্বুদ্ধ করে তাদের স্ক্রিনিং সেন্টারে আনতে হবে। জাতীয়ভাবে ক্যান্সার স্ক্রিনিং কর্মসূচি প্রণীত ও পরিচালিত থাকলে এটা করা সম্ভব হতো বলে জানান ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের সাবেক এই অধ্যাপক।
‘বাংলাদেশে ক্যান্সারের বোঝা: জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যান্সার রেজিস্ট্রি’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরতে গিয়ে প্রধান গবেষক ও পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. খালেকুজ্জামান জানান, কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলায় ২০২৩ সালের জুলাই মাস থেকে শুরু হওয়া এ কর্মসূচিতে ২ লাখ মানুষের ওপর গবেষণা পরিচাল্না করা হয়।
তাদের তথ্য মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি এক লাখে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১০৬ জন। এ ছাড়া প্রতি বছর এ রোগে নতুন করে ৫৩ জন আক্রান্ত হচ্ছে। দেশে মোট মৃত্যুর ১২ শতাংশের জন্য দায়ী ক্যান্সার। গবেষণায় প্রাপ্ত ফলে দেখা গেছে, দেশে প্রাপ্ত ৩৮ ধরণের ক্যান্সারের মধে ৫টি প্রধান ক্যান্সার হলো স্তন, মুখ, পাকস্থলী, শ্বাসনালি এবং জরায়ু মুখের ক্যান্সার। পুরুষদের ৫টি প্রধান ক্যান্সার হলো শ্বাসনালি, পাকস্থলী, ফুসফুস, মুখ ও খাদ্যনালির ক্যান্সার। নারীদের ৫টি প্রধান ক্যান্সার হলো স্তন, জরায়ুমুখ, মুখ, থাইরয়েড এবং ওভারি।
পুরুষ ক্যান্সার রোগীদের ৭৫ দশমিক ৮ শতাংশ ধূমপায়ী এবং ধোঁয়াহীন পান, জর্দ্দা, তামাক সেবনকারী ৪০ দশমিক ৫ শতাংশ। এতে আর বলা হয়, ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে ৬০ দশমিক ৬ শতাংশ নারী ধোঁয়াহীন পান, জর্দ্দা, তামাক সেবনকারী। ৪৬ শতাংশ রোগীর ক্যান্সারের সঙ্গেই তামাক সেবনের সম্পর্ক রয়েছে। ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ৬০ শতাংশ কম্বাইন্ড চিকিৎসা নিয়েছে এবং ৭ দশমিক ৪ শতাংশ রোগী কোনো চিকিৎসাই নেননি।
বিএসএমএমইউর এই গবেষণাকে সাধুবাদ জানালেও তিনি বলেন, ‘একে সর্বোচ্চ আমরা আনুমানিক হিসেব নিতে পারি। তবে তা এক উপজেলা কেন্দ্রিক হলে হবে না। যেটা করতে হবে তা হলো দেশের ৮টি বিভাগের উপজেলাগুলো নিয়ে এই জরিপ চালাতে হবে। একই সাথে প্রতিটি বিভাগে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিবন্ধন চালু রাখতে হবে। একই সঙ্গে প্রতি উপজেলায় দুজন ডাক্তারের নেতৃত্বে একটি টীম কাজ করবে যারা নতুন রোগী শনাক্তে কাজ করবেন এবং রোগের কাছে হার মানা রোগীদের নাম কর্তনেও কাজ করবেন।’
একাজে তিনি জাতীয় ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিল যা গত বারো বছরে পুরোপুরি অকার্যকর অবস্থায় আছে সেটাকে পুনরুজ্জীবিত ও পুনর্গঠিত করার কথা বলেন এবং একে কার্যকর রাখতে দলীয়করণ ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থেকে মুক্ত রাখার প্রতিও নজর দিতে বলেন। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক স্বপন কুমার বলেন, দেশে নতুন রোগী বিশেষত তিনটি প্রধান ক্যান্সার (স্তন, জরায়ুমুখ, মুখগহ্বর) স্ক্রিনিং এর জন্য জাতীয় ক্যান্সার স্ক্রিনিং কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে এবং তা বাস্তবায়নে সরকার, পেশাজীবী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, এনজিও সবাই মিলে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে।
এদিকে যোগাযোগ করা হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘আমি আগেই জানিয়েছি চলতি বছরে মধ্যেই দেশে আরও চারটি ক্যান্সার হাসপাতাল চালু করার চেষ্টা অব্যাহত আছে। একই সঙ্গে ক্যান্সার হাসপাতালসহ অন্যান্য হাসপাতালগুলোতেও রোগীদের জন্য দরকারি যন্ত্রপাতি দ্রুত আমদানি করার ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে।’ এ ছাড়া টেকসই জাতীয় ক্যান্সার নিবন্ধন নিশ্চিতে ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে এবং তা অনলাইনভিত্তিক করতে কাজও চলছে বলে জানান তিনি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে