গাজার মানুষের জন্য এখন আর ঈদ বলতে কিছু নেই
গত ৭ এপ্রিল ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের ৬ মাস পূর্ণ হলো। অবশ্য একে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধও বলা যায় না, আবার দুপক্ষের যুদ্ধও বলা যায় না। শুধু যে হামাস একা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গাজায় সক্রিয় ছিল, তা নয়। হামাসের পাশাপাশি প্যালেস্টাইন ইসলামিক জিহাদ বা পিআইজিও ছিল এবং আছে। দ্বিতীয়ত, ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে হামাস একলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, প্রাণ গিয়েছে ৩৩ হাজার প্যালেস্টাইনের। সুতরাং যুদ্ধটি আসলে ইসরায়েল-গাজা। প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের যে অন্য একটি অংশ রয়েছে ওয়েস্ট ব্যাংক সেখানে ইসরায়েলের কড়া নজরদারি রয়েছে এবং সেই অংশ পরিচালনা করেন অপেক্ষাকৃত নরমপন্থি এবং পশ্চিমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকা মাহমুদ আব্বাস। তাকে মূলত প্যালেস্টাইন অথরিটির নামে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে পশ্চিমা সম্প্রদায়। আব্বাস নিজেও শান্তিপূর্ণ সমাধান চান। যা হোক, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।
এ যুদ্ধের নতুন ডেভেলপমেন্ট হলো, ৭ এপ্রিল ৬ মাস পূর্ণ হওয়ার দিনই দক্ষিণ গাজার খান ইউনুস এলাকা থেকে ইসরায়েল তার সৈন্যদের সরিয়ে নিয়েছে। গাজার খান ইউনুস থেকে সৈন্য সরিয়ে নিলেও বাকি জায়গায় ইসরায়েলের এক ব্রিগেড সৈন্য রয়ে যাবে। গত ৬ মাসে এই প্রথম ইসরায়েল যুদ্ধের ময়দান থেকে সৈন্য সরিয়ে নিল। এতে অবশ্য আনন্দিত হওয়ার মতো কোনো বিষয় নেই। সেখান থেকে সরে আসা মানে যুদ্ধ থেমে যাওয়া বা তীব্রতা কমে যাওয়া নয়। ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স বা আইটিএফের চিফ অব আর্মি স্টাফ হেরজি হাভেলি বলেছেন, ‘গাজা থেকে সৈন্য তুলে নেয়ার অর্থ এই নয় যে, যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে।’ ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট বলেছেন, গাজা থেকে সরে এসে ইসরায়েল রাফাসহ অন্যত্র ফলো আপ মিশনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিনি বলেছেন, ‘আমরা এমন একটি অবস্থায় উপনীত হয়েছি যে, গাজা এখন আর হামাসের নিয়ন্ত্রণে নেই। তারা এখন আর ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্য সামরিকভাবে গঠিত কোনো হুমকি নয়।’ ইসরায়েলের পক্ষ থেকে এও বলা হয়েছে, তারা নাকি বিশ্রাম নিতে ফিরে যাচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হলো, ঘটনা কি এতটুকুই? প্রত্যেক রাজনীতি ও যুদ্ধের মঞ্চের নেপথ্যে একটি গ্রিন রুম থাকে। ইসরায়েলের সৈন্য তুলে নেয়ার পেছনেও বেশ কয়েকটি ফ্যাক্টর কাজ করছে। সামনে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন। ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় ভরসাস্থল যুক্তরাষ্ট্র। বেশ কিছুকাল ধরেই প্রেসিডেন্ট বাইডেন জনগণের একটি বড় অংশের কাছ থেকে এবং ডেমোক্র্যাট দলীয় নেতাদের কাছ থেকে চাপে ছিলেন ইসরায়েলের অভিযান সমাপ্ত করা নিয়ে। তার মধ্যেই এপ্রিল মাসের শুরুতেই দাতব্য প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল কিচেনের ৭ জন কর্মী নিহত হলে গোটা পশ্চিমা বিশ্বে ইসরায়েলের অভিযানের বিরুদ্ধে চাপ বাড়তে থাকে। ওই প্রতিষ্ঠানের ৭ জনের মধ্যে তিনজন ব্রিটিশ, একজন অস্ট্রেলিয়ান একজন পোল্যান্ডের এবং একজন কানাডার নাগরিক ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকদের পাশাপাশি দেশটির মুসলিম সম্প্রদায়ের ভোটও আগামী নির্বাচনে ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই বাইডেন প্রশাসন ইতিমধ্যে ইসরায়েলকে এই বলে হুমকি দিয়েছে যে, ইসরায়েল নির্বিচারে অভিযান চালালে এবং বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু অব্যাহত থাকলে যুক্তরাষ্ট্র গাজানীতিতে পরিবর্তন আনতে পারে।
অন্যদিকে ১ এপ্রিল সিরিয়ায় ইরানী দূতাবাসে ইসরায়েলের হামলায় ইরানের ইসলামী রেভলিউশনারি গার্ডের সিনিয়র কর্মকর্তা এবং আল কুদুস বাহিনীর প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদিসহ সাতজন নিহত হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় ইরান প্রতিশোধ নেওয়ার শপথ গ্রহণ করে। ৫ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল একই সঙ্গে সতর্ক করে যে ইরান বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের বিভিন্ন ঘাঁটি, সম্পদে আঘাত করতে পারে এবং তা দু-এক সপ্তাহের মধ্যেই।
অন্য আরেকটি দিক হলো গোটা মুসলিম বিশ্বে রমজান মাস চলছে এবং এ সপ্তাহেই মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই সময়ে কোনোক্রমেই ইসরায়েল অভিযান চালিয়ে বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের হত্যার ঝুঁকি নিতে চাইছে না। কারণ, ইতিমধ্যেই শক্তিশালী কিছু মুসলিম দেশের সঙ্গে ইসরায়েলের যথেষ্ট সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। সেসব দেশের সরকার এবং জনগণ ঈদ উৎসবের মধ্যে কোনোক্রমেই মুসলিম কোনো সম্প্রদায়ের ওপর অভিযান ভালো চোখে দেখবে না। মিশরে ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইর প্রধান এবং ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদপ্রধান ডেভিড বার্নির মধ্যে একটি আলোচনা হয়েছে, যেখানে হামাসের প্রতিনিধিও ছিল বলে জানা গেছে। সেখানে একটি সাময়িক যুদ্ধ বিরতির কথা উঠে এসেছে। গত নভেম্বরেও একটি সাময়িক যুদ্ধ বিরতিতে ইসরায়েল ও হামাস সম্মতি দিয়েছিল। তখন দুদেশের মধ্যে শখানেক বন্দি বিনিময় হয়। উল্লেখ্য, এখনো হামাসের হাতে ১৩৩ ইসরায়েলি জিম্মি হিসেবে রয়েছে। এই ১৩৩ জনকে ছাড়িয়ে আনতে ব্যর্থ হওয়ায় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার দেশের অভ্যন্তরে প্রচণ্ড চাপে রয়েছেন। তেল-আবিবে হাজার হাজার মানুষ নেমে আসছে প্রতিদিন এবং প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর পদত্যাগের দাবিতে।
পরিস্থিতি যেদিকেই যাক, মূল বিষয় হলো, গাজার মানুষের জন্য এখন আর ঈদ বলতে কিছু নেই। কোনো শিশু পরবে না নতুন পোশাক। কারণ পোশাক তো দূরের কথা নিজেদের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। হাজার হাজার পরিবারের, প্রায় সব গাজাবাসীর খাবার এমনকি খাবার পানির তীব্র সংকট চলছে। যে সামান্য সাহায্য গাজায় ঢোকানো যাচ্ছে, তা ২৩ লাখ মানুষের জন্য একেবারেই সামান্য। ছোট ছোট অস্থায়ী তাঁবুর নিচে আশ্রয় নিয়েছে গাজার জনগণের বড় অংশ। এমন অবস্থায় ঈদ বা রোজা পালনের কথা তারা কল্পনাও করতে পারে না। তবুও হয়তো তারা ক্ষুধার্ত অবস্থাতেই শেষ রোজা এবং ঈদ পালন করতে চেষ্টা করবে।
গাজায় ঈদ উদযাপন ১০ এপ্রিল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এদিকে ইউনাইটেড ন্যাশনস রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কসন এজেন্সিজ ফর প্যালেস্টাইন রিফিউজিন ইন দ্য নেয়ার ইস্ট বা সংক্ষেপে আনরোয়া ন্যূনতম আয়োজনে ঈদ উৎসব পালনে সহায়তার প্রস্তুতি নিয়েছে। অন্তত গাজার মানুষ যাতে তাদের কিছু ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি, পিঠা খেতে পারে। এদিকে কোনো সন্দেহ নেই যে, মুসলিম বিশ্বের মানুষ গাজার জনগণের জন্য প্রার্থনা করবে; কিন্তু তারপর কী? আমার ব্যক্তিগত ধারণা গাজা যুদ্ধ শেষ তো হবেই না, বরং সম্প্রসারিত হতে চলেছে এবং সেটা ঈদের পর টের পাওয়া যাবে। লেবাননের হিজবুল্লারা ইরান দূতাবাসে আক্রমণের পর ইসরায়েলে রকেট নিক্ষেপ বৃদ্ধি করেছে। ইয়েমেনের হুতি গেরিলারা লোহিত সাগরে তাদের হামলা বৃদ্ধি করতে পারে। এমনকি ইসরায়েল লেবাননে সৈন্য প্রবেশ করিয়ে দিলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে