পড়াশোনার সময় বিয়ে নয়
পড়াশোনা চলাকালীন মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাওয়াটা বাংলাদেশের এক করুণ ঐতিহ্যে রূপ নিয়েছে। শুধু অনার্স-মাস্টার্স না, এসএসসি, এইচএসসিতে পড়ার সময়ও মেয়েদের বিয়ে হওয়াটা একটা স্বাভাবিক রীতি হয়ে গেছে। পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে তা ছিল সেভেন-এইট পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। এক সময় বাংলাদেশে এমনো রীতি ছিল শুধু চিঠি লিখতে শিখতে পারলেই মেয়েদের বিয়ের তোরজোর লেগে যেত। এখন অবস্থা কিছুটা বদলেছে, তাও এটাকে খুব বেশি ইতিবাচক পরিবর্তন বলা যাবে না। এখনো প্রচুর বাল্যবিবাহ হচ্ছে দেশে।
গত সোমবার (২ সেপ্টেম্বর) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, পড়াশোনার বয়সেই বিয়ে করা শিক্ষায় ঝরে পড়ার বড় কারণ। গত ৫ জুন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) আর্থ-সামাজিক ও জনমিতি জরিপ-২০২৩-এর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার পেছনে ছয়টি মূল কারণ রয়েছে। সেগুলো হলো বিয়ে করা, কর্মে যুক্ত হয়ে যাওয়া, আর্থিক অসচ্ছলতা, পড়ালেখায় অনীহা, কাজ খোঁজা, করোনা মহামারির পর আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না ফেরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রায় ৪২ শতাংশ পড়াশোনা বন্ধ করেছেন বিয়ে করার কারণে। ঝরে পড়া মেয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ হার ৭১ শতাংশ। আর ছেলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩ শতাংশ। তবে, অনেক ছেলেও বিয়ের পর পড়াশোনা ছেড়ে দিচ্ছেন বলে জানিয়েছে প্রতিবেদনটি। পড়াশোনা শেষ না করেই এত অধিকসংখ্যক মেয়ের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বন্ধ করে দেয়া নিঃসন্দেহে আশঙ্কাজনক। এতে তার শিক্ষার পুরো সময়টা অনেকটা বিফলে যায়। দক্ষ জনশক্তি হিসেবে সে আর তৈরি হয় না।
লেখাপড়া শেষ না করিয়ে ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়ার পেছনে পরিবারগুলোর কিছু অদ্ভুত যুক্তি থাকে। মেয়েদের বেলায় এই যুক্তি থাকে পরবর্তীতে যদি ভালো ছেলে না পাওয়া যায়। পারিবারিক অসচ্ছলতাও এ ক্ষেত্রে দায়ী। অনেক দুষ্ট প্রকৃতির ছেলেকে ঘরে রাখতে পড়াশোনা চলাকালীন সময়ে তার বিয়ে দিয়ে দেয়ার যুক্তিও আছে। যুক্তি যেমনই থাক, পড়াশোনা সম্পন্ন করার আগ পর্যন্ত আসলে ছেলেমেয়ে যে-ই হোক, তার বিয়ে দেয়া উচিত না। এতে নারী-পুরুষের শিক্ষার যেমন একটা ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়, শ্রমবাজারেও এর বিপুল প্রভাব পড়ে। সবচেয়ে বড় বিষয়, লেখাপড়া শেষ না করে বিয়ে করলে সেই মেয়েটির পক্ষে স্বাবলম্বী হওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বিয়ের অনেক পরে মেয়েরা এটা বুঝতে পারেন, অনেক মেয়ে দেরি করে হলেও শিক্ষাজীবনে ফিরে আসেন, অনেকের পক্ষে আর ফিরে আসা সম্ভব হয় না। তাছাড়া যথাযথ শিক্ষার অভাবে ঝরে পড়া এসব ছেলেমেয়ের চিন্তা-ভাবনার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ঘটে না। গুণগত বিকাশ হয় না। সচেতনতা কম থাকে। নেতিবাচক প্রভাব-পরবর্তী প্রজন্মের ওপরও পড়ে।
আমরা চাই, এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগ আরও সচেতন ভূমিকা পালন করুক। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সচেতনতা বাড়ানো হোক। বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন থাকলেও এর ফাঁকিও কম নেই। সে ক্ষেত্রে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের বিকল্প নেই। একবিংশ শতাব্দীর সিকিভাগ পার হয়ে এসে বাল্যবিবাহের মতো প্রাচীন রীতি বাংলাদেশে থাকতে পারে না।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে