দেশে এখন কোনো প্রগতিশীল শক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না
বাংলাদেশে শক্তিমান, সমৃদ্ধিমান, উন্নতশীল, জনগণের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুস্পষ্ট লক্ষ্য নিয়েই বাংলাদেশ কোন পথে- এ প্রশ্নের উত্তর আমরা সন্ধান করি। কেবল অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধে কোনো সুফল নেই। এর দ্বারা বড় জোর এক অপশক্তির বদলে আরেক অপশক্তিকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আনা সম্ভব। গঠনমূলক চিন্তা ও কাজ দরকার। প্রচলিত আইন-কানুন, বিধি-ব্যবস্থা ও শৃঙ্খলাকে ভাঙতে হবে উন্নততর নতুন আইন-কানুন, বিধি-ব্যবস্থা ও শৃঙ্খলা প্রবর্তন করার জন্য; বিশৃঙ্খল অবস্থাকে স্থায়ী করার জন্য নয়। ভাঙতে হবে নতুন করে গড়ার জন্য- কেবল ধ্বংস করার জন্য নয়। এখন গড়ার ব্যাপারটাতেই গুরুত্ব দিতে হবে।
বাংলাদেশ কোন পথে, এ প্রশ্নের উত্তরে আসলে আমাদের সন্ধান করতে হবে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বর্তমান অস্তিত্বের স্বরূপ ও গতি-প্রকৃতি। বাংলাদেশের ভূভাগ ও জনসমষ্টি কি একটি রাষ্ট্র গঠনের উপযোগী? রাষ্ট্র হিসেবে সফল হতে হলে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষানীতি ও পররাষ্ট্রনীতি কী হওয়া উচিত? দক্ষিণ এশীয় বাস্তবতা ও বিশ্ববাস্তবতার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান বিবেচনা করে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। ভারতকে সম্প্রসারণবাদী মনে করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দিকে সম্পূর্ণ ঝুঁকে গিয়ে বাংলাদেশ কি ঠিক কাজ করেছে?
গত ৫৩ বছরে বাংলাদেশের জনগণ কি নিজেদের চেষ্টায় নিজেদের মধ্য থেকে নিজেদের জন্য প্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠনে কোনো অগ্রগতি সাধন করেছে? ‘রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন’ কথাটি কেন চালু হলো? দুর্বৃত্তায়নের জন্য দায়ী কি কেবল রাজনীতিবিদরা? রাজনীতিতে প্রভাব-বিস্তারকারী বুদ্ধিজীবীরা কী করেছেন? সিভিল সোসাইটি সংগঠনগুলোর বুদ্ধিজীবীরা কী করেছেন? এনজিওপতিরা কী করেছেন? আইনজীবীরা কী করেছেন? আমলারা কী করেছেন? ব্যবসায়ীরা কী করছেন? সাংবাদিকরা? ছাত্রনেতারা? জনসাধারণ? স্থানীয় দূতাবাসগুলো কী করেছে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন কী করেছে? বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল কী করেছে? বিদেশি আধিপত্যবাদীরা কি নিজেদের রাষ্ট্রের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশের স্বার্থে কাজ করার জন্য বাংলাদেশে আসে?
রাজনৈতিক সংকট কেবল রাজনীতিবিদরা নন, অন্যরাও সৃষ্টি করেন। দার্শনিক হেগেলের একটি উক্তি অবলম্বন করে বলা যায়, যে জনসাধারণ যখন যেমন নেতৃত্বের যোগ্য হয়, সেই জনসাধারণ তখন ঠিক সেই রকম নেতৃত্বই লাভ করে। তবে জনসাধারণ ইচ্ছা করলে নিজেদের চেষ্টায়, নিজেদের মধ্য থেকে, নিজেদের জন্য উৎকৃষ্ট নেতৃত্বও সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশের জনসাধারণ কী করেছে? নেতৃত্ব আকাশ থেকে অবতীর্ণ হয় না, জনসাধারণের ভেতর থেকেই আত্মপ্রকাশ করে। জনচরিত্রের প্রকাশ থাকে নেতৃত্বের চরিত্রে। নেতৃত্বের দ্বারাও জনচরিত্র গঠিত হয়। সার্বভৌমত্বের সীমা আছে- চিরকাল ছিল; কিন্তু এই সীমা দ্বারা এটা বোঝায় না যে, সার্বভৌমত্ব বলে কিছু নেই। কার্যক্ষেত্রে সার্বভৌমত্বের প্রমাণ রাষ্ট্রের আত্মনির্ভরতায়। নির্দিষ্ট ভূভাগ, সেই ভূভাগের জনগণ, উক্ত ভূভাগে ওই জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী সরকার ও সার্বভৌমত্ব এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি বিবেচনা করে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও উন্নতির শর্তাবলি তলিয়ে দেখা দরকার।
রাজনৈতিক দলকেও রাষ্ট্রে অপরিহার্য গঠনকর উপাদান রূপে গঠন করতে হবে। বাংলাদেশ কোন পথে, এ প্রশ্নের উত্তরে আমাদের ইতিহাসের ধারা অনুসরণ করে রাষ্ট্র ব্যবস্থার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ ও বিচার করতে হবে। গোটা ইতিহাসকেই সামনে আনতে হবে এবং ইতিহাসের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন ভবিষ্যৎ সৃষ্টির দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করতে হবে। তবে সম্মিলিত জীবনধারায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের ঘটনাবলিতে।
বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ ইতিহাসের সূচনা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সূচিত ছয় দফা আন্দোলন দিয়ে। বাংলাদেশ কোন পথে, তা বুঝতে হলে ছয় দফা আন্দোলন, তাজউদ্দীন সরকার ও স্বাধীনতা- যুদ্ধ, মুজিব সরকার, মোশতাক সরকার, জিয়া সরকার, এরশাদ সরকার, তত্ত্বাবধায়ক শাহাবুদ্দিন সরকার, খালেদা জিয়া সরকার, তত্ত্বাবধায়ক রহমান বিশ্বাস-হাবিবুর রহমান সরকার, হাসিনা সরকার, তত্ত্বাবধায়ক শাহাবুদ্দিন-লতিফুর রহমান সরকার, খালেদা জিয়া সরকার, তত্ত্বাবধায়ক ইয়াজউদ্দিন সরকার- এই পুরো সময়ের রাজনৈতিক ইতিহাস ও জনজীবনের ঘটনাবলি পর্যালোচনা করতে হবে। এতে সরকারি দল, বিরোধী দল, ডানপন্থি-বামপন্থি সব ধারা, বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী, এনজিও, সিভিল সোসাইটি সংগঠন, বিদেশি কূটনীতিক, মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথ, ভারত, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল সবার ভূমিকাই বিচার করতে হবে এবং ভালো-মন্দ চিহ্নিত করতে হবে।
জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ৯০ দিন মেয়াদি অরাজনৈতিক, নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বাংলাদেশ কেন রাজনৈতিকভাবে নিঃস্ব হয়েছিল, তার স্বরূপ উন্মোচন করতে হবে। নির্মোহ-নিরাসক্ত-সত্যসন্ধ দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করে, আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সব শক্তিকে বিবেচনায় ধরে, অভীষ্ট নতুন ভবিষ্যৎ সৃষ্টির লক্ষ্যে কালের মর্মপরিচয় উদ্ধার করতে হবে। বাংলাদেশে সুস্থ, স্বাভাবিক, বাস্তবসম্মত, আত্মনির্ভর, গতিশীল রাষ্ট্রচিন্তা না থাকার কারণেই নির্বাচন উপলক্ষে অরাজনৈতিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তন করা সম্ভব হয়েছিল বটে; কিন্তু এই ব্যবস্থায় বাংলাদেশ দুর্গতিতে নিপতিত হয়েছে। যদিও দীর্ঘ আন্দোলন ও সংগ্রামের পরিক্রমায় আজ আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি।
বাংলাদেশ কোন পথে, তার পরিচয় পাওয়া যাবে যদি বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা, রাজনৈতিক দল, রাষ্ট্রচিন্তা ও রাজনীতি; পরিবার ব্যবস্থা এবং নারী-পুরুষ সম্পর্ক; প্রশাসন-ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম; আইন ও বিচার ব্যবস্থা, শ্রম-ব্যবস্থাপনা ও অর্থনীতি: প্রচারমাধ্যম; শিক্ষাব্যবস্থা; জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শিল্পকলা ইত্যাদির চর্চা- এসব বিষয়ে অগ্রগতির ধারা ও ভবিষ্যৎ-সম্ভাবনা বিবেচনা করা হয়। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, রক্ষণশীলতা ও প্রগতিশীলতা বিচার করতে হবে। বাংলাদেশে এখন কি কোনো প্রগতিশীল শক্তি আছে? চলতি উত্তেজনা ও উপস্থিত অস্থিরতার মধ্যে অনেক ভুল ও অনেক অন্যায় আছে। এটা নিশ্চিত যে, গতানুগতি বাংলাদেশকে কোনো উজ্জ্বল ভবিষ্যতে নিয়ে যাবে না। এসব বিষয়ের আলোচনায় প্রবেশ করার ইচ্ছা থাকলেও বর্তমান প্রবন্ধের পরিসরে তা থেকে বিরত থাকাই সমীচীন মনে করছি।
কেউ কেউ বলে থাকেন, বাংলাদেশে ইতিহাসের চাকা পেছন দিকে ঘুরছে। তারা বাঙালির উনিশ ও বিশ শতকের বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ও গণজাগরণের মাধ্যমে প্রগতির যে ধারা বহমান ছিল, তা রুদ্ধ হয়ে যাওয়া এবং তার জায়গায় পরাজিত সব চিন্তা ও শক্তির উত্থান ও অগ্রগতি দেখে এ মত প্রকাশ করেন। তাদের পর্যবেক্ষণ ও মত বাস্তবসম্মত। প্রকৃতপক্ষেই রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি ও কুসংস্কারের ধারা শক্তিশালী হয়ে চলছে। এতে কোনো প্রকার সন্দেহের সুযোগ নেই। প্রগতিশীলদের ব্যর্থতাই এর মূল কারণ।
বাংলাদেশে এখন কোনো প্রগতিশীল শক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। অনাচ্ছন্ন মন নিয়ে এর কারণ-কার্য সূত্র অনুসন্ধান করা দরকার। প্রগতির ধারাকে আবার জাগ্রত, বিকাশশীল ও সক্রিয় করতে হলে নেতিবাচক, নঞর্থক, ঋণাত্মক, না-বাচক, নেগেটিভ দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাধারা ও কর্মধারা পরিত্যাগ করে ইতিবাচক, সদর্থক, ধনাত্মক, হ্যাঁ-বাচক, পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাধারা ও কর্মধারা অবলম্বন করতে হবে।
আবুল কাসেম ফজলুল হক: শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে