সড়ক প্রশস্ত করে কোনো দেশ দুর্ঘটনা কমাতে পারেনি
সড়ক দুর্ঘটনা একটি জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, সড়কে যে অসুখ তা পুরোপুরি টেকনিক্যাল অসুখ নয়’ এটা অনেকটাই রাজনৈতিক। পরিবহন খাতের অনেক নেতারই সরকারের সঙ্গে সখ্য থাকায় অনেকেরই ধারণা পরিবহন সিন্ডিকেট কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। যেহেতু সরকার চাচ্ছে দুর্ঘটনা কমে আসুক, তাই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে পরিবহন সিন্ডিকেট অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। কারণ যারা পরিবহন খাত নিয়ন্ত্রণ করছেন তারা নিশ্চয়ই সরকারের চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান নন। সরকার এত বড় বড় সড়ক অবকাঠামো বাস্তবায়ন করেছেন মূলত পরিবহন খাতের উন্নয়নের জন্যই; কিন্তু সেই সড়কে যদি দুর্ঘটনা বেড়ে যায়, তাহলে অবকাঠামো নির্মাণের উদ্দেশ্য অনেকটাই ম্লান হয়ে যায়। সরকার সড়কের উন্নয়নে এতকিছু করতে পারছেন আর দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারবেন না এটা আমি বিশ্বাস করি না।
প্রতি বছর সড়কে গড়ে প্রায় ৫ হাজার মানুষ নিহত হচ্ছেন। তথ্য অনুযায়ী আরও প্রায় ১২-১৪ হাজার মানুষ প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হচ্ছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই স্থায়ী পঙ্গুত্ব বরণ করছেন। বাংলাদেশ বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করছে। এটা নিয়ে নীতি নির্ধারকদের মধ্যে এক ধরনের আত্মতৃপ্তিও আছে। তবে দুঃখজনক যে, দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ সড়ক দুর্ঘটনায় অকালে ঝরে পড়ছে। অনেকের ধারণা, আমরা বহু সড়ক প্রশস্ত করেছি, উন্নতমানের এক্সপ্রেসওয়ে ও নতুন নতুন সড়ক-সেতু তৈরি করছি, কাজেই সড়ক দুর্ঘটনা এমনি এমনিই কমে যাবে বা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। সড়ক পরিবহন খাতে সুশাসন বা সঠিক ব্যবস্থাপনার বিষয়টি আমাদের দেশে তেমন একটা গুরুত্ব পাচ্ছে না; কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, শুধু সড়ক প্রশস্ত করে পৃথিবীর কোনো দেশ দুর্ঘটনা কমাতে পারেনি। এ জন্য দরকার সড়কের যানবাহনের সঠিক ব্যবস্থাপনা ও আইনের কঠোর প্রয়োগ। অন্যথায় সড়ক দুর্ঘটনা কোনোভাবেই সহনীয় মাত্রায় কমিয়ে আনা সম্ভব হবে না। যদিও আমরা সড়ক দুর্ঘটনার যে পরিসংখ্যান বিভিন্ন সূত্র থেকে পাচ্ছি, তা পূর্ণাঙ্গ তথ্য নয়। কারণ এর বাইরেও আরও অনেক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে যার পরিসংখ্যান আমাদের তথ্য ভান্ডারে আসছে না। এই অপূর্ণাঙ্গ তথ্যের ভিত্তিতেই আমরা দেখছি, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর যে আর্থিক ক্ষতি হয়, তার পরিমাণ কমপক্ষে ৪০ হাজার কোটি টাকা। জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে আমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার হার ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনব; কিন্তু সেই কমিটমেন্ট আমরা পূরণ করতে পারিনি। সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে। এখন ২০৩০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশ কমানোর জন্য আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ; কিন্তু আমরা দেখছি সড়ক দুর্ঘটনার প্রবণতা ঊর্ধ্বমুখী।
বিআরটিএ গত বছর থেকে সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান প্রকাশের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। বিশ্বব্যাপী সরকারি সংস্থাগুলোই সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান প্রণয়ন ও প্রকাশ করে থাকে। কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ ধরনের পরিসংখ্যান প্রকাশ করে না। আমাদের দেশে, এতদিন পরিবহন ও সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করে এমন বেশকিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান প্রকাশ করত। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে পরিসংখ্যান প্রণয়ন ও প্রকাশ করে থাকে; কিন্তু এক এক সংস্থা এক এক রকম পরিসংখ্যান দিয়ে থাকে। কেউ হয়তো বলছে, বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মোট পাঁচ হাজার লোক মারা গেছে। আবার কোনো সংস্থা হয়তো বলছে, সাড়ে চার হাজার লোক মারা গেছে। এভাবে পরিসংখ্যানগত বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। বিভ্রান্তিকর পরিসংখ্যান ব্যবহার করে কখনোই কোনো সমস্যার সমাধান করা যায় না; কিন্তু সরকারি সংস্থা যদি এককভাবে এই দায়িত্ব পালন করে তাহলে তথ্যগত বিভ্রান্তিকর কোনো সুযোগ থাকে না। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বিআরটিএ সড়ক দুর্ঘটনার যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করবে তা সরকারি পরিসংখ্যান হিসেবেই বিবেচিত হবে। তাদের দেয়া পরিসংখ্যান ও তথ্যগুলো বৈজ্ঞানিক এবং পূর্ণাঙ্গ করার সুযোগ আছে।
বিআরটিএর দেয়া পরিসংখ্যানে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত এবং নিহতের সংখ্যা খুব কাছাকাছি। এটা পুরোপুরি বিজ্ঞানসম্মত নয়। কারণ বিভিন্ন গবেষণায় প্রতীয়মান হয়, সড়ক দুর্ঘটনায় যে সংখ্যক মানুষ নিহত হয় তার চেয়ে আহতের সংখ্যা ৮ থেকে ১০ গুন বেশি হয়ে থাকে। সে বিবেচনায় বিআরটিএর দেয়া সড়ক দুর্ঘটনায় আহত এবং নিহতের সংখ্যা কিছুটা ভারসাম্যহীন বলেই মনে হয়। বিআরটিএর আঞ্চলিক অফিসের তথ্যের সঙ্গে জেলা হাসপাতাল এবং থানার তথ্যের সমন্বয় প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে একজন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে যখন হাসপাতালে ভর্তি হন তারপর ন্যূনতম ২৮ দিন তাকে অনুসরণ করতে হয়। এর মধ্যে যদি লোকটি মারা যায় তাহলে তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের তালিকায় যুক্ত হবেন। অর্থাৎ সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হবার সঙ্গে সঙ্গে মারা না গেলেও তিনি মৃতের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন, যদি ঘটনার পর ২৮ দিনের মধ্যে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পাশাপাশি আমাদের দেশে ইন্স্যুরেন্সের যে ধারণা প্রচলিত আছে তা পুরোপুরি সঠিক নয়। আমরা মনে করি, ইন্স্যুরেন্স মানেই হচ্ছে ক্ষতিপূরণ পাওয়া। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোতে দুর্ঘটনায় জীবনহানির পরিসংখ্যানসহ সম্পত্তি ক্ষয়ক্ষতির তথ্যও থাকে। আসলে উন্নত ইন্স্যুরেন্স সিস্টেম দুর্ঘটনার তথ্য ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে। ইন্স্যুরেন্সে যে শাস্তি ব্যবস্থা থাকে তেমনি পুরস্কারের ব্যবস্থাও থাকে। যদি চালক নিরাপদে গাড়ি চালান তাহলে প্রতি বছর যে প্রিমিয়াম দিতে হয় তার পরিমাণ কমতে থাকে। আবার চালক যদি গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে প্রচলিত আইনের ব্যত্যয় ঘটান, তাহলে বছরান্তে তার প্রিমিয়ামের পরিমাণ বাড়তে থাকে। তাই বিআরটিএর দুর্ঘটনার তথ্য ভান্ডারের সঙ্গে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির তথ্যের সমন্বয় ঘটালে তা দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করবে।
গবেষণায় দেখা যায়, আমাদের ব্যক্তিগত এবং গণপরিবহনসহ যে পরিমাণে যানবাহন আছে তা প্রতিদিন গড়ে ২০ লাখ মানুষ ঢাকার বাইরে পরিবহনের সক্ষমতা রাখে। প্রতিদিন প্রায় ২০ লাখ মানুষ পরিবহনের ক্ষমতা থাকলেও অতিরিক্ত ১০ লাখ মানুষের ঢাকা ছাড়ার কোনো ধরনের বিকল্প উপায় থাকে না। তাই তারা অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রায় শামিল হয়। পাশাপাশি ঢাকা শহরে মোটরসাইকেল এখন অনেকটাই মিনি-গণপরিবহনে রূপ নিয়েছে। গণপরিবহনের সংকট এবং ভাড়া নৈরাজ্যের কারণে দূরপাল্লার যাত্রায় মোটরসাইকেলের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে এবং একই সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে। বিগত ঈদ বা এ ধরনের ধর্মীয় উৎসবের আগে-পরে যে যানবাহনগুলো সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে তার প্রায় ৪০ শতাংশই মোটরসাইকেল। এটা প্রমাণ করে যে, দীর্ঘযাত্রায় চালকের অনভিজ্ঞতা, অদক্ষতা এবং মোটরসাইকেল উপযোগী সড়ক অবকাঠামো না থাকায় মোটরসাইকেল যাত্রা সাধারণ গণপরিবহনের চেয়ে অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
সর্বোপরি আমাদের মনের রাখতে হবে, সড়ক দুর্ঘটনা কোনো একক কারণে সংঘটিত হয় না। বহুবিধ এবং সামষ্টিক কারণেই সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়ে থাকে। এর সঙ্গে অনেক প্রতিষ্ঠান যুক্ত। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতের লক্ষ্যে এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা বেশ জটিল এবং চ্যালেঞ্জিং। আমাদের সবার মধ্যেই একটি প্রবণতা দেখা যায় যে আমরা কেউই ‘দায়’ নিতে চাই না। এই দায়হীনতার যে সংস্কৃতি তা সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর জন্য বড় ধরনের একটি প্রতিবন্ধকতা। কোনো দুর্ঘটনা সংঘটিত হলে সড়কের নকশাগত কোনো ক্রটি বা জটিলতা আছে কি না, সেটা অনুসন্ধান এবং সংশ্লিষ্ট দায়ভার গ্রহণ করতে কেউ আগ্রহী না বা করতে চান না। রাস্তায় যেসব গাড়ি চলাচল করছে তার ফিটনেস সার্টিফিকেট যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দেয়া হয়েছে কি না, তার দায় কেউই নিতে চাচ্ছেন না।
আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ না করে অদক্ষ চালকের হাতে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার দায় কেউ নিচ্ছেন না। চালকদের বেপরোয়া মনোভাব নিয়ন্ত্রণে শ্রম আইন অনুযায়ী লিখিত নিয়োগপত্র ও বেতনভুক্ত করার ক্ষেত্রে পরিবহন মালিকদের কেন বাধ্য করা যাচ্ছে না, সেই বিষয়ে কেউ ব্যবস্থাও নিচ্ছেন না বা জবাবদিহিও করছেন না। মহাসড়কে ধীরগতির যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও সেগুলো যাদের ম্যানেজ করে চলছে তাদের প্রতি আইনানুগ ব্যবস্থা না নেয়ার যে দায়, সেটাও কেউ নিচ্ছেন না। দায় স্বীকার করার মধ্যে কোনো লজ্জা নেই। এটা পরাজিত হওয়ার বিষয়ও নয়। বরং দায় মাথায় নিয়ে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করে যদি এই নিরীহ জীবনগুলো রক্ষা করা যায়, তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। এক্ষেত্রে, যে যার দায়িত্ব তা যদি নির্মোহ ও সঠিকভাবে পালন করে, তাহলেই বিজ্ঞানসম্মতভাবে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব।
মো. হাদিউজ্জামান: অধ্যাপক, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)।
অনুলিখন: এম এ খালেক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে