বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রবেশে সাংবাদিকদের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই
বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রতিবাদে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে গভর্নরকে বয়কট করলেন সাংবাদিকরা। রীতি অনুযায়ী প্রতি বছর বাজেটের পরদিন অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে এ সংবাদ সম্মেলন হয়ে থাকে। বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে গভর্নরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে দেশের মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক থেকে সরকারের গৃহীত ঋণ, তারল্য সংকট, খেলাপি ঋণ, অর্থ পাচার, রিজার্ভ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে সাংবাদিকদের নানাবিধ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকেন গভর্নর। কিন্তু এবার সাংবাদিকরা গভর্নরের কথা শুনতে অসম্মতি জানায়, গভর্নর যদি বক্তব্য দেন, তাহলে তারা সংবাদ সম্মেলন বয়কটের হুমকি দেন। ফলে গভর্নরের প্রশ্নোত্তর পর্বে আর অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। বাধ্য হয়ে অর্থমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান, অর্থ সচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার সাংবাদিকদের ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সব প্রশ্নের উত্তর দেন।
অন্যদিকে গত ১৫ মে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছে যে, বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রবেশের ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই, কখনো আরোপও করা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ নিয়ে কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন কর্মশালা, সেমিনার, টকশোতে কড়া কড়া বক্তব্যে সমালোচনা হচ্ছে। দেশের সুপরিচিত, প্রথিতযশা ব্যক্তিরাও বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কড়া ভাষায় প্রতিবাদ জানাচ্ছেন; কিন্তু বাংলাদেশে সাংবাদিকদের চাপ সৃষ্টির জোটবদ্ধ শক্তি থাকলেও আগের মতো সম্মান নেই, মানুষ এখন সাংবাদিকদের পুলিশের মতো ভয় করে। কারণ কিছু পত্রিকা ব্যবসা ও পুঁজি রক্ষায় ব্যস্ত, আর কিছু পত্রিকা দলীয় রাজনীতির তোষামোদে আত্মহারা। কিছু পত্রিকা সাংবাদিকদের পয়সা দেয় না, পয়সা তাদের জোগাড় করে নিতে হয়; এদের মধ্যে কেউ কেউ সন্ত্রাসী কায়দায় টাকা সংগ্রহ করে থাকে। তাই সাংবাদিকদের এখন অপরাধী-নিরপরাধী নির্বিশেষে সবাই ভয় করে, প্রতিষ্ঠানও তাদের আর আগের মতো সাদর অভ্যর্থনা জানায় না, তথ্য গোপন করে।
সাংবাদিকদের প্রবেশে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা আরোপের অসত্য খবরে কেউ কেউ এত বেশি রেগে গেছেন যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে পুনরায় অর্থ হ্যাকিং হওয়ার মিথ্যা অভিযোগ তুলতেও তারা ইতস্তত করেননি। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এই মর্মে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, বাংলাদেশ ব্যাংকে এমন কিছু ঘটেছে, যা জনসম্মুখে এলে বড় ধরনের নাশকতা হয়ে যাবে।’ ডাল মে কুচ কালা হে কথাটি বলে তিনি আবার ডালের শ্রেণি বিন্যাস করে সাংবাদিকদের উসকে দিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পুনরায় হ্যাকিং হওয়া অর্থের খবর যাতে উন্মোচিত না হয় সেজন্য সাংবাদিকদের বাংলাদেশ ব্যাংকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না- এমন প্রতীতি শুধু সাংবাদিকদের নয়, বিরোধী দলের নেতাদের মধ্যে প্রোথিত হয়ে গেছে।
অন্যদিকে সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠনের সভাপতির ধারণা বাংলাদেশ ব্যাংকের এ ধরনের পদক্ষেপ শুধু ব্যাংক লোপাটকারীদেরই উৎসাহিত করবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের মতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে সব আছে, সেখান থেকে তথ্য নিয়ে রিপোর্ট লেখা সম্ভব, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরে প্রবেশের প্রয়োজন থাকার কথা নয়। তার মতে পৃথিবীর কোনো দেশের সেন্ট্রাল ব্যাংকে সাংবাদিকদের অবাধে ঢুকতে দেয়া হয় না। এটা মিথ্যা নয়। আমি ১৯৮৯ সালে মালয়েশিয়ার সেন্ট্রাল ব্যাংক ‘ব্যাংক নিগারা মালয়েশিয়ায়’ প্রায় দুই মাস ‘সেন্ট্রাল ব্যাংকিং কোর্সে’ অংশগ্রহণ করি। সেই কোর্সে অংশগ্রহণ করেছিল ব্যাংক নিগারা মালয়েশিয়ার পাকিস্তান বংশোদ্ভূত শামছুদ্দীন। এই কোর্সের প্রায় ১৫ বছর পর শামছুদ্দীনের সঙ্গে দেখা করতে মালয়েশিয়ার সেন্ট্রাল ব্যাংকে গেলে অভ্যর্থনা কক্ষে কয়েকজন সাংবাদিককেও অপেক্ষা করতে দেখি। দেখলাম, ব্যাংক নিগারা মালয়েশিয়ার মুখপাত্র নিচে নেমে এসে নির্ধারিত কক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। শামছুদ্দীনের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পেরেছিলাম, ভেতরে কোনো কাজ না থাকলে সাংবাদিকরা সাধারণত ভেতরে যাওয়ার দরকার বোধ করেন না। নিরাপত্তা বিধানের গুরুত্ব বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক অন্য দশটি প্রতিষ্ঠানের মতো নয়; বাংলাদেশ ব্যাংক একটি কেপিআই এ-১ (কী পয়েন্ট ইনস্টলেশন এ-ওয়ান) প্রতিষ্ঠান। এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানে আইনগতভাবেই প্রবেশাধিকার সীমিত থাকে, যারা অনুমোদন নিয়ে প্রবেশ করবে, তাদের চলাফেরাও সিসি ক্যামেরায় পর্যবেক্ষণে থাকে।
কেপিআই প্রতিষ্ঠান বলেই উজবেকিস্তান সেন্ট্রাল ব্যাংকের আমন্ত্রিত অতিথি হয়েও পাসপোর্ট সঙ্গে না থাকায় আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি, উজবেকিস্তান সেন্ট্রাল ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরের অনুরোধও নিরাপত্তা কর্মীরা রাখেনি। পরে হোটেল থেকে পাসপোর্ট এনে সেন্ট্রাল ব্যাংকের ভেতরে ঢুকেছিলাম। ডেপুটি গভর্নরের কথা না শোনায় আমি বিস্মিত হয়েছিলাম, পরে জানতে পারি, নিরাপত্তা কর্মীরা সেন্ট্রাল ব্যাংকের কর্মচারী নন। বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরে প্রবেশে তত কড়াকড়ি নেই; বাইরের কেউ বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে অভ্যর্থনা ডেস্ক থেকে একটি পাস ইস্যুর ব্যবস্থা করতে হবে। সাংবাদিকদের জন্য সম্ভবত আরেকটু নমনীয় নিয়মের প্রচলন ছিল, সাংবাদিকরা নিচতলায় অভ্যর্থনা কক্ষে রাখা রেজিস্ট্রার বইয়ে পরিচয় লিখে, সই করে, পাস নিয়ে ভেতরে চলে যেতে পারতেন, পাস ইস্যুর জন্য কোনো নির্ধারিত কর্মকর্তার সুপারিশের প্রয়োজন ছিল না। সর্বশেষ নিয়মে এখন সবার জন্য একই নিয়ম করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সব সময় সাংবাদিকবান্ধব প্রতিষ্ঠান। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর মাহবুবুর রহমান খান তার সাংবাদিক বন্ধু আতাউস সামাদকে ডেকে নিয়ে তথ্য সরবরাহ করতেন। রন্ধনশিল্পী সিদ্দীকা কবিরের স্বামী ডেপুটি গভর্নর আলী কবিরের চেম্বারে নিয়মিত সাংবাদিকদের আনাগোনা ছিল, তিনি বহু বছর ধরে দৈনিক সংবাদে উপসম্পাদকীয় লিখেছেন। ড. আতিউর রহমানের সময় বাংলাদেশ ব্যাংক সাংবাদিকদের জন্য অভয়ারণ্য ছিল। তিনি সাংবাদিকবান্ধব গভর্নর ছিলেন, তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই মতবিনিময় করতেন। ফজলে কবির গভর্নর হয়ে আসার পর নতুন করে কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করা না হলেও সাংবাদিকদের আনাগোনা কমে যায়। বৈশ্বিক চাপে দেশের অর্থনীতি কিছুটা সংকুচিত হওয়ায় গভর্নর রউফ তালুকদারের সময় সাংবাদিকদের আগ্রহ আবার বাড়তে থাকে। সেন্ট্রাল ব্যাংকের সত্য তথ্যও কোনো কোনো সময় স্পর্শকাতর, যা প্রকাশিত হলে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। জনগণ বিভ্রান্ত হলে জনগণের বিশ্বাস ও আস্থায় ঘাটতি দেখা দিতে পারে, জনগণের আস্থায় ঘাটতি সৃষ্টি হলে ব্যাংক অস্তিত্বের সংকটে পড়ে যেতে পারে। তাই জাতীয় স্বার্থে সত্য তথ্যও লুকাতে হয়।
সম্প্রতি লাল, হলুদ, সবুজ অভিধায় শ্রেণিভুক্ত করে ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার পরিচয় তুলে ধরে কিছু ব্যাংককে অস্তিত্ব সংকটে ফেলে দেয়া হয়েছে। এই তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফ থেকে সরবরাহ করার কথা নয়, নিশ্চয়ই কোনো সাংবাদিক তা নিজস্ব কৌশলে সংগ্রহ করে এক্সক্লুসিভ খবর হিসেবে মিডিয়ায় প্রকাশ করে দিয়েছেন; কিন্তু তা করা কি দায়িত্বশীল সাংবাদিকের পরিচায়ক? এই ক্ষতি তো সরকারের নয়, এই ক্ষতি জাতির, এই ক্ষতি রাষ্ট্রের।এমন একটি অনভিপ্রেত ক্ষতিকর সংবাদ মিডিয়ায় আসার পরও বাংলাদেশ ব্যাংক কিন্তু সাংবাদিকদের ভেতরে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি, বহিরাগতরা যেভাবে যে নিয়মে প্রবেশ করে থাকে সাংবাদিকদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম অনুসৃত হবে মর্মে উল্লেখ করেছে; অর্থাৎ দেখা করতে হলে অভ্যর্থনা ডেস্কে গিয়ে বা তার পূর্বে যে কোনো সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বা তার সহকর্মী বা বাংলাদেশ ব্যাংকের যে কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে পাস ইস্যুর জন্য অভ্যর্থনা ডেস্কে বলার অনুরোধ করতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় সচিবালয়ের মতো ঘণ্টাব্যাপী বসে থাকতে হয় না, কয়েক মিনিটের মধ্যে পাস পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরে কোনো ভবনে একবার ঢুকলে সেই ভবনে অবাধ চলাফেরায় আর কোনো বাধা থাকে না। নির্বাহীদের ফ্লোরে যেতে সাধারণ পাসধারীদের সমস্যা হলেও সাংবাদিকদের কোনো সমস্যা হবে না, কারণ ব্যাংকের মুখপাত্র বা তার সহকর্মী যে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করে ওই ফ্লোরে যাওয়া সম্ভব। নিয়মের এই সামান্য পরিবর্তনে সাংবাদিকরা কেন গভর্নরের বক্তব্য শুনতে অস্বীকার করলেন, তা বোধগম্য হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি-পদ্ধতি, মনিটারি পলিসি ইত্যাদি প্রচারের জন্য সাংবাদিকদের সহযোগিতা অপরিহার্য, তাই সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক নিশ্চয়ই নিজের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করবে না। নতুন নিয়মে বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রবেশ ও প্রবেশের পর সাংবাদিকদের ভবনের অভ্যন্তরে অবাধ চলাফেরায় কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। পাস সংগ্রহে কোনো সমস্যা হলে তা নিয়ে সাংবাদিকরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলে সুরাহা করতে পারেন।
লেখক: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও টাকশালের সাবেক এমডি
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে